সাক্ষাৎকারে বারভিডার সাবেক সভাপতি-গাড়ির শুল্ক হতে হবে গণপরিবহন-বান্ধব
যানজটের শহর হিসেবে যে দুর্নাম ছিল, ১০ বছরের চেষ্টায় তা ঘোচাতে পেরেছে কলকাতা। পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করলে আগামী ১০ বছরে ঢাকাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পেলে মানুষ এমনিতেই ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহ হবে। তা না করে কেবল শুল্ক বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে না, বাড়বে মানুষের খরচ আর ভোগান্তি। কালের কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বললেন বারভিডার সাবেক সভাপতি এবং অটোমিউজিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উল্লাহ ডন। আগামী বাজেটে নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির মধ্যে শুল্ক-বৈষম্য দূর করা, উন্নত মানের বাস ও ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসের জন্য উপযোগী শুল্ক নির্ধারণের দাবি জানান তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠের বিজনেস এডিটর মাসুদ রুমী
পর্যাপ্ত ও ভালো মানের গণপরিবহন না থাকার কারণে মানুষের ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, উন্নত বিশ্বে কিংবা আশপাশের দেশেও দেখা যায়, একজন নাগরিক ঘর থেকে বের হয়ে ভালো মানের ট্যাক্সিক্যাব, লাক্সারিয়াস এসি বাস, মেট্রোরেল, মনোরেল ইত্যাদি পাচ্ছে। সে ব্যক্তিগত গাড়ি বাসায় রেখে রেলে চড়ে শত শত মাইল দূরের অফিস করতে যাচ্ছে। এসব কোনো ব্যবস্থাই আমাদের দেশে নেই। আবার ব্যক্তিগত পরিবহনেও লাগাম টেনে ধরছে সরকার।
তিনি বলেন, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কী অভাব তা যারা রাস্তায় প্রতিদিন চলাচল করে, তারাই বোঝে। যাদের গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই, তারা রোদে-গরমে রাস্তায় একটা গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। একটা গাড়ি এলে তাতে উঠতে পারাটাই যেন ভাগ্যের ব্যাপার। গাড়িতে ওঠার পর পথে যানজটে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে তারা কর্মস্থলে যায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় মানুষের দুর্ভোগ কমানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কোনো সরকারই না করার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন এ গাড়ি ব্যবসায়ী। ভারত ও চীন থেকে আনা নিম্নমানের গাড়ি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। এসব গাড়ি দিয়ে চালু করায় ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসও প্রায় উঠে গেছে। ভালো মানের জাপানি, ইউরোপিয়ান বাসগুলো রাস্তায় নামালে ১০ বছরেও কিছু হবে না বলে দাবি করেন হাবিব উল্লাহ ডন।
ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজি অটোরিকশায় মিটারব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর করার পরামর্শ দিয়ে এই গাড়ি ব্যবসায়ী বলেন, নতুন রাস্তা, এলিভেটেড ওয়ে, এঙ্প্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার নির্মাণ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে যানজট কোনোদিনও কমবে না। শুনেছি যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন যানজট নিরসনে আরো ট্যাক্সিক্যাব ও বাস নামাবেন। আমরা বারভিডার পক্ষ থেকে সরকারকে বলেছি প্রাইভেট কার পাঁচ বছর পুরনো আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু কমার্শিয়াল গাড়ি বা বাস অন্তত আট বছর করা হোক।
রিকন্ডিশন্ড হাজার দুয়েক লাঙ্ারি বাস জাপান, কোরিয়া, কিংবা ইউরোপ থেকে এনে রাস্তায় নামিয়ে দিলে মানুষের ভোগান্তি লাঘব হবে বলে মনে করেন এই গাড়ি ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, সরকার তো অনেক জায়গায় সাবসিডি (ভর্তুকি) দিচ্ছে। যোগাযোগ খাতে কেন সরকার একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে না? সরকার এখনো যদি এ বিষয়ে সিরিয়াস না হয় তাহলে ঢাকা শহর আগামী ১০ বছরের মধ্যে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে।
পরিবহনকে সেবা খাত হিসেবে ঘোষণা করলে এর সুফল সবাই পাবে। বাজেট করা হয় জনগণের জন্য। আর সেই জনগণ যদি দুর্গতিতে থাকে তাহলে লাভ কী? তাই অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাজেটে পরিবহন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানান হাবিব উল্লাহ ডন।
গাড়ির ওপর সর্বোচ্চ ৮২৯ শতাংশ ডিউটি আরোপের নজির বিশ্বের কোথাও নেই বলে দাবি করলেন হাবিব উল্লাহ ডন। তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত গাড়ি আমদানি, আবার উৎপাদনও করছে। সেখানেও এমন উচ্চ শুল্ককাঠামো নেই। যদি দেখতাম স্থানীয় উৎপাদনকে বাঁচানোর স্বার্থে এটা করা হয়েছে তাহলে আমরা সান্ত্বনা পেতাম। এত বেশি শুল্ক আরোপে গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব নেমেছে অর্ধেকে। আবার জনগণও গাড়ি কিনতে পারছে না। তাহলে এতে কার লাভ হলো?'
গত দুই বছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, তাঁর শো-রুমে আগে যেখানে মাসে ৫০-৬০টি গাড়ি বিক্রি হতো এখন সেখানে পাঁচটি গাড়িও বিক্রি হয় না। প্রায় ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ টানতে না পেরে গাড়ির ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ফলে পুরনো গাড়ি বিক্রি থেকে সরকারের রাজস্ব কমে গেছে বলে জানান তিনি। দুই বছর আগে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি থেকে সরকার তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে। আর শুল্ক বাড়ানোর পর এ খাতে সরকারের আয় হচ্ছে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা। একটি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শুল্ক যেখানে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, নতুন গাড়ির শুল্ক মাত্র ৯ লাখ টাকা। শুল্ক বৈষম্যের কারণে সরকার প্রতিটি নতুন গাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা শুল্কবঞ্চিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। গত দুই বছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বাজার হারিয়েছে, আর নতুন গাড়ির দখলে গেছে বাজারের ৬০ শতাংশ। ব্যাংক ঋণের ইক্যুইটি ৭০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার ফলেও গাড়ির বিক্রি কমেছে বলে জানান তিনি।
ডন বলেন, 'দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং রিসেল ভ্যালুর কারণে আমাদের দেশের ক্রেতাদের ৯০ শতাংশই জাপানি গাড়ি ব্যবহার করে। তারা এখন আর এসব গাড়ি কিনতে পারছে না। এ ছাড়া টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ডলারের সঙ্গে ইয়েনের অবমূল্যায়নও হয়েছে। এতে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ক্রয়মূল্য আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তাই এসব বিবেচনা করে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।'
বারভিডার সাবেক এই সভাপতি বলেন, 'আমরা আশা করি মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে এত বড় বৈষম্য করতে দেবেন না। আমরা সিসিভিত্তিক স্ল্যাবের পুনর্বিন্যাস এবং মাইক্রোবাসের ওপর ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাই। আমরা সরকারের প্রতিপক্ষ নই। আমরাও চাই সরকার রাজস্ব পাক এবং ক্রেতারাও সুলভ মূল্যে ভালো গাড়ি কিনতে পারুক। আমরা এমন একটি নীতি চাই যেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নতুন-পুরনো সব গাড়ির ব্যবসায়ীরাই ব্যবসা করতে পারবে, ক্রেতাদেরও সুবিধা হবে।'
ডন বলেন, 'একটা দেশের উন্নতি, ব্যবসায়িক অগ্রগতি নির্ভর করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর। কলকাতাকে একসময় ডার্টি শহর, ট্রাফিক জ্যামের শহর বলা হতো। মাত্র ১০ বছরেই তারা তাদের শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছে।' তিনি বলেন, 'এমনিতেই আমাদের রাস্তা নেই। নতুন রাস্তা নির্মাণের তেমন উদ্যোগও নেই। আবার যা আছে তার প্রায় অর্ধেকটা প্রাইভেট কার পার্কিংয়ে এবং ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা দখল করে বসে থাকে। আমাদের রাস্তায় ভিআইপিদের গাড়ি একটু যানজট হলেই রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে চলা শুরু করে আর আমাদের ট্রাফিকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের স্যালুট মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রধান শহরের ভেতর দিয়ে এমন রেললাইন আর পৃথিবীর কোথাও নেই। শুরু থেকেই আমাদের পরিকল্পনার অভাব ছিল। অভাব ছিল চেষ্টারও।
যানজট, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে হবে। কেউ কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে না গন্তব্যে কখন পৌঁছাবেন।
অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশে টোলের বিনিময়ে (বিল অপারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফার- বিওটি) ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের কারণে এসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। আমরা গত দু-তিন বছরে যে রাজস্ব দিয়েছি তা দিয়েই একাধিক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যেত।'
ডন বলেন, 'সরকার যত দিন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সহজলভ্য না করবে তত দিন মানুষকে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভর করতে হবে। চাহিদামতো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পেলে মানুষ এমনিই নিরুৎসাহ হবে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে।
বিদেশে জ্বালানিসাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি চালু হয়েছে যা আমাদের দেশে এখনো তেমন একটা আসেনি। আমরা পাঁচ বছর আগে কিছু হাইব্রিড গাড়ি এনেছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে আমাদেরও তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের দেশে এসব উন্নত প্রযুক্তির ওয়ার্কশপ নেই। তা ছাড়া এসব গাড়িতে শুল্ক এখনো অনেক বেশি।'
কম দামে সাধারণ মানুষকে গাড়ি দিতে হলে দেশে প্লান্ট স্থাপন করা উচিত বলে মত দেন হাবিব উল্লাহ ডন। তিনি বলেন, 'জাপানি মিতসুবিসির সঙ্গে কথা হচ্ছে সেডান কার উৎপাদনের জন্য। আমি আমদানিকারক হয়েও স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে গাড়ি তৈরির কারখানা হোক। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে এমন হয়েছে। আমরাও করতে পারি। এ উদ্যোগে আমরাও সরকারকে সহযোগিতা করব।'
পর্যাপ্ত ও ভালো মানের গণপরিবহন না থাকার কারণে মানুষের ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, উন্নত বিশ্বে কিংবা আশপাশের দেশেও দেখা যায়, একজন নাগরিক ঘর থেকে বের হয়ে ভালো মানের ট্যাক্সিক্যাব, লাক্সারিয়াস এসি বাস, মেট্রোরেল, মনোরেল ইত্যাদি পাচ্ছে। সে ব্যক্তিগত গাড়ি বাসায় রেখে রেলে চড়ে শত শত মাইল দূরের অফিস করতে যাচ্ছে। এসব কোনো ব্যবস্থাই আমাদের দেশে নেই। আবার ব্যক্তিগত পরিবহনেও লাগাম টেনে ধরছে সরকার।
তিনি বলেন, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কী অভাব তা যারা রাস্তায় প্রতিদিন চলাচল করে, তারাই বোঝে। যাদের গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই, তারা রোদে-গরমে রাস্তায় একটা গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। একটা গাড়ি এলে তাতে উঠতে পারাটাই যেন ভাগ্যের ব্যাপার। গাড়িতে ওঠার পর পথে যানজটে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে তারা কর্মস্থলে যায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় মানুষের দুর্ভোগ কমানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কোনো সরকারই না করার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন এ গাড়ি ব্যবসায়ী। ভারত ও চীন থেকে আনা নিম্নমানের গাড়ি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। এসব গাড়ি দিয়ে চালু করায় ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসও প্রায় উঠে গেছে। ভালো মানের জাপানি, ইউরোপিয়ান বাসগুলো রাস্তায় নামালে ১০ বছরেও কিছু হবে না বলে দাবি করেন হাবিব উল্লাহ ডন।
ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজি অটোরিকশায় মিটারব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর করার পরামর্শ দিয়ে এই গাড়ি ব্যবসায়ী বলেন, নতুন রাস্তা, এলিভেটেড ওয়ে, এঙ্প্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার নির্মাণ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে যানজট কোনোদিনও কমবে না। শুনেছি যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন যানজট নিরসনে আরো ট্যাক্সিক্যাব ও বাস নামাবেন। আমরা বারভিডার পক্ষ থেকে সরকারকে বলেছি প্রাইভেট কার পাঁচ বছর পুরনো আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু কমার্শিয়াল গাড়ি বা বাস অন্তত আট বছর করা হোক।
রিকন্ডিশন্ড হাজার দুয়েক লাঙ্ারি বাস জাপান, কোরিয়া, কিংবা ইউরোপ থেকে এনে রাস্তায় নামিয়ে দিলে মানুষের ভোগান্তি লাঘব হবে বলে মনে করেন এই গাড়ি ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, সরকার তো অনেক জায়গায় সাবসিডি (ভর্তুকি) দিচ্ছে। যোগাযোগ খাতে কেন সরকার একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে না? সরকার এখনো যদি এ বিষয়ে সিরিয়াস না হয় তাহলে ঢাকা শহর আগামী ১০ বছরের মধ্যে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে।
পরিবহনকে সেবা খাত হিসেবে ঘোষণা করলে এর সুফল সবাই পাবে। বাজেট করা হয় জনগণের জন্য। আর সেই জনগণ যদি দুর্গতিতে থাকে তাহলে লাভ কী? তাই অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাজেটে পরিবহন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানান হাবিব উল্লাহ ডন।
গাড়ির ওপর সর্বোচ্চ ৮২৯ শতাংশ ডিউটি আরোপের নজির বিশ্বের কোথাও নেই বলে দাবি করলেন হাবিব উল্লাহ ডন। তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত গাড়ি আমদানি, আবার উৎপাদনও করছে। সেখানেও এমন উচ্চ শুল্ককাঠামো নেই। যদি দেখতাম স্থানীয় উৎপাদনকে বাঁচানোর স্বার্থে এটা করা হয়েছে তাহলে আমরা সান্ত্বনা পেতাম। এত বেশি শুল্ক আরোপে গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব নেমেছে অর্ধেকে। আবার জনগণও গাড়ি কিনতে পারছে না। তাহলে এতে কার লাভ হলো?'
গত দুই বছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, তাঁর শো-রুমে আগে যেখানে মাসে ৫০-৬০টি গাড়ি বিক্রি হতো এখন সেখানে পাঁচটি গাড়িও বিক্রি হয় না। প্রায় ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ টানতে না পেরে গাড়ির ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ফলে পুরনো গাড়ি বিক্রি থেকে সরকারের রাজস্ব কমে গেছে বলে জানান তিনি। দুই বছর আগে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি থেকে সরকার তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে। আর শুল্ক বাড়ানোর পর এ খাতে সরকারের আয় হচ্ছে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা। একটি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শুল্ক যেখানে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, নতুন গাড়ির শুল্ক মাত্র ৯ লাখ টাকা। শুল্ক বৈষম্যের কারণে সরকার প্রতিটি নতুন গাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা শুল্কবঞ্চিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। গত দুই বছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বাজার হারিয়েছে, আর নতুন গাড়ির দখলে গেছে বাজারের ৬০ শতাংশ। ব্যাংক ঋণের ইক্যুইটি ৭০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার ফলেও গাড়ির বিক্রি কমেছে বলে জানান তিনি।
ডন বলেন, 'দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং রিসেল ভ্যালুর কারণে আমাদের দেশের ক্রেতাদের ৯০ শতাংশই জাপানি গাড়ি ব্যবহার করে। তারা এখন আর এসব গাড়ি কিনতে পারছে না। এ ছাড়া টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ডলারের সঙ্গে ইয়েনের অবমূল্যায়নও হয়েছে। এতে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ক্রয়মূল্য আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তাই এসব বিবেচনা করে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।'
বারভিডার সাবেক এই সভাপতি বলেন, 'আমরা আশা করি মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে এত বড় বৈষম্য করতে দেবেন না। আমরা সিসিভিত্তিক স্ল্যাবের পুনর্বিন্যাস এবং মাইক্রোবাসের ওপর ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাই। আমরা সরকারের প্রতিপক্ষ নই। আমরাও চাই সরকার রাজস্ব পাক এবং ক্রেতারাও সুলভ মূল্যে ভালো গাড়ি কিনতে পারুক। আমরা এমন একটি নীতি চাই যেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নতুন-পুরনো সব গাড়ির ব্যবসায়ীরাই ব্যবসা করতে পারবে, ক্রেতাদেরও সুবিধা হবে।'
ডন বলেন, 'একটা দেশের উন্নতি, ব্যবসায়িক অগ্রগতি নির্ভর করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর। কলকাতাকে একসময় ডার্টি শহর, ট্রাফিক জ্যামের শহর বলা হতো। মাত্র ১০ বছরেই তারা তাদের শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছে।' তিনি বলেন, 'এমনিতেই আমাদের রাস্তা নেই। নতুন রাস্তা নির্মাণের তেমন উদ্যোগও নেই। আবার যা আছে তার প্রায় অর্ধেকটা প্রাইভেট কার পার্কিংয়ে এবং ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা দখল করে বসে থাকে। আমাদের রাস্তায় ভিআইপিদের গাড়ি একটু যানজট হলেই রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে চলা শুরু করে আর আমাদের ট্রাফিকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের স্যালুট মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রধান শহরের ভেতর দিয়ে এমন রেললাইন আর পৃথিবীর কোথাও নেই। শুরু থেকেই আমাদের পরিকল্পনার অভাব ছিল। অভাব ছিল চেষ্টারও।
যানজট, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে হবে। কেউ কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে না গন্তব্যে কখন পৌঁছাবেন।
অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশে টোলের বিনিময়ে (বিল অপারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফার- বিওটি) ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের কারণে এসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। আমরা গত দু-তিন বছরে যে রাজস্ব দিয়েছি তা দিয়েই একাধিক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যেত।'
ডন বলেন, 'সরকার যত দিন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সহজলভ্য না করবে তত দিন মানুষকে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভর করতে হবে। চাহিদামতো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পেলে মানুষ এমনিই নিরুৎসাহ হবে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে।
বিদেশে জ্বালানিসাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি চালু হয়েছে যা আমাদের দেশে এখনো তেমন একটা আসেনি। আমরা পাঁচ বছর আগে কিছু হাইব্রিড গাড়ি এনেছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে আমাদেরও তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের দেশে এসব উন্নত প্রযুক্তির ওয়ার্কশপ নেই। তা ছাড়া এসব গাড়িতে শুল্ক এখনো অনেক বেশি।'
কম দামে সাধারণ মানুষকে গাড়ি দিতে হলে দেশে প্লান্ট স্থাপন করা উচিত বলে মত দেন হাবিব উল্লাহ ডন। তিনি বলেন, 'জাপানি মিতসুবিসির সঙ্গে কথা হচ্ছে সেডান কার উৎপাদনের জন্য। আমি আমদানিকারক হয়েও স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে গাড়ি তৈরির কারখানা হোক। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে এমন হয়েছে। আমরাও করতে পারি। এ উদ্যোগে আমরাও সরকারকে সহযোগিতা করব।'
No comments