তথ্য অধিকার দিবস-আমাদের জানার অধিকার স্বীকৃত by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে/নইলে মোদের রাজার সঙ্গে মিলব কি স্বত্বে?'_কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাণী বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হলো ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। ব্যাপারটা সহজ করে বলি_আমাদের ভোটে সরকার গঠিত হয়। এমনকি আমাদের টাকা দিয়েই সরকার দেশ চালায়। গণতন্ত্রে সরকার মানে কিন্তু গাড়ির চালকের মতো। গাড়ি চালানোর দায়িত্ব তার, তাই বলে তারা গাড়ির মালিক নন।
গাড়ির মালিক জনগণ। অতএব সেই সরকারকে প্রশ্ন করার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে এবং সরকারও সেই উত্তর দিতে বাধ্য। সহজ অর্থে এরই নাম তথ্য অধিকার আইন। এতে সরকারের যেমন স্বচ্ছতা বাড়ে, জনগণেরও আস্থা বাড়ে সরকারের প্রতি। তাই বলে সব তথ্য যে চাওয়া যাবে, তাও নয়। যেমন_রাষ্ট্রের এমন কোনো গোপন তথ্য জানতে চাওয়া যাবে না, যা প্রকাশ হয়ে গেলে দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতায় আঘাত আসবে। এমন স্পর্শকাতর বেশ কিছু তথ্য ছাড়া অন্য যেকোনো তথ্য যে কেউ জানতে পারবেন তথ্য কমিশন থেকে। আর অবশ্যই এটি নাগরিক অধিকার। ২০০২ সালের এই দিনে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সচেতন মানুষ একত্র হয়ে একটি কর্মশালার মধ্য দিয়ে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে তথ্য অধিকার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তখন থেকে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালন করে আসছে। এ দিবসটি পালনের প্রধান উদ্দেশ্যই তথ্য অধিকার চাহিদা বৃদ্ধি করা, এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং গোপনীয়তার সংস্কৃতি পরিহার করে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। টিআইবিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সাল থেকেই তথ্য অধিকার দিবস পালন করে আসছে; কিন্তু বাংলাদেশে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না পুরনো কিছু আইনের কারণে। যেমন_দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৯৬০, কার্যপ্রণালি বিধি ১৯৯৬, সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি ১৯৭৯ ইত্যাদি। এত এত আইনের দেয়াল টপকে কোনো তথ্য বের করা ছিল অসম্ভব। তাই অবাধ তথ্য জানার অধিকার আদায়ের জন্য দরকার ছিল স্বতন্ত্র একটি আইনের। ২০০৮ সালে সরকার তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ জারি করে, যা ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ নামে পাস হয়। আইন অনুযায়ী ইতিমধ্যে সরকার তথ্য অধিকার কমিশন গঠন করেছে। বলা হয়ে থাকে, জনগণই ক্ষমতার উৎস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই কথাটি আসলে নির্বাচনী প্রচারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন শেষ তো জনগণের ক্ষমতাও যেন শেষ। তথ্য অধিকার আইনের মধ্য দিয়ে জনগণের কিছুটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাধা আসতে পারে অসাধু সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি সুবিধাভোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। সব বাধা তুচ্ছ করে অবাধ তথ্য প্রদানের মধ্য দিয়েই সত্যিকার অর্থে জনগণ পারবে কর্তৃত্ব খাটাতে। তারা আর তুচ্ছ থাকবে না গণতান্ত্রিক দেশে। এখন কথা হচ্ছে, আমরা কজন জানি, কোথায় কিভাবে এই তথ্য পাওয়া যাবে? তথ্য কমিশনের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করতে হবে। আর এ কাজে গণমাধ্যম ও গণপ্রচারণার আশ্রয় নেওয়া জরুরি। তথ্য কমিশনের অবস্থান ও তথ্য জানার উপায় যদি সবার জানা থাকে, তাহলেই তথ্য কমিশন থেকে জনগণ উপকৃত হবে। অন্যথায় তথ্য কমিশন কোনো কাজেই আসবে না। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের ট্যাঙ্ দিয়ে কমিশনভুক্তরা শুধুই বেতন-ভাতা পাবেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
No comments