গ্যাস সেক্টর-এক বছরের মধ্যেই সংকট নিরসন সম্ভব হবে by মোঃ হোসেন মনসুর

উন্নত দেশগুলোতে গ্যাস, তেল ও কয়লা ছাড়াও রিনিউয়েবল এনার্জি অন্যতম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী। এখানে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধান জ্বালানি হিসেবে প্রায় এককভাবে ব্যবহার হচ্ছে, যার জোগান দিতে পেট্রোবাংলা হিমশিম খাচ্ছে।


প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতিও জ্বালানি সেক্টরকে মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে


জ্বালানি সেক্টর একটি দেশের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। বিদ্যুৎ, শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ, গৃহস্থালি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুর উন্নয়নে জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। উন্নত দেশগুলোতে গ্যাস, তেল ও কয়লা ছাড়াও রিনিউয়েবল এনার্জি অন্যতম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী। এখানে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধান জ্বালানি হিসেবে প্রায় এককভাবে ব্যবহার হচ্ছে, যার জোগান দিতে পেট্রোবাংলা হিমশিম খাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতিও জ্বালানি সেক্টরকে মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে। এ সংকট উত্তরণের জন্য পেট্রোবাংলা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান, উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেকেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তুলনা করতে চান। কিন্তু দুটি সেক্টরের কার্যাবলি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। টাকা থাকলে বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ করা যত সহজ, কিন্তু ওই পল্গান্টে গ্যাস সরবরাহ করা তত সহজ নয়। গ্যাস সরবরাহের আগে কোথায় গ্যাসক্ষেত্র আছে তা অনুসন্ধান করতে হয়। ২-ডি সাইসমিক সার্ভে পরিচালনা করে অনেক খোঁজাখুঁজি করে যদি কোনো সম্ভাবনাময় স্ট্রাকচার পাওয়া যায়, সেখানে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। একটি কূপ খনন করার জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করতে হয়, সে জায়গা নিচু হলে মাটি ফেলে ভরাট করতে হয়, উঁচু পাহাড় হলে পাহাড়ের মাথা কেটে সমান করতে হয়। সেখানে ড্রিলিং প্যাড নির্মাণ করে রিগ নিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা ও কালভার্ট এবং ড্রিলিং পার্টির থাকার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়। এরপর সেখানে বিশালাকার রিগ স্থানান্তর করে কূপ খনন করতে হয়। কূপ খননকালে অনাকাঙ্ক্ষিত/কারিগরি কারণেও অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। কূপ করে যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তবে সে গ্যাস ব্যবহারোপযোগী করার জন্য প্রসেস পল্গান্ট (গ্যাস শোধনাগার) ও পাইপলাইন নির্মাণ করতে হয়। সে জন্য আবার ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়। সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে এসব কাজ সম্পন্ন করতে স্বাভাবিকভাবেই অনেক সময় লেগে যায়। এত বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে মাত্র ২০ থেকে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা যায়। তাই হঠাৎ করেই কিছু করা সম্ভব হয় না।
গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উৎপাদন : বাপেক্স পেট্রোবাংলার একমাত্র অনুসন্ধান কোম্পানি। মোট চারটি রিগ এখন অনুসন্ধান, উৎপাদন ও বন্ধ কূপ সংস্কার কার্যক্রমে নিয়োজিত আছে। মহাজোট সরকারের আড়াই বছর সময়কালে ৯টি বন্ধ কূপ ওয়ার্কওভার (সংস্কার) করে ও ফিল্ড ম্যানেজমেন্ট করে পেট্রোবাংলা ২৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। বন্ধ কূপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উৎপাদনে আনার যৌক্তিকতা হলো, বন্ধ কূপের সঙ্গে প্রসেস পল্গান্ট ও সঞ্চালন পাইপ লাইনের সংযোগ থাকে। তাই বন্ধ কূপ ওয়ার্কওভার করে উৎপাদিত গ্যাস অতি দ্রুত সরবরাহ করা যায়। নতুন করে উৎপাদন কূপ (ডেভেলপমেন্ট কূপ) খনন করে গ্যাস সরবরাহ তুলনামূলকভাবে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পেট্রোবাংলা আশা করছে ২০১১ সালের মধ্যে চলমান ৪টি রিগের খনন কার্যক্রমে প্রতিদিন আরও ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অতিরিক্ত উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। নতুন একটি রিগ জুলাই মাসে এসেই ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শুরু করবে এবং আরও প্রতিদিন ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস চলতি বছরেই উৎপাদন করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ২০১২ সাল নাগাদ নতুন আরও একটি রিগ ক্রয়ের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পেট্রোবাংলা আশা করছে, ২০১২ সাল নাগাদ নিজস্ব উদ্যোগে ৫টি অনুসন্ধান কূপসহ মোট ২০টি কূপ খনন করা যাবে। গ্যাস উৎপাদনে সাফল্য : অতীতের তুলনায় গ্যাস উৎপাদনে সাফল্য লক্ষণীয়। যেমন ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৩২.৪৯ বিসিএফ, অন্যদিকে ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমাণ ৫২.২৮ বিসিএফ। গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রেও একই রকম উন্নতি লক্ষ্য করা যায়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বিক্রয় বৃদ্ধি ছিল ৯%, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৫.০৫%। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের গ্যাস সমস্যাকে মেটানোর জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সাগরে অবস্থিত সাংগু গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন নগণ্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। সাংগু গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন উৎপাদন হতো প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যার পুরোটাই সঞ্চালন পাইপ লাইনের মাধ্যমে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হতো, ওই গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন নেমে এসেছে প্রতিদিন ১৫ হতে ১৬ মিলিয়ন ঘনফুটে। বাখরাবাদ-চট্টগ্রাম পাইপলাইন দিয়ে সর্বোচ্চ ১৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যায়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ঘাটতির পরিমাণ ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। ঘাটতি পূরণের জন্য সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্রের ওয়ার্কওভার প্রায় শেষ পর্যায়ে। নতুন আরও একটি কূপ খনন করে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রতিদিন চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হবে। পাইপলাইন ও প্রসেস পল্গান্ট নির্মাণ (নির্মাণ কাজ পুরোদমে চলছে) করে আশা করা যায় আগামী অক্টোবরের মধ্যেই ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। চট্টগ্রামের সমস্যা সামনে রেখে সালদা নদী ও কোম্পানীগঞ্জে খনন কাজ চলছে এবং বেগমগঞ্জে কূপ খনন করা হবে। অন্যদিকে স্যান্টোস অক্টোবরেই সাংগু গ্যাসক্ষেত্রে খনন কার্যক্রম শুরু করবে। ফারনেস অয়েলের চেয়ে এলএনজির মূল্য কম হওয়ায় এলএনজি আমদানির কার্যক্রম চলছে। আশা করা যায়, ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকেই এলএনজি আমদানি করে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চট্টগ্রাম মহানগরীতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ব্লক ১২, ১৩ ও ১৪-তে কর্মরত শেভরন, বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ২০১২ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে মৌলভীবাজারে খননকার্য শুরু করে দিয়েছে।
সার্বিক গ্যাস সংকট নিরসন কার্যক্রম : গ্যাস ব্যবহারের চাহিদার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০১২ সালে প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজন হবে প্রায় ৩৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট প্রতিদিন উৎপাদন করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১২ সালে কমপক্ষে প্রতিদিন ৩৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হবে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে যোগ হবে। পেট্রোবাংলা আশা করছে ২০১২ সালের পর বাংলাদেশ গ্যাস সংকট থেকে মুক্তি পাবে।
সাইসমিক কর্মকাণ্ড : সাইসমিক কর্মকাণ্ডে বাপেক্স অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। ২-ডি এবং ৩-ডি সাইসমিক টিম এক সঙ্গে মাঠে কাজ করছে। বর্ষাকালে মাঠে সাইসমিক কাজ করা যায় না। এবারের শুষ্ক মৌসুমে ইতিমধ্যেই রশীদপুর, কৈলাশটিলা ও হরিপুর পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ৭০৫ বর্গকিলোমিটার ৩-ডি সাইসমিক সার্ভের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ৩-ডি সাইসমিক সার্ভের প্রাথমিক ফল অত্যন্ত ভালো। ২-ডি সাইসমিক সার্ভের মাধ্যমে নতুন নতুন স্ট্রাকচার চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উলেল্গখযোগ্য হলো সুনেত্র, বাজিতপুর, মদন, রূপগঞ্জ ও খালিয়াজুরি। শ্রীকাইল, কাপাসিয়া ও মোবারকপুরসহ উপরোক্ত স্ট্রাকচারগুলোতে অনুসন্ধান কূপ খননের মাধ্যমে ২০১২ সালের মধ্যে আশা করা যায় বেশ কয়েকটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ : রাজশাহীবাসীর দাবি পূরণের লক্ষ্যে সরকার পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বনপাড়া থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি ব্যাসের ৫৩ কিলেমিটার সঞ্চালন পাইপলাইন এবং ১ ইঞ্চি হতে ৮ ইঞ্চি ব্যাসের ২৮০ কিলোমিটার পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ বর্তমান সরকারের আমলে শেষ হয়েছে। আশা করা যায়, জুলাই মাসে রাজশাহীবাসী গ্যাসের চুলায় রান্না করবে। এ ছাড়া মনোহরদী থেকে ধনুয়া পর্যন্ত এবং এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৫১ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে নলকা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৪ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ কাজ চলছে, যা এ বছরই শেষ হবে। হাটিকুমরুল থেকে ঈশ্বরদী হয়ে ভেড়ামারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের মোট ৮২ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেমুতাং থেকে চিটাগাং পর্যন্ত ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ৬৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ চলছে, যা আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে শেষ হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য পেট্রোবাংলা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আশা করা যায় ২০১২ সালের মধ্যেই গ্যাস সংকট থেকে জাতি মুক্তি পাবে।

অধ্যাপক ড. মোঃ হোসেন মনসুর : চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা
 

No comments

Powered by Blogger.