চরাচর-চুকনগরের গণহত্যা by গৌরাঙ্গ নন্দী
আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছিলেন তাঁরা। লক্ষ্য ছিল, সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ঠাঁই নেওয়া। পলায়নরত ভীতসন্ত্রস্ত সেই মানুষগুলোকে পাকিস্তানি হানাদাররা নির্বিচারে হত্যা করেছিল চুকনগরে। মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে একাত্তরের ২০ মে।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানাধীন চুকনগরে ২০ মে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডটি সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একক বৃহত্তম হত্যাযজ্ঞ। সকাল ১০টা নাগাদ শুরু হওয়া এই বর্বর হত্যাকাণ্ডটি চলে বিকেল ৪-৫টা অবধি। গুলি-বেয়নেটের আঘাত ও নদীপথে নৌকাযোগে পলায়নরত নর-নারী-শিশুর সলিল সমাধিতে কত মানুষের যে মৃত্যু হয়, তার সঠিক হিসাব কেউ বলতে পারে না।
একাত্তরের ২০ মে চুকনগরের গণহত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষরা আজও সেই যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। স্বজন হারানোর ব্যথা তাদের বুকেই চেপে আছে। এই দিনটি এলে তারা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। ঘৃণায় মুখ বেঁকে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাদের ওপর তেড়ে যাওয়া চিকন মোড়লকে হত্যা করে এখানকার হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। শহীদের ছেলে এরশাদ আলী মোড়ল বলেন, ঘটনার দিন তারা তিন ভাই তাঁদের বাবার সঙ্গে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করছিলেন। তাঁদের চাষের জমির অদূরে মাঠের মধ্যে, নদীতে-নদী তীরে, মন্দির, পাশের নদী তীরে, বাজার প্রভৃতি জায়গায় বিপুলসংখ্যক নর-নারী-শিশু এসে জড়ো হয়। তাদের অনেকেই বিশ্রাম নিচ্ছিল, অনেকেই রান্না করছিল, কেউ কেউ খাচ্ছিল। সকাল ৯টা-১০টার দিকে মিলিটারির দুটি গাড়ি আসে। একটি গাড়ি বাজারের দিকে যায়, একটি গাড়ি তাদের দিকে আসে। তা দেখে তাদের বাবা বলেন, 'এরশাদ, মিলিটারির গাড়ি আইছে, তোরা পালা।' এ কথা শুনে এরশাদরা তিন ভাই বাড়ির মধ্যে চলে যায়। মাঠে রয়ে যান চিকন মোড়ল। সেনারা এসে তাঁর সঙ্গে কী যেন কথা বলে। চিকন মোড়ল হাতের কাঁচি নিয়ে সেনাদের দিকে তেড়ে যান। আর সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠে। লুটিয়ে পড়েন চিকন মোড়ল। চুকনগরের গণহত্যাস্থলের প্রথম শহীদ তিনি। এরশাদ মোড়ল বলেন, 'বিকেল ৪টা-৫টার দিকে তিনি মাঠ, বাজার, নদীতীর, মন্দির প্রাঙ্গণসহ সব জায়গায় শুধু লাশ আর লাশ দেখেন। মাটি রক্তে ভেজা।
খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী ভদ্রা নদীর কোলঘেঁষা আজকের চুকনগর দেখলে একাত্তরের সেদিনের কথা কল্পনায়ও আনা যাবে না। এখন চুকনগরকে কেন্দ্র করে চারদিকে চারটি সড়ক। সাতক্ষীরা, যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনার দিক থেকে চারটি রাস্তা এসে মিশেছে এখানে। ভদ্রা নদীটি এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে। যে পাতাখোলা বিলটি মানুষের রক্তে লাল হয়েছিল, সেই বিলের এক পাশে আজ চুকনগর কলেজ; আর একদিকে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতিসৌধ। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের লাশ ফেলেছিলেন চারজন। তাঁরা হলেন কাওসার আলী, দলিল উদ্দীন, আনসার সরদার ও ইনছান সরদার। কাওসার আলী জানান, এলাকার ওহাব মোল্লার নির্দেশে সেদিন তাঁরা লাশগুলো ভদ্রা নদীতে নিয়ে ফেলেছিলেন। কাওসার আলীর ভাষায়_'সারা দিন ধইরে লাশ টেনেও শেষ করতি পারিনি। রক্তে গাঙ্গের পানি এয়েবারে রাঙ্গা টুকটুকে হয়ে গিলো।' লাশের সংখ্যা ১০-১২ হাজারের কম হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের একজন ৪২ শ পর্যন্ত লাশ গুনেছিল, আর গুনতে পারেনি। চুকনগর কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ও সেখানে হাড়গোড় পাওয়া যায়।
গৌরাঙ্গ নন্দী
No comments