ধর্ম-ইসলামে সংখ্যালঘুদের অধিকার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ইসলাম শুধু মুসলমান নাগরিকদের জানমাল ও সম্মানের অধিকার প্রদান করেনি, বরং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী তথা খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ প্রভৃতি সব নাগরিকের যথাযথ অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। ইসলাম অমুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকারও প্রদান করে।
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সহনশীল। এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষত্ব। ইসলাম আরবভূমির বাইরে ও বিজিত ভূমিতে একমাত্র শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যে ধর্মে তার শাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন কোনো অবস্থায়ই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অপরিবর্তিত থাকবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যেও মুসলমানদের মানসিকতা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ‘শিশুদের হত্যা করবে না। গির্জায় যারা (খ্রিষ্টান ধর্মযাজক) ধর্মীয় উপাসনায় জীবন উৎসর্গ করেছে, তাদের ক্ষতি করবে না, কখনো নারী ও বৃদ্ধদের হত্যা করবে না; কারও গাছপালা, ঘরবাড়ি কখনো ধ্বংস করবে না।’
ইসলাম বিজিত দেশগুলোর সংখ্যালঘু অধিবাসীদের সর্বদা ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছে, যার ফলে তারা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে কখনো মুসলমান ও হুকুমাতের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার বাধার সম্মুখীন হয়নি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা দূরদর্শী হজরত উমর ফারুক (রা.) তাঁর শাসনামলে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সিরিয়ার গভর্নর আবু উবায়দাকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ‘তুমি মুসলমানদের অমুসলমান নাগরিকদের ওপর কোনো প্রকার অত্যাচার, প্রহার এবং তাদের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে ভোগদখল করতে নিষেধ করবে।’
মহানবী (সা.) রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তদানীন্তনকালে মদিনায় বসবাসরত বনু নাজির, বনু কুরাইজা ও বনু কাইনুকা গোত্রের পৌত্তলিক ও ইহুদি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কতগুলো নীতিমালার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি ‘মদিনার সনদ’ নামে খ্যাত। এ সনদের আলোকেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আদর্শ ইসলামি সমাজ ও আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। মদিনার সনদের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের সমন্বয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠন, যাতে সবার নাগরিক অধিকার ছিল সমান। সব সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না। কোনো সম্প্রদায় বহির্শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবার সম্মিলিত শক্তি দ্বারা প্রতিহত করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৫৬)
মদিনার সনদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ধর্মীয়সহিষ্ণুতা, সমাজ সংস্কার এবং সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ সনদ রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে সাহায্য করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে নিয়ত যুদ্ধরত গোত্রগুলোর শহর শান্তিপূর্ণ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। আল্লাহর রাসুলের দেওয়া নতুন সংবিধান অনুযায়ী এটা গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। নবী করিম (সা.) মদিনার প্রত্যেক মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মদিনার এ সনদ সমানাধিকার দান করে এবং এটা মদিনার মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর যথার্থই বলেছেন, ‘মদিনার সনদে হজরতের অসাধারণ মহত্ত্ব ও অপূর্ব মননশীলতা শুধু তৎকালীন যুগেই নয়, বরং সর্বযুগের, সর্বকালের মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।’ এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরবের শতধাবিভক্ত বিবদমান অমুসলিম গোত্রগুলোকে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের জানমাল ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন। আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধে যাওয়ার আগে নবীজি বিশ্বাসীদের উদ্দেশে কতিপয় শর্তের কথা বলে দিতেন, ‘আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে অবিচল থেকে যুদ্ধে যাবে। কখনোই বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের সামান্য ক্ষতিও করবে না। সব সময় তাদের অবস্থা ভালো করার চেষ্টা করবে এবং তাদের প্রতি দয়া-মায়া প্রদর্শন করবে। যারা ভালো, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’
নবী করিম (সা.) চরম সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। তিনি চাইলেই মক্কার অমুসলিম পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে নির্মম নিষ্ঠুর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর চরম শত্রু মক্কার ইসলামবিরোধী নেতাদের পরম মহানুভবতার সঙ্গে উদারভাবে সর্বজনীন ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। আপন চাচার হত্যাকারীদেরও নির্দ্বিধায় মাফ করে দিলেন। মাত্র ১০-১২ জন যুদ্ধাপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়। এ বিরল ঘটনার বিষয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পাশ্চাত্যের জন এসপোসিটো বলেন, ‘প্রতিশোধ গ্রহণ ও লুট করা এড়িয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করেন; শত্রুর প্রতি তরবারি ব্যবহার না করে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।’
বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষই এক আল্লাহর বান্দা। তাদের একে অন্যকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করা উচিত। সে জন্য বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষ সৃষ্টির পেছনে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য হলো, নানা সংস্কৃতির মিলনমেলা ঘটানো, মতভেদ আর যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়। ইসলাম এসেছে শান্তির বার্তা নিয়ে, যাতে আল্লাহর অনন্ত ক্ষমা ও সান্ত্বনার বার্তা এই পৃথিবীতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলা সবাইকে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি আহ্বান করেন, যাতে পৃথিবীর অধিবাসীরা সহনশীলতা, ক্ষমা, শান্তি উপভোগ করতে পারে। ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশ করলে তবেই সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। নবী করিম (সা.) সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন।
ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি দয়া দেখানো উচিত। অমুসলিমদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করা, অভাবী ও নিরপরাধকে রক্ষা আর অনিষ্টের বিস্তার সাধনকে প্রতিহত করা দরকার। অনিষ্ট বা অপকার হলো তা-ই, যা মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা, আরাম, শান্তিকে বিনষ্ট করে। আল্লাহ চান যারা তাঁকে বিশ্বাস করে, তারা অবশ্যই বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে; একে অন্যকে কল্যাণের পথে সহযোগিতা করবে আর সর্বদা পাপকাজকে এড়িয়ে চলবে। অথচ ধর্মের কথা বলে অমুসলমানদের ওপর অবিচার করা চরম অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে আমি কিয়ামতের দিন সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী হব।’
ইসলামের ন্যায়বিচার কোনো দেশ-কাল-জাতি বা মানুষ তথা মুসলিম-অমুসলিম ভেদে পক্ষপাতিত্ব করে না। ইসলাম গোত্রে গোত্রে, মানুষে মানুষে বর্ণবৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই অসংখ্য মানুষ বর্ণবাদ বা জাতিগত সমস্যায় অবিচার ও নিষ্ঠুরতার কারণে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন বর্ণ ও জাতির সৃষ্টির পেছনে উদ্দেশ্য হলো যেন ধর্মপ্রাণ মানুষ একে অন্যকে জানতে পারে। অতএব, ইসলামের আলোকে সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় এবং দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ দলমত-নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সংখ্যালঘু অমুসলিম নাগরিকদের জানমাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং নাগরিক ও আইনানুগ অধিকার সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে মানবতার কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করতে বদ্ধপরিকর হতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
ইসলাম বিজিত দেশগুলোর সংখ্যালঘু অধিবাসীদের সর্বদা ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছে, যার ফলে তারা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে কখনো মুসলমান ও হুকুমাতের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার বাধার সম্মুখীন হয়নি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা দূরদর্শী হজরত উমর ফারুক (রা.) তাঁর শাসনামলে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সিরিয়ার গভর্নর আবু উবায়দাকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ‘তুমি মুসলমানদের অমুসলমান নাগরিকদের ওপর কোনো প্রকার অত্যাচার, প্রহার এবং তাদের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে ভোগদখল করতে নিষেধ করবে।’
মহানবী (সা.) রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তদানীন্তনকালে মদিনায় বসবাসরত বনু নাজির, বনু কুরাইজা ও বনু কাইনুকা গোত্রের পৌত্তলিক ও ইহুদি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কতগুলো নীতিমালার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি ‘মদিনার সনদ’ নামে খ্যাত। এ সনদের আলোকেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আদর্শ ইসলামি সমাজ ও আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। মদিনার সনদের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের সমন্বয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠন, যাতে সবার নাগরিক অধিকার ছিল সমান। সব সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না। কোনো সম্প্রদায় বহির্শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবার সম্মিলিত শক্তি দ্বারা প্রতিহত করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৫৬)
মদিনার সনদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ধর্মীয়সহিষ্ণুতা, সমাজ সংস্কার এবং সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ সনদ রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে সাহায্য করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে নিয়ত যুদ্ধরত গোত্রগুলোর শহর শান্তিপূর্ণ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। আল্লাহর রাসুলের দেওয়া নতুন সংবিধান অনুযায়ী এটা গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। নবী করিম (সা.) মদিনার প্রত্যেক মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মদিনার এ সনদ সমানাধিকার দান করে এবং এটা মদিনার মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর যথার্থই বলেছেন, ‘মদিনার সনদে হজরতের অসাধারণ মহত্ত্ব ও অপূর্ব মননশীলতা শুধু তৎকালীন যুগেই নয়, বরং সর্বযুগের, সর্বকালের মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।’ এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরবের শতধাবিভক্ত বিবদমান অমুসলিম গোত্রগুলোকে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের জানমাল ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন। আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধে যাওয়ার আগে নবীজি বিশ্বাসীদের উদ্দেশে কতিপয় শর্তের কথা বলে দিতেন, ‘আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে অবিচল থেকে যুদ্ধে যাবে। কখনোই বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের সামান্য ক্ষতিও করবে না। সব সময় তাদের অবস্থা ভালো করার চেষ্টা করবে এবং তাদের প্রতি দয়া-মায়া প্রদর্শন করবে। যারা ভালো, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’
নবী করিম (সা.) চরম সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। তিনি চাইলেই মক্কার অমুসলিম পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে নির্মম নিষ্ঠুর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর চরম শত্রু মক্কার ইসলামবিরোধী নেতাদের পরম মহানুভবতার সঙ্গে উদারভাবে সর্বজনীন ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। আপন চাচার হত্যাকারীদেরও নির্দ্বিধায় মাফ করে দিলেন। মাত্র ১০-১২ জন যুদ্ধাপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়। এ বিরল ঘটনার বিষয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পাশ্চাত্যের জন এসপোসিটো বলেন, ‘প্রতিশোধ গ্রহণ ও লুট করা এড়িয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করেন; শত্রুর প্রতি তরবারি ব্যবহার না করে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।’
বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষই এক আল্লাহর বান্দা। তাদের একে অন্যকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করা উচিত। সে জন্য বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষ সৃষ্টির পেছনে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য হলো, নানা সংস্কৃতির মিলনমেলা ঘটানো, মতভেদ আর যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়। ইসলাম এসেছে শান্তির বার্তা নিয়ে, যাতে আল্লাহর অনন্ত ক্ষমা ও সান্ত্বনার বার্তা এই পৃথিবীতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলা সবাইকে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি আহ্বান করেন, যাতে পৃথিবীর অধিবাসীরা সহনশীলতা, ক্ষমা, শান্তি উপভোগ করতে পারে। ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশ করলে তবেই সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। নবী করিম (সা.) সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন।
ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি দয়া দেখানো উচিত। অমুসলিমদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করা, অভাবী ও নিরপরাধকে রক্ষা আর অনিষ্টের বিস্তার সাধনকে প্রতিহত করা দরকার। অনিষ্ট বা অপকার হলো তা-ই, যা মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা, আরাম, শান্তিকে বিনষ্ট করে। আল্লাহ চান যারা তাঁকে বিশ্বাস করে, তারা অবশ্যই বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে; একে অন্যকে কল্যাণের পথে সহযোগিতা করবে আর সর্বদা পাপকাজকে এড়িয়ে চলবে। অথচ ধর্মের কথা বলে অমুসলমানদের ওপর অবিচার করা চরম অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে আমি কিয়ামতের দিন সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী হব।’
ইসলামের ন্যায়বিচার কোনো দেশ-কাল-জাতি বা মানুষ তথা মুসলিম-অমুসলিম ভেদে পক্ষপাতিত্ব করে না। ইসলাম গোত্রে গোত্রে, মানুষে মানুষে বর্ণবৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই অসংখ্য মানুষ বর্ণবাদ বা জাতিগত সমস্যায় অবিচার ও নিষ্ঠুরতার কারণে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন বর্ণ ও জাতির সৃষ্টির পেছনে উদ্দেশ্য হলো যেন ধর্মপ্রাণ মানুষ একে অন্যকে জানতে পারে। অতএব, ইসলামের আলোকে সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় এবং দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ দলমত-নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সংখ্যালঘু অমুসলিম নাগরিকদের জানমাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং নাগরিক ও আইনানুগ অধিকার সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে মানবতার কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করতে বদ্ধপরিকর হতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments