সংগীত সুশীল চ্যানেল আই by সৈয়দ আবদুল হাদী

সম্রাট আকবর আজ বেশ খোশমেজাজে আছেন। নবরত্নসভার সব গুণী, আমির-ওমরাহ, সভাসদ পরিবেষ্টিত হয়ে রাজকীয় আসনে সমাসীন। নবরত্নের অন্যতম গুণী, সংগীত সুধাকার মিঞা তানসেনের গান শুনবেন তিনি আজ। অনুমতি নিয়ে গান শুরু করলেন মিঞা তানসেন। সংগীতের সুধারসে আপ্লুত, অর্ধনিমীলিত নেত্রে সম্রাট উপভোগ করছেন শিল্পীর জাদুকরী পরিবেশনা। মাঝেমধ্যে 'বাহবা' ধ্বনি উচ্চারণ করছেন, অনুসরণ করছেন সভাসদরাও। গান শেষ হলো।


সম্রাট হাতের লাল গোলাপটি বাড়িয়ে দিলেন মিঞা তানসেনের দিকে, গলার মহামূল্য মুক্তার হারটিও পরিয়ে দিলেন শিল্পীর কণ্ঠে।
সংগীতের মধ্যযুগীয় পৃষ্ঠপোষকতার একটি চিত্র কল্পনা করা যেতে পারে। সে যুগে সংগীত রাজরাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতায়ই লালিত হয়েছে। এ থেকে এটাও বোঝা যায় যে অপেশাদার বা অদক্ষ কারো প্রবেশাধিকার ছিল না এই জগতে। পেশাদারির তথা দক্ষতার সর্বোচ্চ স্তরে না পেঁৗছলে সে যুগে পরিচিতি বা পৃষ্ঠপোষকতা_কোনোটাই লাভ করা সম্ভব ছিল না।
সময়ের বিবর্তনে রাজরাজড়ার স্থানটি অধিকার করেছেন সামন্তপ্রভু আর নব্য ধনিক সম্প্রদায়। ইংরেজ সাহায্যপুষ্ট এই শ্রেণীর হাতেই সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্বটি চলে যায়। সূচনা হয় সংগীতের লঘু বিনোদনের পদযাত্রা। ইংরেজ শাসনামলের শেষ দিকে স্বাধীনতাসংগ্রামের যুগ থেকেই সংগীতের গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। সামন্তপ্রভু আর নব্য ধনী বেনিয়াদের বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে পেঁৗছতে শুরু করে সংগীত। পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যেও সংগীতচর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার রেওয়াজ শুরু হয়, যার পুরোভাগে ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। অন্যদিকে সীমিত গণ্ডিতে হলেও বেতার, গ্রামোফোন ও চলচ্চিত্র সংগীতের গণতন্ত্রায়ণ ও জনপ্রিয়তায় বিরাট ভূমিকা রাখে। তার পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। গণযোগাযোগ মাধ্যমের দ্রুত উন্নয়নের ফলে সংগীতও সর্বসাধারণের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে যায়, সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের দেশে টেলিভিশনের সূচনায় সংগীতের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। বেতারের একচ্ছত্র আধিপত্যের পাশাপাশি টেলিভিশনও সংগীতের জনপ্রিয়তায় এক ধাপ এগিয়ে যায়_গান শুধু শোনার ব্যাপার নয়, দেখারও ব্যাপার হয়ে ওঠে। বস্তুত ছোট পর্দার আগমন সর্বক্ষেত্রেই, বিশেষত সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক ডাইমেনশনের সূচনা করে এবং ধীরে ধীরে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। একটি কেন্দ্রের মাত্র আড়াই ঘণ্টা সম্প্রচার দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু, আর তা আজ পেঁৗছেছে ২৪ ঘণ্টায়, অসংখ্য চ্যানেলে। সাদাকালো থেকে রঙিন, অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল, বোতাম থেকে দূরনিয়ন্ত্রক_নতুন আকৃতি, প্রকৃতি। শনৈঃশনৈ উন্নতির সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে চলাই দুরূহ।
নব্বইয়ের শেষ দিকে আমরা এই প্রাইভেট চ্যানেল জগতে প্রবেশ করে আজ অবাধ তথ্যপ্রবাহ, তথা আকাশ সংস্কৃতির সুফল-কুফল দুটিুংুই ভোগ করছি। ভালো হোক আর মন্দই হোক, 'চ্যানেল' এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের তথ্য ও বিনোদনের অপরিহার্য সঙ্গীর ভূমিকাটি দখল করে নিয়েছে।
বিশ্বজুড়েই টেলিভিশনের পর্দা এখন ব্যবসায়ীদের পণ্য প্রচারের প্রধান মাধ্যম। চ্যানেলগুলোর ২৪ ঘণ্টার ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে খাদ্য-অখাদ্য অনেক কিছুই তাদের গ্রহণ করতে হচ্ছে এবং তা পেঁৗছে যাচ্ছে দর্শক-শ্রোতর গৃহাভ্যন্তরে। পণ্য প্রচারের এমন মোক্ষম সুযোগটি ব্যবসায়ীরা নেবেন না-ই বা কেন এবং তাতে দোষেরও কিছু নেই। তবে অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত, যথেচ্ছ বিজ্ঞাপন সংস্কৃতি যেকোনো ক্ষেত্রে ভ্রান্ত এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ভুল, অনৈতিক ও ক্ষতিকর বার্তা পেঁৗছে দিচ্ছে_এ বিষয়ে বোধ হয় বিজ্ঞাপনদাতা ও প্রচারক_উভয়েই দ্বিমত পোষণ করবেন না। তার পরও এই মণিহার পরতে গেলে লাগে, ছিঁড়তে গেলেও লাগে_এটাই বাস্তবতা। তবে চ্যানেলগুলোর নিজ উদ্যোগেই একটি বিজ্ঞাপন প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। তাদের কাছে নিশ্চয়ই এ অভিযোগ প্রতিনিয়ত আসছে_ অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন, না বিজ্ঞাপনের ফাঁকে অনুষ্ঠান!
যা হোক, অনুষ্ঠানের রুচিশীলতা, নান্দনিকতা ও ওজস্বিতা দিয়ে যে কয়টি চ্যানেল এ যাতনা লাঘব করতে সচেষ্ট, তাদের মধ্যে 'চ্যানেল আই' অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকার দাবিদার। তাদের এক যুগের সম্প্রচার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে স্থূল বিনোদনের সহজ পন্থায় তারা অগ্রসর হয়নি, বরং আমাদের মূলধারার সাংস্কৃতিক নান্দনিকতাকেই লালন করে যাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার প্রকাশ। নতুন মুখ অন্বেষণে প্রতিযোগিতামূলক বেশ কিছু প্রশংসনীয় অনুষ্ঠান প্রচার করছে চ্যানেল আই, যা আমাদের সংগীতজগতে উত্তরসূরি সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিমত রয়েছে_হঠাৎ করেই তারকাখ্যাতির সুউচ্চ শিখরে ঠেলে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে বৈকি। কেননা 'কার্বাইড' দিয়ে পাকানো ফল কখনো সুস্বাস্থ্যের সহায়ক নয়। এ ক্ষেত্রে আর একটু সংযত হলে তা নবীনদের জন্যও স্থায়ী সুফল বয়ে আনবে। 'স্নো বা স্টেডি উইনস দ্য রেস'_এই ইংরেজি প্রবচনটি নবীনদের মনে করিয়ে দিতে হবে।
সংগীতের সব শাখার 'সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড'টি অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। সংগীতের সুপরিসর ক্ষেত্রে এই বিশাল আয়োজনটি অবশ্যই চ্যানেল আইয়ের একটি গর্বিত কার্যক্রম। এখানে প্রাসঙ্গিক না হলেও চ্যানেল আইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান 'মাটি ও মানুষ'-এর কথা উল্লেখ করতেই হয়। কৃষিক্ষেত্র ও দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই অনুষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে_এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
চ্যানেল আইয়ের যুগপূর্তিতে আমার আন্তরিক অভিনন্দন রইল এবং কামনা করছি, তাদের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.