এইদিনে-৫০ বছরে আসামের ভাষা আন্দোলন by অমর সাহা

আসামের কাছাড় জেলা শহরের গান্ধীবাগে রয়েছে আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধ। কলকাতা থেকে কাছাড়ে গিয়েছিলাম এই শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখার জন্য। গান্ধীবাগ সেদিন ছিল বন্ধ। সাধারণত বিকেলে দর্শনার্থীদের জন্য খোলা হয় এই গান্ধীবাগ।


কিন্তু বিকেলে শিলচর থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতায় ফিরতে হবে, এ কারণেই সকালের দিকে শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখার উদ্যোগ নিই। শিলচরের আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি উত্তম সাহা সকালেই শিলচর পৌরসভার চেয়ারম্যান সুস্মিতা দেবকে ফোন করে আমাদের শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখানোর ব্যবস্থা করেন। আমরা বেলা ১১টার দিকে সোজা চলে যাই গান্ধীবাগে। সুদৃশ্য শিশুপার্ক। এই পার্কের পেছনের দিকে রয়েছে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মরণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধ। আমরা ঢুকলাম। শহীদ স্মৃতিসৌধের ভেতরে। এই শহীদ মিনার গড়া হয়েছে একটি মন্দিরের আদলে। ভেতরে মেঝের ওপর ১১টি কৌটায় রাখা হয়েছে ১১ শহীদের চিতাভস্ম। মাঝে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে একটি বড় পদ্মফুল। আমরা ওই চিতাভস্মের সামনে মোম জ্বালালাম। ছড়িয়ে দিলাম ফুল। শ্রদ্ধা জানালাম শহীদদের প্রতি অবনত মস্তকে।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেই পথ ধরে আসামের এই বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছিল নয় বছর পর ১৯৬১ সালের ১৯ মে। আসামের রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে। সেই ভাষা আন্দোলনে আসামে শহীদ হয়েছিলেন ১১ জন। আজ সেই ভাষা আন্দোলন ৫০ বছরে পা দিচ্ছে। সেদিনের সেই ভাষা আন্দোলনের ফসল তুলে নিয়েছে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা। আসামের দ্বিতীয় রাজ্যভাষা হয়েছে বাংলা। আর বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা হয়েছে বাংলা।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা রাজ্য আসাম। আসামকে ভাগ করা হয়েছে দুটি উপত্যকায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বরাক উপত্যকা। বরাক উপত্যকায় রয়েছে তিনটি জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি। কাছাড় জেলার জেলা সদর শিলচর। এখানের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই বাঙালি বা বাংলায় কথা বলেন।
১৯৫১ সালে আদমশুমারিতে দেখা গেছে, বরাকে বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসাম রাজ্যের একটি অংশে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এটাই মেনে নিতে পারছিল না সেদিন অসমিয়া নেতারা। ফলে ভারত বিভাগের পর বাঙালিদের সঙ্গে অসমিয়াদের একটা ঠান্ডাযুদ্ধ লেগেই ছিল। আর এর জেরে সংখ্যালঘু অসমিয়ারা বাঙালিদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসত সরকারি মদদে। কারণ রাজ্য সরকারকে তখন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে অসমিয়ারাই। শুধু তা-ই নয়, যেসব খাস জমি বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে আবাদ করে উর্বর করে তুলেছে, সেই সব জমিও সরকার বাঙালিদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে দিয়ে দেয় অসমিয়া, খাসি ও গারোদের। ফলে এই নিয়ে বাঙালি-অসমিয়া বিরোধ শুরু হয়। বাঙালিদের মধ্যে বাড়তে থাকে ক্ষোভ ।
১৯৬০ সালের ২৮ অক্টোবর। আসাম বিধানসভায় পাস হওয়া আইনে বলা হয়, আসামের সরকারি ভাষা হবে অসমিয়া। বাঙালিসহ সবাইকে পড়তে হবে অসমিয়া ভাষায়। এই ঘোষণাকে সেদিন মেনে নিতে পারেননি বরাকের বাঙালিরা। তারা গর্জে ওঠে এর প্রতিবাদে। বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। সভাপতি হন আবদুর রহমান চৌধুরী আর সাধারণ সম্পাদক হন পরিতোষ পাল চৌধুরী। এই সংগ্রাম পরিষদকে ঘিরে বরাক উপত্যকার হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে যায় ভাষার প্রশ্নে। শুরু করে আন্দোলন। দাবি ওঠে, ‘জান দেব তবু ভাষা দেব না। চাই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, রাজ্যস্তরে সরকারি ভাষা হিসেবে।’
শুরু হয় বরাকজুড়ে বাংলা ভাষার আন্দোলন। তখন আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের বিমলা প্রসাদ চালিহা। ইনিই আবার নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রে পরাজিত হয়ে শিলচরে এসে সেই বাঙালিদের আশার বাণী শুনিয়ে তাদের ভোটে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী চালিহাই ঘোষণা দেন, স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম হবে অসমিয়া। এই ঘোষণার পর তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বাঙালিদের মাঝে। শুরু হয় বরাক উপত্যকাজুড়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন। এই আন্দোলন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও কাছাড়ে। এরই মধ্যে শাসক দল কংগ্রেস থেকে ফতোয়া দেওয়া হয়, কোনো কংগ্রেস কর্মী ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না। স্কুল-কলেজে সরকারি নির্দেশ পৌঁছে গেল, কেউ যদি ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তাদের পেতে হবে শাস্তি।
এরপর ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা।
১৯৬১ সালের ১৯ মে। সব বাধা ভেঙে আসামে শুরু হলো বাংলা ভাষার দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সেদিন আন্দোলনে শরিক হতে শিলচর স্টেশনে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। চলছে অবস্থান ধর্মঘট। মানুষের মুখে মুখে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে নানা স্লোগান। বিকেল চারটার মধ্যে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিকেল দুইটা ৩৫ মিনিটে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো শিলচর স্টেশনে। ভারতের আধাসামরিক বাহিনী অতর্কিতে গুলি শুরু করে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর। এতে এখানে শহীদ হন আন্দোলনে যোগ দেওয়া ১১ তরুণ-তরুণী।
শহীদ হলেন কমলা ভট্টাচার্য, কুমুদ দাস, শচীন পাল, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, সুকমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরুণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস এবং সত্যেন্দ্র দেব। সবারই বয়স ছিল ২৫-এর মধ্যে। কমলা ভট্টাচার্য এবং শচীন পালের বয়স ১৮ পার হয়নি। শহীদ হওয়ার আগের দিন এ দুজন স্কুলে দিয়েছিলেন জীবনের শেষ পরীক্ষা।
এই ঘটনার খবর ২০ মে ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে দেশজুড়ে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। দাবি ওঠে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। ৪০ হাজার মানুষের শোকমিছিল অনুষ্ঠিত হয় শিলচরে। তার পরই ১১ শহীদের শেষকৃত্য হয় শিলচর শ্মশানে। আজও সেই শ্মশানে এই ১১ শহীদের ১১টি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভের সামনে নামফলক রয়েছে শহীদদের। শুধু তা-ই নয়, শিলচর স্টেশনের সামনে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল এই ১১ তরুণ-তরুণীকে, সেখানেও তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। ১১ শহীদের নামে ১১টি স্তম্ভ।

No comments

Powered by Blogger.