দাহকালের কথা-সংকেত by মাহমুদুজ্জামান বাবু
১৭ মে। বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের হরতাল। সেদিন বরিশাল থেকে লঞ্চে ঢাকা ফিরে সদরঘাটে নেমেছিলাম ভোর সাড়ে পাঁচটায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেবিনে সারা রাত ঘুমের দেখা পাওয়া যায়নি। কেবিনের যাত্রীদের ঘুমোতে দেয়নি ছাত্রলীগ।
সেদিনই ঢাকায় শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়ার কর্মসূচি ছিল সরকারের সমুদ্রসীমা জয় উপলক্ষে। বরিশাল ছাত্রলীগের কর্মীরা ঢাকামুখী সেই লঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছে সারা রাত। দুই পাশের কেবিনের মাঝখানে যে করিডর, ক্যানটিন ও টয়লেটের সামনের চিলতে জায়গা, একতলা থেকে দোতলা-তিনতলায় ওঠার সিঁড়িমুখ—কোথায় ছিল না তারা! নীরবে থাকলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু তাদের উচ্চ স্বর, হাততালি, শিস, বেসুরো গান আর মাঝরাতে দুই পক্ষের কাজিয়া-বিবাদ রাতভর যন্ত্রণা ছড়িয়েছে। ভোরের দিকে তন্দ্রা ছুটে গেল লঞ্চে ভোঁ শব্দে। ঢাকা পৌঁছে গেছি। দরজা খুলতেই ভেসে এল বুড়িগঙ্গার পচে যাওয়া পানির দুর্গন্ধ। ছিনতাইকারী ওত পেতে আছে এই শহরের পথের বাঁকে অথবা সদর রাস্তায়। তাই সূর্য ওঠার অপেক্ষায় পায়চারী চলে সদরঘাটের একোণে-ওকোণে শুয়ে থাকা ছিন্নমূল মানুষের শরীর বাঁচিয়ে।
তো, সূর্য উঠল। হরতালে বাহন হিসেবে রিকশা নিরাপদ। সদরঘাট থেকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত ভাড়া ঠিক হলো ১৫০ টাকা। সাতসকালের রাস্তা ফাঁকাই থাকে। তার ওপর হরতাল। স্কয়ার হাসপাতালের কয়েক কদম আগে রাস্তার পাশে জটলা। ফুটপাথে কোদাল-টুকরি এলোমেলো পড়ে আছে অনেকগুলো। রিকশা ছেড়ে দিই। ভাসমান এই কাজের মানুষগুলোর একজন রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় ব্যথা পেয়ে অচেতন পড়ে আছেন। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হচ্ছে। জ্ঞান ফিরছে না। আমি অন্যদের কাছে তাঁর নাম জানতে চাই। তাঁর নাম হবিবর। উত্তরবঙ্গের উলিপুরের মানুষ হবিবর। এই কাজই তাঁর ও তাঁদের প্রাত্যহিক পেশা। যাঁর সঙ্গে বেশি কথা হচ্ছিল, তাঁর নাম শ্যামল। তিনিও উলিপুরের মানুষ। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, পলাশী-নীলক্ষেত মোড়, মিরপুর মাজার রোড, টেকনিক্যাল মোড়, রামপুরা-বিশ্বরোড সংযোগ সড়কের মুখ অথবা মোহাম্মদপুর বাজারের সামনে কোদাল-টুকরি নিয়ে শ্যামল-হবিবররা প্রতিদিন অন্ধকার ভোরে সমবেত হন কাজের আশায়। আলো ফুটলে ট্রাক নিয়ে ঠিকাদার বা ঠিকাদারের লোকজন এসে দামদর করেন। সমঝোতা শেষে ট্রাকে তুলে নেওয়া। কী কাজ, কোথায় কাজ আগে থেকে কিছুই জানার উপায় নেই। সারা দিনের চুক্তি। শ্রমের মূল্য ১০০-১৫০ টাকার ভেতরেই ঘোরাফেরা করে। সূর্য ডুবলে কাজ শেষ। ঘরে ফেরা। ঘর মানে বস্তি। বস্তি মানে মোহাম্মদপুর বা মিরপুর বেড়িবাঁধের ছাপরা, যেখানে প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারানো দ্রুতগতির ট্রাক ঢুকে পড়ে নিশুতি রাতে।
হবিবরের চেতনা ফিরে এসেছে। সবার মধ্যে স্বস্তিও ফিরল। সচেতন হবিবরের প্রথম আর্তি, ‘এ হে, মোর কোদাল কই?’ আহা! ইট কাঠ-কংক্রিটের এই রাজধানী শহরে হবিবর আর শ্যামলদের বেঁচে থাকার উপায় এখনো কোদাল! কোদাল-টুকরি গুছিয়ে মানুষগুলো সচল হতে চাইছে। আমি জানতে চাই, তাঁরা এখন কোথায় যাবেন। শ্যামল জানান, ভোররাতে তাঁরা কারওয়ান বাজারে বসেছিলেন। আজ তো হরতাল। ঠিকাদারের ট্রাক আসেনি। এখন তাঁরা আসাদগেটের দিকে যাবেন। তারপর মোহাম্মদপুর বাজার। হরতালের দিন কাজ অনিশ্চিত। কাজ না পেলে সেই ছাপরাঘর। আধা উপোস। আবার আগামীকালের অপেক্ষা। বেঁচে থাকতে চাওয়া।
১৮ মে সাতসকালে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় পুলিশের জনৈক কর্মকর্তার বজ্রমুষ্টির ছবি দেখে চমকে উঠতে হলো। এক তরুণের গলা টিপে ধরা হয়েছে, ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, তরুণটি হরতাল-সমর্থক। তরুণটির মুখাবয়ব বলে দিচ্ছে যে তার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের লোকজনকে পেটায়, কারাগারে পাঠায়। এটা শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাস নয়, বিশ্ব ইতিহাস। কিন্তু গলা টিপে ধরাটা কেমন! মানুষ কথা বলতে পারবে না? দাবি উচ্চারণ করতে পারবে না? তাহলে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বরে এত জয়ধ্বনি কেন শাসকদের মুখে? গলা টিপে ধরাটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? বাকশালী গণতন্ত্র? সম্ভবত তা-ই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আর সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কুটচালের পাশা খেলায় বিপর্যস্ত সারা দেশ। বাজার বিপর্যস্ত, বিদ্যুৎ বিপর্যস্ত, নিরাপত্তাব্যবস্থা বিপর্যস্ত, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী-সন্তান বিপর্যস্ত। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির পরিবার বিপর্যস্ত। বিপর্যস্ত এসএসসি ও সমমানের বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকেরা। এসব মিলিয়ে কোন শুভদিন সামনে আমাদের? আমরা এদের বাইরে অন্য রাজনীতি কেন খুঁজব না? বছরের পর বছর, একবার জ্বলন্ত চুলা আর একবার তপ্ত কড়াইয়ে এই যাওয়া-আসা আর কতকাল? মহাকাল জানে?
আমিও জানি না। আমি কেবল জানি, আমাকে একটা এসওএস বার্তা পাঠাতে হবে। এসওএস হচ্ছে বহুল ব্যবহূত আন্তর্জাতিক সোর্সকোড বিপৎসংকেত। সোর্সকোডের মাধ্যমে ধ্বনি ও আলোর সমন্বয়ে লেখা তথ্য এমনভাবে পাঠানো হয়, যা অভ্যস্ত ব্যবহারকারী যন্ত্রপাতি ছাড়াই অনায়াসে বুঝতে পারে। তিনটি বিন্দু, তিনটি সরলরেখা, আবার তিনটি বিন্দু পাশাপাশি রাখলে তা হয় সোর্সকোড এসওএস। আমরাও তিনজন। লঞ্চের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেবিনের অনিদ্রিত আমি, হরতালের দিন কাজের খোঁজে ভাসমান হবিবর-শ্যামলদের দল, আর পুলিশের দাম্ভিক মুষ্টিতে গলা টেপা খাওয়া শ্বাস না নিতে পারা সেই তরুণ। বার্তা পাঠাচ্ছি। এসওএস। এসওএস। কেউ দেখতে পাচ্ছেন কি?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
তো, সূর্য উঠল। হরতালে বাহন হিসেবে রিকশা নিরাপদ। সদরঘাট থেকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত ভাড়া ঠিক হলো ১৫০ টাকা। সাতসকালের রাস্তা ফাঁকাই থাকে। তার ওপর হরতাল। স্কয়ার হাসপাতালের কয়েক কদম আগে রাস্তার পাশে জটলা। ফুটপাথে কোদাল-টুকরি এলোমেলো পড়ে আছে অনেকগুলো। রিকশা ছেড়ে দিই। ভাসমান এই কাজের মানুষগুলোর একজন রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় ব্যথা পেয়ে অচেতন পড়ে আছেন। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হচ্ছে। জ্ঞান ফিরছে না। আমি অন্যদের কাছে তাঁর নাম জানতে চাই। তাঁর নাম হবিবর। উত্তরবঙ্গের উলিপুরের মানুষ হবিবর। এই কাজই তাঁর ও তাঁদের প্রাত্যহিক পেশা। যাঁর সঙ্গে বেশি কথা হচ্ছিল, তাঁর নাম শ্যামল। তিনিও উলিপুরের মানুষ। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, পলাশী-নীলক্ষেত মোড়, মিরপুর মাজার রোড, টেকনিক্যাল মোড়, রামপুরা-বিশ্বরোড সংযোগ সড়কের মুখ অথবা মোহাম্মদপুর বাজারের সামনে কোদাল-টুকরি নিয়ে শ্যামল-হবিবররা প্রতিদিন অন্ধকার ভোরে সমবেত হন কাজের আশায়। আলো ফুটলে ট্রাক নিয়ে ঠিকাদার বা ঠিকাদারের লোকজন এসে দামদর করেন। সমঝোতা শেষে ট্রাকে তুলে নেওয়া। কী কাজ, কোথায় কাজ আগে থেকে কিছুই জানার উপায় নেই। সারা দিনের চুক্তি। শ্রমের মূল্য ১০০-১৫০ টাকার ভেতরেই ঘোরাফেরা করে। সূর্য ডুবলে কাজ শেষ। ঘরে ফেরা। ঘর মানে বস্তি। বস্তি মানে মোহাম্মদপুর বা মিরপুর বেড়িবাঁধের ছাপরা, যেখানে প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারানো দ্রুতগতির ট্রাক ঢুকে পড়ে নিশুতি রাতে।
হবিবরের চেতনা ফিরে এসেছে। সবার মধ্যে স্বস্তিও ফিরল। সচেতন হবিবরের প্রথম আর্তি, ‘এ হে, মোর কোদাল কই?’ আহা! ইট কাঠ-কংক্রিটের এই রাজধানী শহরে হবিবর আর শ্যামলদের বেঁচে থাকার উপায় এখনো কোদাল! কোদাল-টুকরি গুছিয়ে মানুষগুলো সচল হতে চাইছে। আমি জানতে চাই, তাঁরা এখন কোথায় যাবেন। শ্যামল জানান, ভোররাতে তাঁরা কারওয়ান বাজারে বসেছিলেন। আজ তো হরতাল। ঠিকাদারের ট্রাক আসেনি। এখন তাঁরা আসাদগেটের দিকে যাবেন। তারপর মোহাম্মদপুর বাজার। হরতালের দিন কাজ অনিশ্চিত। কাজ না পেলে সেই ছাপরাঘর। আধা উপোস। আবার আগামীকালের অপেক্ষা। বেঁচে থাকতে চাওয়া।
১৮ মে সাতসকালে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় পুলিশের জনৈক কর্মকর্তার বজ্রমুষ্টির ছবি দেখে চমকে উঠতে হলো। এক তরুণের গলা টিপে ধরা হয়েছে, ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, তরুণটি হরতাল-সমর্থক। তরুণটির মুখাবয়ব বলে দিচ্ছে যে তার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের লোকজনকে পেটায়, কারাগারে পাঠায়। এটা শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাস নয়, বিশ্ব ইতিহাস। কিন্তু গলা টিপে ধরাটা কেমন! মানুষ কথা বলতে পারবে না? দাবি উচ্চারণ করতে পারবে না? তাহলে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বরে এত জয়ধ্বনি কেন শাসকদের মুখে? গলা টিপে ধরাটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? বাকশালী গণতন্ত্র? সম্ভবত তা-ই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আর সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কুটচালের পাশা খেলায় বিপর্যস্ত সারা দেশ। বাজার বিপর্যস্ত, বিদ্যুৎ বিপর্যস্ত, নিরাপত্তাব্যবস্থা বিপর্যস্ত, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী-সন্তান বিপর্যস্ত। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির পরিবার বিপর্যস্ত। বিপর্যস্ত এসএসসি ও সমমানের বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকেরা। এসব মিলিয়ে কোন শুভদিন সামনে আমাদের? আমরা এদের বাইরে অন্য রাজনীতি কেন খুঁজব না? বছরের পর বছর, একবার জ্বলন্ত চুলা আর একবার তপ্ত কড়াইয়ে এই যাওয়া-আসা আর কতকাল? মহাকাল জানে?
আমিও জানি না। আমি কেবল জানি, আমাকে একটা এসওএস বার্তা পাঠাতে হবে। এসওএস হচ্ছে বহুল ব্যবহূত আন্তর্জাতিক সোর্সকোড বিপৎসংকেত। সোর্সকোডের মাধ্যমে ধ্বনি ও আলোর সমন্বয়ে লেখা তথ্য এমনভাবে পাঠানো হয়, যা অভ্যস্ত ব্যবহারকারী যন্ত্রপাতি ছাড়াই অনায়াসে বুঝতে পারে। তিনটি বিন্দু, তিনটি সরলরেখা, আবার তিনটি বিন্দু পাশাপাশি রাখলে তা হয় সোর্সকোড এসওএস। আমরাও তিনজন। লঞ্চের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেবিনের অনিদ্রিত আমি, হরতালের দিন কাজের খোঁজে ভাসমান হবিবর-শ্যামলদের দল, আর পুলিশের দাম্ভিক মুষ্টিতে গলা টেপা খাওয়া শ্বাস না নিতে পারা সেই তরুণ। বার্তা পাঠাচ্ছি। এসওএস। এসওএস। কেউ দেখতে পাচ্ছেন কি?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
No comments