ফলেই পরিচয় by মাহবুব মোর্শেদ
'বৃক্ষ তোমার নাম কী'_ 'ফলেই পরিচয়'। এই প্রবাদ শত শত বছর ধরে আমাদের দেশে প্রচলিত। বৃক্ষের পরিচয় ফলে। পত্রসুশোভিত মনোহর বৃক্ষ উপকারী বটে, তার নানা ব্যবহারও আছে। কিন্তু পরিচয় দিতে গেলে ফলের খবর পড়ে। তবে সব বৃক্ষ ফল দেয় না। কিছু বৃক্ষ ফুলের জন্যই খ্যাত।
কিছু আবার কাঠের জন্য কিংবা অন্য উদ্ভিজ গুণাবলির জন্য বিখ্যাত। ফল শুধু খাওয়ার উপযুক্ত বস্তু নয়। ফল মানে পরিণতিও। সেই অর্থে ফুলসহ অন্য সব বস্তুই চূড়ান্ত বিচারে ফল। আর ফলদ বৃক্ষের বেলায় তো কথাই নেই। মিষ্ট, টক বা কষা স্বাদ_ যা-ই হোক, ফল দিয়ে সে বৃক্ষ নিজের পরিচয় জ্ঞাপন করে। বলা যায়, ফল দেওয়ার ক্ষেত্রে বৃক্ষের কোনো কার্পণ্য নেই। উপযুক্ত পরিবেশ ও আবহাওয়া পেলে ফল ভালোই মেলে। বৃক্ষ নিজ থেকে ফলের স্বাদ, গন্ধ, তাৎপর্য কিছুই পরিবর্তন করে না। কিন্তু বৃক্ষের ফল পরিচয়ে বাদ সাধে মানুষ। এমনই বাদ সাধে যে, বৃক্ষের পরিচয়ই তাতে মুছে যাওয়ার জোগাড় হয়। বাংলাদেশে এখন ফলের মৌসুম। দেশি ফলে বাজারগুলোর রমরমা অবস্থা। কিন্তু ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে বৃক্ষের পরিচয় জানতে যেন ক্রেতারা কুণ্ঠিত। কেননা, প্রাকৃতিকভাবে এ ফলে যে গুণাগুণ থাকার কথা, তা আর অবিকৃত নেই। এতে অনেক দোষ ঘটেছে। সে দোষ ফলগুলোকে বিষাক্ত করে তুলেছে। কখনও ফলে মিশছে কার্বাইড, কখনও ফরমালিন, কখনও-বা জীবনঘাতী নানা মন্দ রাসায়নিক। এই রাসায়নিকগুলো ফলের বিশিষ্টতাকে কেড়ে নিচ্ছে। বিনিময়ে ফলগুলোকে দিচ্ছে পচনরোধী স্থায়িত্ব। এর ফলে লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে ক্রেতা ও ভোক্তারা। প্রথমত, বাজারের রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত ফল খেয়ে আসল ও প্রাকৃতিক ফলের স্বাদ ভুলতে বসেছে ক্রেতারা। দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক মিশ্রিত ফলগুলো ভোক্তাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব রাখছে। তৃতীয়ত, প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা। যে ফলকে উপকারী, পুষ্টিকর বলে কেনা হচ্ছে, তা-ই যে শরীরের বিপুল ক্ষতির কারণ হচ্ছে_ তা অনেকেরই অজানা। কিন্তু ক্রেতাদের এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য খুব বেশি উপায় বাজারে কার্যকর নয়। মাঝে মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে ফলের ভেতর থেকে বৃক্ষ নয়, রাসায়নিকের পরিচয় বের হয়ে আসছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে ক্রেতাসাধারণ কিছুদিন বিমুখ হচ্ছেন বটে, কিন্তু পরে নিরুপায় হয়ে সেই ফলরূপী রাসায়নিকের কাছেই ফিরছেন। ক্রেতাদের প্রতারণা করার ক্ষেত্রে সাধারণ দোকান আর অভিজাত বিপণিবিতানের মধ্যে পার্থক্য খুব কমই দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষতির হাত থেকে ক্রেতাদের রক্ষা করতে হলে ক্রেতা অধিকারের যে আইন থাকা দরকার, তা এ দেশে কার্যকর নয়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আছে নানা শিথিলতা। আর আইন-কানুনের ফাঁক গলে বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল, রাসায়নিক মিশ্রিত ক্ষতিকর ফল। ফলাফল সবার জানা। তাই এখন সেই প্রবাদের দিন শেষ। এখন বোধ হয় ফলকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, ফল তোমার নাম কী? ফল কি উল্টো বৃক্ষের পরিচয় বলবে? নাকি বলবে, রাসায়নিকে পরিচয়? কোন ফলে কোন রাসায়নিক মিশিয়ে তা বাজারজাত করা হয়, তার খবর জানাই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
No comments