আমরা সবটা দেখি না by আল মাহমুদ
লেখকরা নাকি পালিয়েও বাঁচতে পারে না। পালাবে কোথায়? তাদের আবার বিবেকের তাড়না আছে। আমি মাঝে মধ্যে চেষ্টা করি। গা ঢাকা দিই। কিন্তু কীভাবে যেন আমার নিজের গন্ধে মৌমাচির ঝাঁকের মতো অনুসন্ধানকারীরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলে।
আমার একটা গন্ধ আছে। কবিত্বের গন্ধ। এটা যে পথেই চলি ভুরভুর করে বের হতে থাকে। মানুষ বলে : ‘আরে ঐতো কবি’। এটা শুনলে আমি অধোবদন হয়ে থাকি। ধরা পড়ে গেছি। আমি প্রেমে ধরা পড়ি; অপ্রেমেও ধরা পড়ি। আমার কোনো বাঁচোয়া নেই। এখন আর লুকোই না। তবে বিশ্রাম তো নিতে হয়। প্রচণ্ড কলরবের মধ্যেও আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। বরং শীতল নীরবতার মধ্যে আমার নিদ্রা সুদূরপরাহত। আমি নিশ্চয়ই কোনো অদ্ভুত প্রাণী। এমনিতে মানুষের মতো। কিন্তু কবিত্বের কারণে আমি আধা মানুষ আর আধা কল্পনার ফানুস।
লোকে বলে ইনি সৃজনশীল ব্যক্তি। অথচ কেউ বোঝে না যে সৃজনশীলতা হলো একটা দুরারোগ্য ব্যাধি। সৃজনশীল ব্যক্তি শুধু বানিয়ে তুলতে চায়, গড়ে তুলতে চায়। এই ধরনের ব্যক্তি সমাজে উত্পাততুল্য হলেও এদের ছাড়া সমাজ চলে না। চাকা ঘোরে না। সবাই সোজাসুজি তাকায়। কিন্তু বাঁকা চোখের চাহনি না হলে কি বাকপ্রতিভা নির্মিত হয়?
এ পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি সব কিছুই আমাকে সুযোগ সুবিধামত প্রত্যাঘাত দিয়েছে। লিখে আরাম খুঁজতে গেলে অনেক বিপরীত বেরাম এসে হাজির হয়। লিখে কোনো আরাম নেই। না লিখে বিবেকের তাড়নায় পাগলপারা হয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ানোর সাহসও আমার নেই। যা কিছুই হোক লিখেই আমার অন্তর্জ্বালা জুড়াতে চাই। আর যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা আগে লেখাটা চান। তারপর মুখের দিকে তাকান। আমি লিখতে লিখতে নিজের মুখ হারিয়ে ফেলেছি। এখন একটা মুখোশ পড়ে থাকি। লেখকের মুখোশ। একে সৃজনশীল মানুষের মুখোশও বলা যায়। এই মুখোশটি ঘামে শ্রমে বেশ পুরনো হয়ে গেছে। এটা বদলাতে চাই। কিন্তু মানুষের মুখোশ বদলে অন্য কোনো অমানুষের মুখোশ আমার মুখে ঠিকমত বসবে না ভেবে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। অন্যদিকে আমার সাবেক মুখ হয়তো বা অনেকেই ভুলে গেছে। তাহলেও আমি আমার বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া পথের মোড়ে ফেলে যাওয়া পুরনো মুখটি ফিরিয়ে আনতে চাই।
পারছি না। এই জ্বালায় যেখানে-সেখানে মুখ চাই বলে ঘুরে বেড়াই। মুখ একটি দরকার। কিন্তু মাঝে মধ্যে মনে হয় মানুষের মুখ অনেক পুরনো বিষয়। আবার মানুষের মুখের বদলে বাঘের মুখ লাগিয়ে সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করার ইচ্ছেও আমার নেই। এর চেয়ে অনেক ভালো একেবারে মুখটাই বাদ দেয়া। যাকে বলে মেয়েমুখ।
জানি এটা খুব কঠিন কাজ। পৃথিবীতে অনেক বিদ্বান লোক মুখটাকে বাদ দিয়ে নিজের জীবন কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সে কল্পনা কেবল কল্পিত মুখের বিষয়ে নিবন্ধে পরিণত হয়েছে।
এই পৃথিবীতে আত্মপরিচয়ের জন্য মুখ দরকার। কারণ শত শত মানুষ আশপাশে ঘুরে বেড়ালেও কারো মুখই একরকম হয় না। বিচিত্র পার্থক্য রয়েছে বলেই আমরা মানুষকে চিনতে পারি। মানুষকে চিনতে না পারলে কী হয় এ প্রশ্ন উঠতে পারে। উঠেছেও। মানুষকে চিনতে না পারলে একটা অন্ধকারের ভুতুড়ে জগত্ তৈরি হয়। যে অবস্থায়ই হোক চেনার প্রয়োজন আছে। চিনতে হবে। তবে লক্ষণগুলো বর্ণনার সুযোগ রেখে।
আমরা আসলে সব কিছু চিনি না। কারণ সবাইকে এক সঙ্গে অখণ্ডভাবে দেখার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের চোখ তো আর ত্রিমাত্রিক নয়। এক মেয়েকে দেখছি তার সামনের দিকটা। যখন দেখছি তখন তার পেছন দিকটা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। আমরা সবটা দেখি না। না দেখেই আমাদের বিশ্বাস করতে হয় ‘আছে’। কল্পনা করতে হয় আছে, আন্দাজ করতে হয় আছে। এভাবেই না দেখেও আছে বিশ্বাস করার নামই প্রকৃতপক্ষে ‘বিশ্বাস’। এই বিশ্বাসের ওপর সব অদৃশ্য জগত দাঁড়িয়ে আছে। যাকে বলা যায় বিশ্বাসীদের জগত্। এর ব্যতিক্রম ঘটাতে সাধারণত কেউ সাহসী হয় না। আর আমি তো ভীতু লোক। আমার তো প্রশ্নই ওঠে না। এভাবেই কিছুটা দেখে কিছুটা অদৃশ্যে স্থাপন করে আমরা একটি জগত নির্মাণ করেছি। এর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে মানুষের কবিত্বশক্তি। কল্পনার পাহাড়পর্বত। এর কোনো নিয়মশৃঙ্খলা আমরা তৈরি করে দিইনি। যিনি জগত সংসারের সব নিয়মনীতি পরিচালনা করেন সেই অদৃশ্য শক্তি এর নিয়ন্তা। আমরা বিশ্বাস করে বাঁচি। অবিশ্বাস করলে দারুণ যন্ত্রণার জ্বরে কেবল দগ্ধ হতে থাকি। এ জন্যই বিশ্বাসের এত প্রয়োজন। বিশ্বাস না থাকলে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হয়। আর অন্ধকার আমাদের একটি কালো যবনিকা ছাড়া আর কিছু উপহার দিতে পারে না।
লেখকঃ কবি
লোকে বলে ইনি সৃজনশীল ব্যক্তি। অথচ কেউ বোঝে না যে সৃজনশীলতা হলো একটা দুরারোগ্য ব্যাধি। সৃজনশীল ব্যক্তি শুধু বানিয়ে তুলতে চায়, গড়ে তুলতে চায়। এই ধরনের ব্যক্তি সমাজে উত্পাততুল্য হলেও এদের ছাড়া সমাজ চলে না। চাকা ঘোরে না। সবাই সোজাসুজি তাকায়। কিন্তু বাঁকা চোখের চাহনি না হলে কি বাকপ্রতিভা নির্মিত হয়?
এ পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি সব কিছুই আমাকে সুযোগ সুবিধামত প্রত্যাঘাত দিয়েছে। লিখে আরাম খুঁজতে গেলে অনেক বিপরীত বেরাম এসে হাজির হয়। লিখে কোনো আরাম নেই। না লিখে বিবেকের তাড়নায় পাগলপারা হয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ানোর সাহসও আমার নেই। যা কিছুই হোক লিখেই আমার অন্তর্জ্বালা জুড়াতে চাই। আর যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা আগে লেখাটা চান। তারপর মুখের দিকে তাকান। আমি লিখতে লিখতে নিজের মুখ হারিয়ে ফেলেছি। এখন একটা মুখোশ পড়ে থাকি। লেখকের মুখোশ। একে সৃজনশীল মানুষের মুখোশও বলা যায়। এই মুখোশটি ঘামে শ্রমে বেশ পুরনো হয়ে গেছে। এটা বদলাতে চাই। কিন্তু মানুষের মুখোশ বদলে অন্য কোনো অমানুষের মুখোশ আমার মুখে ঠিকমত বসবে না ভেবে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। অন্যদিকে আমার সাবেক মুখ হয়তো বা অনেকেই ভুলে গেছে। তাহলেও আমি আমার বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া পথের মোড়ে ফেলে যাওয়া পুরনো মুখটি ফিরিয়ে আনতে চাই।
পারছি না। এই জ্বালায় যেখানে-সেখানে মুখ চাই বলে ঘুরে বেড়াই। মুখ একটি দরকার। কিন্তু মাঝে মধ্যে মনে হয় মানুষের মুখ অনেক পুরনো বিষয়। আবার মানুষের মুখের বদলে বাঘের মুখ লাগিয়ে সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করার ইচ্ছেও আমার নেই। এর চেয়ে অনেক ভালো একেবারে মুখটাই বাদ দেয়া। যাকে বলে মেয়েমুখ।
জানি এটা খুব কঠিন কাজ। পৃথিবীতে অনেক বিদ্বান লোক মুখটাকে বাদ দিয়ে নিজের জীবন কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সে কল্পনা কেবল কল্পিত মুখের বিষয়ে নিবন্ধে পরিণত হয়েছে।
এই পৃথিবীতে আত্মপরিচয়ের জন্য মুখ দরকার। কারণ শত শত মানুষ আশপাশে ঘুরে বেড়ালেও কারো মুখই একরকম হয় না। বিচিত্র পার্থক্য রয়েছে বলেই আমরা মানুষকে চিনতে পারি। মানুষকে চিনতে না পারলে কী হয় এ প্রশ্ন উঠতে পারে। উঠেছেও। মানুষকে চিনতে না পারলে একটা অন্ধকারের ভুতুড়ে জগত্ তৈরি হয়। যে অবস্থায়ই হোক চেনার প্রয়োজন আছে। চিনতে হবে। তবে লক্ষণগুলো বর্ণনার সুযোগ রেখে।
আমরা আসলে সব কিছু চিনি না। কারণ সবাইকে এক সঙ্গে অখণ্ডভাবে দেখার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের চোখ তো আর ত্রিমাত্রিক নয়। এক মেয়েকে দেখছি তার সামনের দিকটা। যখন দেখছি তখন তার পেছন দিকটা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। আমরা সবটা দেখি না। না দেখেই আমাদের বিশ্বাস করতে হয় ‘আছে’। কল্পনা করতে হয় আছে, আন্দাজ করতে হয় আছে। এভাবেই না দেখেও আছে বিশ্বাস করার নামই প্রকৃতপক্ষে ‘বিশ্বাস’। এই বিশ্বাসের ওপর সব অদৃশ্য জগত দাঁড়িয়ে আছে। যাকে বলা যায় বিশ্বাসীদের জগত্। এর ব্যতিক্রম ঘটাতে সাধারণত কেউ সাহসী হয় না। আর আমি তো ভীতু লোক। আমার তো প্রশ্নই ওঠে না। এভাবেই কিছুটা দেখে কিছুটা অদৃশ্যে স্থাপন করে আমরা একটি জগত নির্মাণ করেছি। এর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে মানুষের কবিত্বশক্তি। কল্পনার পাহাড়পর্বত। এর কোনো নিয়মশৃঙ্খলা আমরা তৈরি করে দিইনি। যিনি জগত সংসারের সব নিয়মনীতি পরিচালনা করেন সেই অদৃশ্য শক্তি এর নিয়ন্তা। আমরা বিশ্বাস করে বাঁচি। অবিশ্বাস করলে দারুণ যন্ত্রণার জ্বরে কেবল দগ্ধ হতে থাকি। এ জন্যই বিশ্বাসের এত প্রয়োজন। বিশ্বাস না থাকলে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হয়। আর অন্ধকার আমাদের একটি কালো যবনিকা ছাড়া আর কিছু উপহার দিতে পারে না।
লেখকঃ কবি
No comments