চোর ধরতে অন্য চোরকে ব্যবহার কর by এ এম এম শওকত আলী
'চোর ধরতে অন্য চোরকে ব্যবহার কর' বাক্যটির প্রবাদ বাক্য হিসেবে পরিচিতি আছে। বাস্তবে এ পদ্ধতি অনুসৃত হয় কি না তা অনুসন্ধানের দাবি রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে তথ্য প্রদানকারী (Informer) হিসেবে কাজ করার জন্য কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এ ধরনের ব্যক্তিরা অপরাধী বা অপরাধপ্রবণ কি না তা জানার উপায় নেই।
কারণ, বিষয়টি 'গোপনীয়'। তবে এটুকু জানা গেছে, এসব ব্যক্তিকে নির্ভরযোগ্যতার মাপকাঠি বিবেচনায় 'ক', 'খ' ও 'গ' শ্রেণীভুক্ত করা হয়। এরাই সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধসম্পর্কিত আগাম তথ্য প্রদান করে। তবে এ পদ্ধতিতে তথ্য প্রদানকারীকে সরাসরি অপরাধ দমনের কাজে ব্যবহার করা হয় না। আইনশৃঙ্খলা বহিনীকে অপরাধসম্পর্কিত আগাম তথ্য প্রদানের কাজটি অনেক সময় এদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। প্রকৃত অপরাধীরা এদের শনাক্ত করতে সক্ষম হলে তাদের হত্যাও করে। এমন নজির সময় সময় মিডিয়া প্রকাশ করেছে।
অপরাধ দমন সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা জনমনে রয়েছে। ধারণাটি হলো, পুলিশই জানে অপরাধী কারা এবং ইচ্ছা করলেই এদের ধরতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা অনেক সময় হয় না। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক, উপযুক্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য ছাড়া কোনো কথিত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করলে আদালত তাকে মুক্তি দেবেন। দুই, অপরাধী যদি রাজনৈতিক-কর্মী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলভুক্ত হয়, তাহলে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে দ্বিধাবোধ করবে। কারণ, গ্রেপ্তারের পরই তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ এমন সব ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা দেবেন, যা পুলিশ সহজে উপক্ষো করতে পারবে না। চার, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু পুলিশের অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যের কারণে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না, সে বিষয়েও অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চোর ধরার বিষয়ে অতটা চিন্তিত নয়। কারণ, অন্যান্য গুরুতর অপরাধ দমনেই তারা ব্যস্ত। এ ধরনের গুরুতর অপরাধের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধ দমনের মাত্রা নিয়েও বিতর্কের কোনো অভাব নেই। সরকার কখনো স্বীকার করে না যে, অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনক বা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিডিয়াসহ সাধারণ নাগরিকদের ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিতর্কের এ ধারা চলতেই থাকবে, কারণ সাধারণ নাগরিকদের ধারণা আর সরকারের ধারণা পরস্পরবিরোধী।
কিছুদিন ধরে বঙ্গোপসাগরে ডাকাতিসহ মালামাল লুটের ঘটনাপ্রবাহ ভুক্তভোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে জাহাজ ব্যবসায়ীরাই এসব ঘটনার শিকার হন। ঘটনার অকুস্থল কুতুবদিয়া। দৈনিক কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কুতুবদিয়া-চট্টগ্রাম নৌপথে ডাকাতি রোধে সংশ্লিষ্ট জাহাজ ব্যবসায়ীদের সংগঠন পঁচিশজন ডাকাতকে নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগের সিদ্ধান্ত পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ অভিযান ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ থেকে শুরু হয়। এ উদ্যোগের মূল যুক্তি ডাকাতরাই জানে, কে কোন পথে ডাকাতি করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই ভুক্তভোগীরা এ ধরনের একটি অভিনব উদ্যোগের সূচনা করতে বাধ্য হয়েছে। সাগরের বিস্তৃত নৌপথে অপরাধ দমন পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য কোস্টগার্ড বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এ বাহিনী যে একেবারেই নিষ্ক্রিয় তা বলা যাবে না। সময় সময় খুব কমসংখ্যক হলেও এদের তৎপরতা সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জাহাজ ব্যবসায়ীরা ছাড়াও উপকূলবর্তী জেলার মৎস্যজীবীরাও ডাকাতির ঘটনায় আক্রান্ত হয়। সাগরে যে মাছ তারা অনেক কষ্ট করে জীবিকা উপার্জনের জন্য ধরে, তা ডাকাতরা লুট করে। এ কারণে তারা দুই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন। এক, সাগরে মাছ ধরার ঝুঁকি। দুই, ডাকাতিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। এসব ঘটনা সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে ঘটনার বিষয়ে প্রায়ই মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়, যা প্রমাণ করে যে এ ধরনের অপরাধের ঘটনা বিরল নয়। জাহাজ ব্যবসায়ীদের মতো এরাও একই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করবে কি না তা বলা দুষ্কর। তবে না করারই সম্ভাবনা বেশি। কারণ একাধিক। এক, এরা আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল নয়। যারা মাছ ধরে তারা মহাজনের ট্রলার ব্যবহার করে কিছু আয়-উপার্জন করে। দুই, এদের কোনো সংগঠন নেই। এ কারণেই সরকারের পক্ষ থেকে এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিন, এরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয় যে কারণে এদের দুঃখের কথা সংসদে খুব একটা আলোচিত হয় না। উপকূলীয় জেলার সংসদ সদস্যদের উচিত হবে এ কাজে তৎপর হওয়া, যাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
উলি্লখিত প্রবাদ বাক্য অনুসরণে সাগরে ডাকাতিরোধে ডাকাত নিয়োগের পদ্ধতির ভালো-মন্দ অবশ্যই রয়েছে। আদর্শিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করলে বলা যায়, রাষ্ট্র কখনো এ কাজ করতে পারে না বা উচিতও নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো, নিজস্ব আইনকানুন অনুসরণ করে প্রচলিত সরকারি সংস্থাকেই এ কাজে ব্যবহার করা। অন্যদিকে সার্বিকভাবে বিচার করলে বলা যায়, এ পদ্ধতিটি নিরাপত্তা বিধানের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াই মাত্র।
অপরাধ দমনে চোর-ডাকাত নিয়োগ না করেও যে বেসরকারিভাবে নিরাপত্তা বিধানের সংগঠনের অভাব নেই, তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে এরা কাজ করে। বিশেষ করে বহুতল ভবনে এদের কর্মীরা দৃশ্যমান। এ ধরনের ব্যবস্থার অন্য উদাহরণও রয়েছে। যেমন সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ওয়ার্ডভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মী। এর সঙ্গে যোগ করা যায় এলাকাভিত্তিক নৈশ পাহারার পদ্ধতি। এলাকাভিত্তিক সমিতির দ্বারা এরা কাজ করে। রাতে সড়কে তারা টহল দেয়। বিনিময়ে এলাকাবাসীর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা এ সেবার জন্য ব্যয় করতে হয়। এসব বহুমুখী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও অপরাধের মাত্রা কমেনি। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাগুলোর মূল্যায়ন প্রয়োজন।
বিশেষ ধরনের অপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টার বিষয়টিরও উদাহরণ রয়েছে। যেমন_'বিশেষ আনসার'। এ ব্যবস্থায় ১৯৯৯ সালে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে ২১২৬ জন 'চরমপন্থীর' জন্য বাস্তবায়নের প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৭৮৬ জনকে বিশেষ আনসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জানা গেছে, এ সংখ্যা কমে গিয়ে বর্তমানে ৪৮৫ জনকে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এদের প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ব্যক্তি এ প্রথা বর্জন করেছে। 'চরমপন্থী' নামে অভিহিত ব্যক্তিরা মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গ্রামগঞ্জে হত্যাসহ নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত। এরা নিজেদের বিভিন্ন বামপন্থী দলের সদস্য দাবি করে, যেসব দলকে অনেক দিন ধরেই নিষিদ্ধ দল হিসেবে সরকার ঘোষণা করেছে। ১৯৭১-পরবর্তী সময় থেকেই সব ধরনের সরকারই এদের দমনে উদ্যোগ নিলেও সম্পূর্ণভাবে দমনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে এদের প্রায়ই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এসব যুদ্ধে এদের অনেকেই নিহত হয়। মানবাধিকার সংগঠনের ব্যক্তিরা বিনা বিচারে হত্যার কথা বলে সরকারকে দোষারোপ করে। এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি আজও হয়নি।
১৯৯৯ সালের সরকারি সিদ্ধান্তটির মর্মকথা ছিল যে যদি নিরাপত্তা বা শান্তি বিধানে ব্যর্থ হও, তাহলে শান্তিকেই ক্রয় কর। এ ধরনের উক্তির দর্শন নিয়ে অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। প্রশ্নটি হলো, সফলতা অর্জনের বিষয়টিই মুখ্য। কী উপায়ে এ অর্জন হলো তা গৌণ। আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বা সরকারের জন্য যে উপায়ে সফলতা অর্জিত হয়েছে, তাও নিঃসন্দেহে মুখ্য। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে নৈতিকতা ও আইনের প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা সম্ভব। তা হলো, সরকারি অর্থ ব্যয় করেও কি চরমপন্থীদের কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। অভিজ্ঞতা তা সমর্থন করে না।
আদর্শিক ও বাস্তবতার দৃষ্টিকোণে বিচার করে বিশেষ আনসার-ব্যবস্থার বিষয়ে আরো কিছু প্রশ্ন রয়েছে। থানায় এদের পুলিশের সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। তা অবশ্য দাপ্তরিক কাজে। অপরাধ দমনের জন্য এদের প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করা হয় না। এ সত্ত্বেও থানায় কর্মরত অবস্থায় এরা অপরাধীদের সম্পর্কে কিছু তথ্য যে একেবারেই জানবে না, এমনটি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এদের মধ্যে যদি কেউ অপরাধীদের আগাম তথ্য প্রদানকারী হিসেবে কাজ করে, তাহলে নিশ্চয়ই আশঙ্কার কারণ। অন্যদিকে চিহ্নিত অপরাধীদের সরকারি অর্থ প্রদান করে কাজ করানোর বিষয়টি নৈতিক ও আইনি প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। কারণ, যেকোনো সরকারি সংস্থায় নিয়োগের জন্য পূর্বশর্ত হলো, প্রার্থীর অপরাধমূলক কোনো পূর্ব আচরণ থাকতে পারবে না। আনসার সরকারি আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ শ্রেণীর বাহিনীতে অপরাধীদের নিয়োগ প্রদান না করলেই ভালো হতো। পুনর্বাসনই যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানই ছিল উপযুক্ত ক্ষেত্র।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
অপরাধ দমন সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা জনমনে রয়েছে। ধারণাটি হলো, পুলিশই জানে অপরাধী কারা এবং ইচ্ছা করলেই এদের ধরতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা অনেক সময় হয় না। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক, উপযুক্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য ছাড়া কোনো কথিত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করলে আদালত তাকে মুক্তি দেবেন। দুই, অপরাধী যদি রাজনৈতিক-কর্মী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলভুক্ত হয়, তাহলে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে দ্বিধাবোধ করবে। কারণ, গ্রেপ্তারের পরই তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ এমন সব ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা দেবেন, যা পুলিশ সহজে উপক্ষো করতে পারবে না। চার, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু পুলিশের অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যের কারণে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না, সে বিষয়েও অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চোর ধরার বিষয়ে অতটা চিন্তিত নয়। কারণ, অন্যান্য গুরুতর অপরাধ দমনেই তারা ব্যস্ত। এ ধরনের গুরুতর অপরাধের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধ দমনের মাত্রা নিয়েও বিতর্কের কোনো অভাব নেই। সরকার কখনো স্বীকার করে না যে, অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনক বা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিডিয়াসহ সাধারণ নাগরিকদের ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিতর্কের এ ধারা চলতেই থাকবে, কারণ সাধারণ নাগরিকদের ধারণা আর সরকারের ধারণা পরস্পরবিরোধী।
কিছুদিন ধরে বঙ্গোপসাগরে ডাকাতিসহ মালামাল লুটের ঘটনাপ্রবাহ ভুক্তভোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে জাহাজ ব্যবসায়ীরাই এসব ঘটনার শিকার হন। ঘটনার অকুস্থল কুতুবদিয়া। দৈনিক কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কুতুবদিয়া-চট্টগ্রাম নৌপথে ডাকাতি রোধে সংশ্লিষ্ট জাহাজ ব্যবসায়ীদের সংগঠন পঁচিশজন ডাকাতকে নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগের সিদ্ধান্ত পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ অভিযান ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ থেকে শুরু হয়। এ উদ্যোগের মূল যুক্তি ডাকাতরাই জানে, কে কোন পথে ডাকাতি করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই ভুক্তভোগীরা এ ধরনের একটি অভিনব উদ্যোগের সূচনা করতে বাধ্য হয়েছে। সাগরের বিস্তৃত নৌপথে অপরাধ দমন পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য কোস্টগার্ড বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এ বাহিনী যে একেবারেই নিষ্ক্রিয় তা বলা যাবে না। সময় সময় খুব কমসংখ্যক হলেও এদের তৎপরতা সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জাহাজ ব্যবসায়ীরা ছাড়াও উপকূলবর্তী জেলার মৎস্যজীবীরাও ডাকাতির ঘটনায় আক্রান্ত হয়। সাগরে যে মাছ তারা অনেক কষ্ট করে জীবিকা উপার্জনের জন্য ধরে, তা ডাকাতরা লুট করে। এ কারণে তারা দুই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন। এক, সাগরে মাছ ধরার ঝুঁকি। দুই, ডাকাতিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। এসব ঘটনা সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে ঘটনার বিষয়ে প্রায়ই মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়, যা প্রমাণ করে যে এ ধরনের অপরাধের ঘটনা বিরল নয়। জাহাজ ব্যবসায়ীদের মতো এরাও একই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করবে কি না তা বলা দুষ্কর। তবে না করারই সম্ভাবনা বেশি। কারণ একাধিক। এক, এরা আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল নয়। যারা মাছ ধরে তারা মহাজনের ট্রলার ব্যবহার করে কিছু আয়-উপার্জন করে। দুই, এদের কোনো সংগঠন নেই। এ কারণেই সরকারের পক্ষ থেকে এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিন, এরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয় যে কারণে এদের দুঃখের কথা সংসদে খুব একটা আলোচিত হয় না। উপকূলীয় জেলার সংসদ সদস্যদের উচিত হবে এ কাজে তৎপর হওয়া, যাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
উলি্লখিত প্রবাদ বাক্য অনুসরণে সাগরে ডাকাতিরোধে ডাকাত নিয়োগের পদ্ধতির ভালো-মন্দ অবশ্যই রয়েছে। আদর্শিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করলে বলা যায়, রাষ্ট্র কখনো এ কাজ করতে পারে না বা উচিতও নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো, নিজস্ব আইনকানুন অনুসরণ করে প্রচলিত সরকারি সংস্থাকেই এ কাজে ব্যবহার করা। অন্যদিকে সার্বিকভাবে বিচার করলে বলা যায়, এ পদ্ধতিটি নিরাপত্তা বিধানের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াই মাত্র।
অপরাধ দমনে চোর-ডাকাত নিয়োগ না করেও যে বেসরকারিভাবে নিরাপত্তা বিধানের সংগঠনের অভাব নেই, তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে এরা কাজ করে। বিশেষ করে বহুতল ভবনে এদের কর্মীরা দৃশ্যমান। এ ধরনের ব্যবস্থার অন্য উদাহরণও রয়েছে। যেমন সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ওয়ার্ডভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মী। এর সঙ্গে যোগ করা যায় এলাকাভিত্তিক নৈশ পাহারার পদ্ধতি। এলাকাভিত্তিক সমিতির দ্বারা এরা কাজ করে। রাতে সড়কে তারা টহল দেয়। বিনিময়ে এলাকাবাসীর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা এ সেবার জন্য ব্যয় করতে হয়। এসব বহুমুখী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও অপরাধের মাত্রা কমেনি। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাগুলোর মূল্যায়ন প্রয়োজন।
বিশেষ ধরনের অপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টার বিষয়টিরও উদাহরণ রয়েছে। যেমন_'বিশেষ আনসার'। এ ব্যবস্থায় ১৯৯৯ সালে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে ২১২৬ জন 'চরমপন্থীর' জন্য বাস্তবায়নের প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৭৮৬ জনকে বিশেষ আনসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জানা গেছে, এ সংখ্যা কমে গিয়ে বর্তমানে ৪৮৫ জনকে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এদের প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ব্যক্তি এ প্রথা বর্জন করেছে। 'চরমপন্থী' নামে অভিহিত ব্যক্তিরা মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গ্রামগঞ্জে হত্যাসহ নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত। এরা নিজেদের বিভিন্ন বামপন্থী দলের সদস্য দাবি করে, যেসব দলকে অনেক দিন ধরেই নিষিদ্ধ দল হিসেবে সরকার ঘোষণা করেছে। ১৯৭১-পরবর্তী সময় থেকেই সব ধরনের সরকারই এদের দমনে উদ্যোগ নিলেও সম্পূর্ণভাবে দমনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে এদের প্রায়ই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এসব যুদ্ধে এদের অনেকেই নিহত হয়। মানবাধিকার সংগঠনের ব্যক্তিরা বিনা বিচারে হত্যার কথা বলে সরকারকে দোষারোপ করে। এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি আজও হয়নি।
১৯৯৯ সালের সরকারি সিদ্ধান্তটির মর্মকথা ছিল যে যদি নিরাপত্তা বা শান্তি বিধানে ব্যর্থ হও, তাহলে শান্তিকেই ক্রয় কর। এ ধরনের উক্তির দর্শন নিয়ে অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। প্রশ্নটি হলো, সফলতা অর্জনের বিষয়টিই মুখ্য। কী উপায়ে এ অর্জন হলো তা গৌণ। আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বা সরকারের জন্য যে উপায়ে সফলতা অর্জিত হয়েছে, তাও নিঃসন্দেহে মুখ্য। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে নৈতিকতা ও আইনের প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা সম্ভব। তা হলো, সরকারি অর্থ ব্যয় করেও কি চরমপন্থীদের কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। অভিজ্ঞতা তা সমর্থন করে না।
আদর্শিক ও বাস্তবতার দৃষ্টিকোণে বিচার করে বিশেষ আনসার-ব্যবস্থার বিষয়ে আরো কিছু প্রশ্ন রয়েছে। থানায় এদের পুলিশের সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। তা অবশ্য দাপ্তরিক কাজে। অপরাধ দমনের জন্য এদের প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করা হয় না। এ সত্ত্বেও থানায় কর্মরত অবস্থায় এরা অপরাধীদের সম্পর্কে কিছু তথ্য যে একেবারেই জানবে না, এমনটি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এদের মধ্যে যদি কেউ অপরাধীদের আগাম তথ্য প্রদানকারী হিসেবে কাজ করে, তাহলে নিশ্চয়ই আশঙ্কার কারণ। অন্যদিকে চিহ্নিত অপরাধীদের সরকারি অর্থ প্রদান করে কাজ করানোর বিষয়টি নৈতিক ও আইনি প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। কারণ, যেকোনো সরকারি সংস্থায় নিয়োগের জন্য পূর্বশর্ত হলো, প্রার্থীর অপরাধমূলক কোনো পূর্ব আচরণ থাকতে পারবে না। আনসার সরকারি আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ শ্রেণীর বাহিনীতে অপরাধীদের নিয়োগ প্রদান না করলেই ভালো হতো। পুনর্বাসনই যদি মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানই ছিল উপযুক্ত ক্ষেত্র।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
No comments