চলতি পথে-পুরাকীর্তির করুণ ও কঠিন বিলয় by দীপংকর চন্দ
চলন্ত বাসের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে প্রাচীন পরগনার ইতিহাস নিয়ে ভাবনাটা বাড়াবাড়ি হলেও আলাপসিংহ পরগনা নিয়ে আমরা ভাবলাম কিছুক্ষণ। আইন-ই-আকবর-ই গ্রন্থে আলাপসিংহ পরগনাকে অভিহিত করা হয়েছে আলেপশাহি নামে। ১৭২১ সালে পরগনাটি ছয় আনা এবং দশ আনা অংশে বিভক্ত হয়।
পরগনার ছয় আনা অংশের ভোগাধিকার লাভ করেন পুঁটিজানার রামচন্দ্র রায় ও ভবানীচন্দ্র রায়। অন্যদিকে দশ আনা অংশের ভোগাধিকার লাভ করেন লোকিয়া নিবাসী বিনোদরাম চন্দ। অধিকৃত অংশের যে স্থানে অবস্থান করে বিনোদরাম তাঁর জমিদারি পরিচালনা করতেন, কালক্রমে সে স্থানটি বিনোদবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু সময়মতো রাজস্ব প্রেরণে ব্যর্থতার অভিযোগে ১৭২৭ সালে বিনোদবাড়িসহ দুই খণ্ড কাওলায় পুরো আলেপশাহি পরগনার বন্দোবস্ত গ্রহণ করেন নবাব আলীবর্দি খাঁর দরবারের প্রভাবশালী পারিষদ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। ১৭৩৪ সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে এই বিশাল জমিদারির মালিকানা পান তাঁর চার ছেলে। তাঁরা সবাই থাকতেন বগুড়া জেলার ঝাকরে। জমিদারি বুঝে নিতে চার ভাই নৌকাযোগে একদিন আয়মন নদী তীরবর্তী বিনোদবাড়িতে পৌঁছালেন। বিনোদবাড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর। নতুন জমিদাররা স্থির করলেন, এখানেই জমিদারি পরিচালনার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবেন। সে লক্ষ্যেই ঘাটে ভিড়ল জমিদারদের নৌকা। নতুন জমিদারদের আগমনে নানা রকম উপঢৌকন নিয়ে ছুটে এল প্রজারা। মুক্তারাম কর্মকার নামে একজন প্রজা উপহার হিসেবে জমিদারদের সামনে উপস্থাপন করলেন অসাধারণ এক পিতলের দীপাধার। স্থানীয় ভাষায় এ ধরনের দীপাধারকে ‘গাছা’ বলা হয়। তো মুক্তারামের এই উপহার বিমোহিত করল জমিদারদের। তাঁরা অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং মুক্তারামের নামের প্রথম অংশের সঙ্গে ‘গাছা’ শব্দটি যুক্ত করে বিনোদবাড়ির নতুন নাম রাখলেন ‘মুক্তাগাছা’।
প্রাচীন পরগনার ইতিহাসসংক্রান্ত ভাবনায় ছেদ পড়ল এবার। কারণ মুক্তাগাছা বাসস্ট্যান্ড আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে। সুতরাং বাস থেকে নেমে রিকশা নিলাম। মহারাজা সড়ক ধরে এগোলাম খানিকক্ষণ। মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডার দোকানের উল্টো দিকেই জমিদারবাড়ির প্রধান তোরণ। রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম ভগ্নপ্রায় তোরণের দিকে। তোরণের দুই পাশে কারুকাজখচিত স্তম্ভশীর্ষে উৎকীর্ণ ‘সত্যং বলং কেবলং’। ধীর পদক্ষেপে সেই তোরণ অতিক্রম করলাম আমরা। পৌঁছালাম মুক্তাগাছা জমিদারবাড়িতে। বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত এই রাজসিক বাড়িটির চার অংশে বাস করতেন জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর চার পুত্র। দক্ষিণাংশে বাস করতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র রামরাম আচার্য। বর্তমানে সে অংশে উপজেলা ভূমি অফিস এবং নবারুণ বিদ্যানিকেতন সদম্ভে প্রতিষ্ঠিত। চতুর্থ পুত্র শিবরাম আচার্যের মালিকানাধীন অংশে বর্তমানে শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজের অবস্থান। যে অংশে বিষ্ণুরাম আচার্য থাকতেন, সে স্থানটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের দখলে। পুরাকীর্তি হিসেবে জমিদারবাড়ির যে অংশটুকু অধিগ্রহণে সমর্থ হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সেখানে বাস করতেন দ্বিতীয় পুত্র হরিরাম আচার্য। হ্যাঁ, জমিদার হরিরাম আচার্য চৌধুরী ও তাঁর বংশধরদের মালিকানাধীন অংশটুকুই বর্তমানে মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি হিসেবে পরিচিত সবার কাছে।
মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সিংহদ্বার পেরোলেই সুুউচ্চ ভিত্তিবিশিষ্ট বেশ কিছু ঘরের ভগ্নাবশেষ। তারপর সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত এক টুকরো উঠোন। সতেজ সেই উঠোন অতিক্রম করলেই বিগ্রহবিহীন পুজামণ্ডপ, নিশ্চিহ্নপ্রায় গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ। এর পরই মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। অংশটি রঙমহল নামে পরিচিত। হরিরাম আচার্য চৌধুরীর চতুর্থ উত্তরপুরুষ জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরী এই রঙমহল তৈরি করেন এবং কনিষ্ঠ পুত্রের নামে স্থাপনাটির নামকরণ করেন ‘ভূপেন্দ্র রঙ্গপীঠ’। চতুষ্কৌণিক এই রঙ্গপীঠের ডান পাশে রাজরাজেশ্বরী মন্দির। বাঁ পাশে দর্শক উপবেশনের স্থান। রঙ্গপীঠের পূর্বপ্রান্তে ১৯৪৫ সালে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ স্থাপন করেন নাট্যামোদি জমিদার জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মঞ্চটি স্থানান্তর করা হয় ময়মনসিংহ টাউন হলে। উচ্চশিক্ষিত জীবেন্দ্রকিশোর শুধু নাট্যামোদিই ছিলেন না, নিয়মিত পাঠাভ্যাসের বিরল গুণও ছিল তাঁর। তিনি তাঁর পিতা জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরীর নামে জমিদারবাড়িতে গড়ে তোলেন দুর্লভ বইয়ের এক সংগ্রহশালা। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর অসামান্য এই সংগ্রহটি ‘মুক্তাগাছা সংগ্রহ’ নামে স্থানান্তরিত হয় বাংলা একাডেমীতে।
সে যা-ই হোক, মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্তমানে ভীষণ নাজুক। নাট্যমঞ্চের ঠিক পেছনেই হতশ্রী কোষাগার। সেখানে একটি লোহার সিন্দুক পড়ে আছে ডালাভাঙা অবস্থায়। কোষাগারের পশ্চাদ্ভাগে অন্দরমহল। বারান্দাঘেরা সেই অন্দরমহলে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ফেরোসিমেন্টে তৈরি অবকাশগৃহ, কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে জাপানি রীতিতে তৈরি ঘরসহ বেশ কিছু অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন। পুরাকীর্তি হিসেবে সরকার মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির অংশটি অধিগ্রহণই করেছে কেবল, সরংক্ষণের বিষয়টি গ্রহণ করেছে একেবারেই দায়সারাভাবে। সরকারের এই দায়সারাভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের অনাগ্রহ, আমাদের অসচেতন মনোভঙ্গি। সুতরাং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ববাহী এই স্থাপনার ধ্বংস আজ অনেকটাই নিশ্চিত, অনেকটাই নিশ্চিত এই পুরাকীর্তির সকরুণ বিলয়।
প্রাচীন পরগনার ইতিহাসসংক্রান্ত ভাবনায় ছেদ পড়ল এবার। কারণ মুক্তাগাছা বাসস্ট্যান্ড আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে। সুতরাং বাস থেকে নেমে রিকশা নিলাম। মহারাজা সড়ক ধরে এগোলাম খানিকক্ষণ। মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডার দোকানের উল্টো দিকেই জমিদারবাড়ির প্রধান তোরণ। রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম ভগ্নপ্রায় তোরণের দিকে। তোরণের দুই পাশে কারুকাজখচিত স্তম্ভশীর্ষে উৎকীর্ণ ‘সত্যং বলং কেবলং’। ধীর পদক্ষেপে সেই তোরণ অতিক্রম করলাম আমরা। পৌঁছালাম মুক্তাগাছা জমিদারবাড়িতে। বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত এই রাজসিক বাড়িটির চার অংশে বাস করতেন জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর চার পুত্র। দক্ষিণাংশে বাস করতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র রামরাম আচার্য। বর্তমানে সে অংশে উপজেলা ভূমি অফিস এবং নবারুণ বিদ্যানিকেতন সদম্ভে প্রতিষ্ঠিত। চতুর্থ পুত্র শিবরাম আচার্যের মালিকানাধীন অংশে বর্তমানে শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজের অবস্থান। যে অংশে বিষ্ণুরাম আচার্য থাকতেন, সে স্থানটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের দখলে। পুরাকীর্তি হিসেবে জমিদারবাড়ির যে অংশটুকু অধিগ্রহণে সমর্থ হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সেখানে বাস করতেন দ্বিতীয় পুত্র হরিরাম আচার্য। হ্যাঁ, জমিদার হরিরাম আচার্য চৌধুরী ও তাঁর বংশধরদের মালিকানাধীন অংশটুকুই বর্তমানে মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি হিসেবে পরিচিত সবার কাছে।
মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সিংহদ্বার পেরোলেই সুুউচ্চ ভিত্তিবিশিষ্ট বেশ কিছু ঘরের ভগ্নাবশেষ। তারপর সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত এক টুকরো উঠোন। সতেজ সেই উঠোন অতিক্রম করলেই বিগ্রহবিহীন পুজামণ্ডপ, নিশ্চিহ্নপ্রায় গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ। এর পরই মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। অংশটি রঙমহল নামে পরিচিত। হরিরাম আচার্য চৌধুরীর চতুর্থ উত্তরপুরুষ জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরী এই রঙমহল তৈরি করেন এবং কনিষ্ঠ পুত্রের নামে স্থাপনাটির নামকরণ করেন ‘ভূপেন্দ্র রঙ্গপীঠ’। চতুষ্কৌণিক এই রঙ্গপীঠের ডান পাশে রাজরাজেশ্বরী মন্দির। বাঁ পাশে দর্শক উপবেশনের স্থান। রঙ্গপীঠের পূর্বপ্রান্তে ১৯৪৫ সালে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ স্থাপন করেন নাট্যামোদি জমিদার জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মঞ্চটি স্থানান্তর করা হয় ময়মনসিংহ টাউন হলে। উচ্চশিক্ষিত জীবেন্দ্রকিশোর শুধু নাট্যামোদিই ছিলেন না, নিয়মিত পাঠাভ্যাসের বিরল গুণও ছিল তাঁর। তিনি তাঁর পিতা জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরীর নামে জমিদারবাড়িতে গড়ে তোলেন দুর্লভ বইয়ের এক সংগ্রহশালা। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর অসামান্য এই সংগ্রহটি ‘মুক্তাগাছা সংগ্রহ’ নামে স্থানান্তরিত হয় বাংলা একাডেমীতে।
সে যা-ই হোক, মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্তমানে ভীষণ নাজুক। নাট্যমঞ্চের ঠিক পেছনেই হতশ্রী কোষাগার। সেখানে একটি লোহার সিন্দুক পড়ে আছে ডালাভাঙা অবস্থায়। কোষাগারের পশ্চাদ্ভাগে অন্দরমহল। বারান্দাঘেরা সেই অন্দরমহলে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ফেরোসিমেন্টে তৈরি অবকাশগৃহ, কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে জাপানি রীতিতে তৈরি ঘরসহ বেশ কিছু অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন। পুরাকীর্তি হিসেবে সরকার মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির অংশটি অধিগ্রহণই করেছে কেবল, সরংক্ষণের বিষয়টি গ্রহণ করেছে একেবারেই দায়সারাভাবে। সরকারের এই দায়সারাভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের অনাগ্রহ, আমাদের অসচেতন মনোভঙ্গি। সুতরাং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ববাহী এই স্থাপনার ধ্বংস আজ অনেকটাই নিশ্চিত, অনেকটাই নিশ্চিত এই পুরাকীর্তির সকরুণ বিলয়।
No comments