জনসংখ্যা আশীর্বাদ না অভিশাপ by কাজী সিরাজুল ইসলাম

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি লাভ করলেও জনসংখ্যা স্ফীতির অস্বাভাবিক হার জাতীয় অগ্রগতির জন্য প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৪০ বছরে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে চাষযোগ্য ভূমি অর্ধেকে নেমে এসেছে।


খাদ্য উৎপাদন তিন গুণ বাড়লেও সে সুফল ধরে রাখা যাচ্ছে না বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে। জাতীয় উন্নয়নে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই এখন সরকারের প্রধান করণীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ ক্ষেত্রে বিরাজ করছে তথৈবচ অবস্থা। পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মসূচিতে ঘনঘন পরিবর্তন, জন্মনিরোধক পণ্য আমদানিতে স্থবিরতা, মাঠপর্যায়ে সরবরাহে ঘাটতি এবং বেসরকারি খাতে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত চার দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হলেও তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণকারীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে গত কয়েক মাসে সরকারিভাবে প্রায় সব পদ্ধতির পণ্য সরবরাহ কমে যাওয়ায় কর্মসূচির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
পঞ্চম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ১৫ থেকে ১৯ মার্চ। প্রায় চার মাস পর গত ১৬ জুলাই আদমশুমারির যে প্রাথমিক ফল প্রকাশ হয়, তাতে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এ ফলাফল নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে মনে করা হতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি অথবা তার চেয়েও বেশি। জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার হিসাবেও এমন ধারণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক আদমশুমারি যাচাই করে জানায়, জরিপের প্রাথমিক হিসাব থেকে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ মানুষ বাদ পড়েছে। এ হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৪ কোটি ৮০ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আগামী জুনের মধ্যে এ সংশোধিত চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির দেশ। জনসংখ্যার আধিক্য অবশ্যই দেশের জন্য এক সমস্যা। জনসংখ্যা সীমিত রাখার জন্য যখন সর্বমুখী তাগিদ অনুভব হচ্ছে তখন আদমশুমারি জরিপে ফুটে উঠেছে একটি আশাবাদী চিত্র। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ হারে। এ হার ১০ বছর আগের চেয়ে শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ কম। তবে এতে আত্মসন্তুষ্টি হওয়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৬৫ জন। দেশবাসীর খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা পূরণে জনসংখ্যা স্ফীতি আরো কমিয়ে আনতে হবে। এক পরিবার এক সন্তান- লক্ষ্যমাত্রাকে উৎসাহী করতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে রাজনীতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রেও থাকতে হবে উদ্যোগ।
১৯৫৩ সালে এ দেশে সর্বপ্রথম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছর একদল নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী পরিবার পরিকল্পনা সমিতি গড়ে তোলে। শুরুতে সমিতি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণ এবং এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ষাটের দশকে এ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৬৫ সালে গড়ে তোলা হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শক্তিশালী করতে স্বাধীনতার পর পরই ব্যাপকভিত্তিক সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়। শুরু হয় কমিউনিটি বেজড ডিস্ট্রিবিউশন (সিবিডি) কার্যক্রম। এ কার্যক্রমে গর্ভধারণে সক্ষম প্রত্যেক মহিলার কাছে প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার করে একজন মাঠকর্মীকে পাঠানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। শুরুর দিকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা কার্যকর বন্ধ্যাকরণ ও আইইউডির মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন। স্থায়ী পদ্ধতির পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি পিল ও ইনজেকশন পদ্ধতির প্রচলনের পর নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই এগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ আড়াই দশক ধারাবাহিকভাবে এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
জনসংখ্যা আশীর্বাদ, অভিশাপ দুটোই বয়ে আনতে পারে। মানুষের দুটি মৌলিক চাহিদা অন্ন ও বাসস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জনসংখ্যা যেকোনো জাতির জন্য আশীর্বাদ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে অর্থাৎ দেশের আয়তন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অন্ন ও বাসস্থান সমস্যার সমাধানে পর্যাপ্ত না হলে তা অভিশাপও বয়ে আনতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রেও আশার আলো হয়ে দেখা দিতে পারে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার ঘটনা। বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়াতে হচ্ছে। ফলে আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পরিণামে মাথাপিছু খাদ্য উৎপাদন ও পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। মাত্র এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এ দেশের জনসংখ্যা সর্বাধিক পাঁচ কোটি হলে তা হতো মানানসই। স্বাধীনতার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটির কিছুটা বেশি। চার দশকে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি রোধ করতে হলে দরিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করতে হবে। দরিদ্রতা মানুষকে অদৃষ্টবাদী করে তোলে। নিজের বা সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকে দূরে রাখে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, হতদরিদ্রদের মধ্যেই জনসংখ্যা স্ফীতির পরিমাণ বেশি। জনসংখ্যা লাগামহীন রোধ ঠেকাতে দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টিও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মাথায় থাকতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পুরনো কাঠামো ভেঙে আধুনিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পরিসংখ্যানে নয়, কাজকর্মে দৃশ্যমান থাকতে হবে। প্রচার কার্যক্রমের ধরন ও গতিশীলতা বাড়াতে হবে। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে থাকতে হবে বাস্তবায়নের জোরালো দিকনির্দেশনা। সরকারি পর্যায় থেকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, ফরিদপুর-১

No comments

Powered by Blogger.