উচ্চশিক্ষা-বিশ্ব-বিদ্যা লয় by গোলাম মুরশিদ

প্রথমেই বলে নিই, এ লেখায় সবার কথা নয়, অনেকের কথা বলা হয়েছে। অনেক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
এখন যে-স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করি, তার পেছনে অসাধারণ অবদান রয়েছে বিশ্বুিবদ্যালয়গুলোর। শিক্ষকদের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু তার চেয়ে এন্তার বেশি অবদান ছাত্রদের।


ভাষা আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এমনকি স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন—প্রতিটি আন্দোলন ছিল তাদের সক্রিয় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অসামান্য। পূর্ব পাকিস্তান আমলে সাধারণ মানুষেরা তাই অনেক সম্মান করতেন ছাত্রদের। সেই ছাত্রদের গায়ের জোর আগের মতে]া নেই, তা নয়, বরং বেড়েছে। কিন্তু গায়ের জোরে গুরু হওয়া যায় না। সশস্ত্র গুন্ডামি সত্ত্বেও তারা সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে ব্যর্থ। অনেকে বরং ছাত্রদের ছিনতাইকারী, টেন্ডারবাজ, মাদকসেবী, দলীয় ক্যাডার বলে ভয় পান, কিন্তু মনে মনে করেন ঘৃণা। রাজনীতিকেরা এসব দেখেও না-দেখার ভান করেন, নয়তো ‘বাহবা বেশ’ বলে তাদের তারিফ করেন। কারণ, ছাত্রদের অনেকেই তাঁদের পোষা গুন্ডা। ফ্যাসিবাদী শাসন বহাল করার পাইক-বরকন্দাজ।
ছাত্ররাজনীতির উত্তরোত্তর প্রসারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষণা সরাসরি দায়ী, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর পরিপূরক হলো শিক্ষকদের রাজনীতি। ছাত্র আর শিক্ষকদের রাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম সর্বনাশের পথে এগিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে যে-বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যার চর্চা হয়। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ দাঁড়িয়েছে যেখানে বিশ্ববিদ্যা লয় প্রাপ্ত হয়।
শিক্ষকদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল সব সময়ে ছিল, কিন্তু এতে উচ্চফলনের সার দেওয়া হয় ১৯৭০-এর দশকের গোড়ায়, তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন আইন পাস করে। ধারণাটা প্রগতিশীল ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু নিষ্পাপ শিশু যেমন বড় হয়ে একদিন খুনিতে পরিণত হতে পারে, এই আইন থেকে তেমনি বিশ্ববিদ্যা চর্চার ধারাটাই লুপ্ত হয়েছে। প্রথম কয়েক বছর এই বিষবৃক্ষে ফল ধরেনি। কিন্তু বিভাগীয় কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার জন্য, ডিন হওয়ার জন্য, উপাচার্য হওয়ার জন্য দলীয় সমর্থক বাড়ানোর প্রয়াস যখন বেড়ে গেল, তখন এই বিষবৃক্ষে ফল ধরতে আরম্ভ করল। ফলের ভারে বৃক্ষটিই এখন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বেশির ভাগ শিক্ষকই নিযুক্ত হন বিভাগের সদ্য পাস করা ছাত্রদের মধ্য থেকে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি যে নিজের দলের সমর্থক হবে—এমন গ্যারান্টি তো নেই। কাজেই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় অনেক ভালো ছাত্র বাদ পড়লেন। নিযুক্ত হলেন দলীয় সমর্থকেরা। এই সমর্থকেরা বেশির ভাগই কম যোগ্যতাসম্পন্ন। কেউ কেউ রীতিমতো অযোগ্য। তাঁদের ছাত্ররা লেখাপড়া শিখল তাঁদের থেকেও কম। তাঁদের ছাত্ররা তাঁদের থেকেও কম। এখন সদ্য পাস করে যারা শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হচ্ছে, তারা প্রথম যাঁরা দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন সত্তরের দশকে, তাঁদেরই নাতি-নাতনি—তৃতীয় প্রজন্মের খারাপ ছাত্র। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে দলাদলির আখড়ায়। দলাদলি বিভাগে, ফ্যাকাল্টিতে, শিক্ষক সমিতিতে, সিনেট নির্বাচনে। এমনকি ছাত্রদের ফলাফল নিয়েও দলাদলি। কারণ, অনুগত ছাত্রকে প্রথম শ্রেণী দিয়ে দিতে পারলে তাকেই আবার বিভাগে নিয়োগ দিয়ে নিজের দল ভারী করা যায়।
শিক্ষকদের অনেকেই শ্রেণীকক্ষে গিয়ে লেখাপড়া শেখাতে চান না, অথবা শেখাতে পারেন না। কোন ক্লাসটা হবে—তাই নিয়ে ছাত্রদের দুশ্চিন্তা করতে হয়। ক্লাস হলে ছাত্ররা বর্তে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার এক শিক্ষককে চিনতাম, মাসের মধ্যে একদিন বেতন নিতে আসতেন। বাকি সময়টা পুণ্য করার কাজ—তাবলিগ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। জাহাঙ্গীরনগরের একজন অধ্যাপককে জানি, যিনি কালেভদ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পদধূলি দিয়ে তাকে ধন্য করার জন্য।
পরীক্ষার খাতা এই শিক্ষকদের বেশির ভাগই যথাসময়ে দেখে দেন না। যাঁরা দেখেন, তাঁরা অনেকে দায়সারাভাবে দেখেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে দর্শনের অধ্যাপক রসায়ন বিভাগের খাতা দেখে নম্বর দিয়েছেন। খাতাটা তাঁর কাছে ভুল করে গিয়েছিল। তিনি পৃষ্ঠা গুনে নম্বর দিয়েছেন—কী লেখা আছে দয়া করে সেটা আর দেখেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগ থেকে ৫২ জন প্রথম শ্রেণী পাওয়ার অসাধারণ ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য তাঁর পুত্রের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে ফলাফল ভালো করেছিলেন, তারও নমুনা রয়েছে।
নিজেদের পরীক্ষায়ও অসাধুতার আশ্রয় নিতে তাঁরা দ্বিধা করেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এক শিক্ষক কলকাতা থেকে পিএইচডি করে এলেন। পরে আবিষ্কার হলো যে তিনি কলকাতারই একজনের অভিসন্দর্ভ বাঁধাই করে অন্য শিরোনাম দিয়ে দাখিল করেছিলেন। তাঁর পরিচালক এবং পরীক্ষকেরা কেউই অভিসন্দর্ভ পড়ে দেখেননি। সুতরাং ডিগ্রি পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এক অধ্যাপক ছিলেন। অধ্যাপক না বলে ‘প্রফেসর’ বলা ভালো, নয়তো যথেষ্ট সম্মান দেখানো হবে না। মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাসের ওপর ঢাউশ বই আছে তাঁর। পড়তে গিয়ে একটি অধ্যায়কে আগে পড়েছি বলে মনে হলো। শেষে দেখলাম, সেটি আসলে ১৯৩৬ সালের এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ। অধ্যাপক মহোদয়ের কৃতিত্ব এই যে তিনি আগাগোড়া প্রবন্ধটি নির্ভুল উদ্ধৃত করেছেন। এ হেন অধ্যাপকের ছাত্ররা যদি জালিয়াতি করে বিচারপতি হন, তাতে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং এই জালিয়াত বিচারপতিকে যোগ্য ছাত্রই বলতে পারি, এমনকি বলতে পারি গুরু-মারা চেলা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলাদলি ছাড়া আরেকটি বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ এবং উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। সে হলো খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা। সেখানে যেহেতু জবাবদিহি আছে, সুতরাং হাজিরা নিয়মিত দেন। আর যেমনই পড়ান না কেন এবং ছাত্ররা যেমনই লেখুক না কেন, শতকরা অন্তত ৮০ নম্বর দিয়ে দেন। তা না হলে চাকরি থাকে না, বাড়তি আয়ও না। শিক্ষক হিসেবে নিজেই আমি এসব অনাচার হতে দেখেছি।
মোটকথা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন গৌরবারোপিত পাঠশালায় পরিণত হয়েছে। এসব জায়গায় ভদ্র এবং নিরীহ ছাত্রছাত্রীরা মেলামেশা এবং প্রেম করার সুযোগ পান, ছাত্রগুন্ডারা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পান, আর উপদলে বিভক্ত অযোগ্য শিক্ষকেরা, তা বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলে নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুরবস্থা ঘোচানোর উপায় কী?
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন অনির্বাচিত পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি কোনোক্রমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না।
২. উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সমর্থক হবেন না।
৩. সরকার বদলের সঙ্গে উপাচার্য বদল হবেন না। কাজ করবেন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য।
৫. ডিন হবেন এক বছরের জন্য, একেকটা বিভাগ থেকে রোটেশনের মাধ্যমে। নির্বাচন হবে না।
৬. বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র তিন-চারজন শিক্ষক রোটেশনের মাধ্যমে বিভাগের সভাপতি হবেন। প্ল্যানিং কমিটিতে থাকবেন তাঁরাই। বিভাগের সম্প্রসারণ দরকার আছে কি না, তাঁরাই তা ঠিক করবেন।
৭. বিভাগের শিক্ষকসংখ্যা এমন হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষক সপ্তাহে গড়ে সাত-আটটি লেকচার দিতে বাধ্য হন এবং সমানসংখ্যক টিউটরিয়াল ক্লাসও নেন।
৮. শিক্ষকেরা যাতে গবেষণা করার সুযোগ পান, তার জন্য প্রতি তিন বছর পরে এক বছর গবেষণা-ছুটি পেতে পারেন।
৯. চাকরির উন্নতির ক্ষেত্রে সত্যিকার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। খবরের কাগজে প্রকাশিত লেখা গবেষণামূলক বলে গণ্য হবে না।
১০. দ্বিতীয় পরীক্ষক অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হতে হবে। নম্বরে দশের বেশি পার্থক্য থাকলে তৃতীয় পরীক্ষক উত্তরপত্র পরীক্ষা করবেন।
১১. ব্যাঙের ছাতার মতো যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে, তাদের সংখ্যা কমাতে হবে।
১২. মান যাচাই করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দিতে হবে।
১৩. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতার দ্বিতীয় পরীক্ষক হবেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকেরা।
১৪. বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা থাকতে পারবে না।
আরও অনেক সুপারিশই করা যায়। কিন্তু আপাতত এগুলো পালন করলেও ১০-১৫ বছর পর থেকে লেখাপড়ার মান আবার উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
গোলাম মুরশিদ: লেখক, গবেষক।
Ghulammurshid@aol.com

No comments

Powered by Blogger.