ইসলামোফোবিয়া by ফাহমিদ উর রহমান
পাশ্চাত্যের মিডিয়া, বিদ্বত্সমাজ ও নীতি-নির্ধারকরা এখন নতুন একটি পরিভাষা চালু করেছেন : ইসলামোফোবিয়া (Islamophobia) । বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ইসলাম আতঙ্ক। কমিউনিজমের পতনের পর থেকে এই পরিভাষাটির ব্যবহার শুরু হয় এবং ৯/১১-এর ঘটনার পর থেকে এর ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়।
British Runnymede Trust ইসলাম আতঙ্কের একটি সংজ্ঞা খাড়া করেছে এভাবে : Dread or hatred of Islam and therefore, to the fear and dislike of all Muslims —ইসলামকে ঘৃণা করে বলে মুসলমানকে অপছন্দ করার নীতি।
ভাবতে অবাক লাগে ‘সভ্য’, ‘অসাম্প্রদায়িক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে পরিচিত পশ্চিমা ব্যবস্থার মধ্যে এই বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। পশ্চিমারা দুনিয়াজুড়ে অসাম্প্রদায়িক, ‘সভ্য’ ও ‘প্রগতিশীল’ চেহারা নিয়ে নিজেদের জাহির করে আর মুসলমানরা ‘বর্বর’, ‘অসভ্য’, ‘সন্ত্রাসী’ বলে ক্রমাগত নিন্দিত হয়। তাদের কপালে আজ জুটেছে ‘ইসলামী মৌলবাদ’ নামের কলঙ্ক। পশ্চিমা প্রচার-প্রপাগান্ডা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোনো মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করাই আজ রীতিমত অপরাধের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামমাত্রই ‘সন্ত্রাসী’ ধর্ম, ‘বর্বর’ আর অসভ্যদের বিধান। তাদের নবী তরবারির জোরে এ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছে। অতএব এরা সন্ত্রাসী না হয়ে আর কী হবে!
ইসলাম আতঙ্ক শব্দটি পশ্চিমা মস্তিষ্কপ্রসূত। খ্রিস্টান আতঙ্ক, বৌদ্ধ আতঙ্ক, ইহুদি আতঙ্ক ইত্যাদি পরিভাষা আমরা এ যাবত্ শুনিনি। ভাবটা এমন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই কেবল মানুষ খুন করে, বোমা ফাটায়, সন্ত্রাসী হামলা চালায়। আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা ‘সুশীল’, ‘সভ্য’, বোমা ফাটায় না, সন্ত্রাস করতে জানে না। স্মর্তব্য, পাসপোর্টে নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটা থাকলে পশ্চিমের ইমিগ্রেশন কর্তারা এখন এমনভাবে চোখ তুলে তাকায় যেন এই বোধহয় কোনো সন্ত্রাসী তার ওপর বোমা নিয়ে হামলে পড়বে। ইউরোপে এক সময় Anti-Semitism-এর মতো বর্ণবাদী ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছিল। পশ্চিমের সেই বর্ণবাদী মানসিকতা আজ Islamophobia-র রূপ নিয়েছে।
ইসলামোফোবিয়া শব্দটি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামকে একটি দানবীয় শক্তি হিসেবে হাজির করা। পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলামকে এভাবে হাজির করার পেছনে কারণ হচ্ছে ইসলামের মতাদর্শিক শক্তি এবং ইসলামপ্রধান দেশগুলোর প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষত তেলের ওপর ভাগ বসানো।
মতাদর্শিকভাবে ইসলাম পশ্চিমের করপোরেট ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি, ভোগবাদ, আত্মস্বার্থপরতা, লাভ ও লোভকে চূড়ান্ত বিবেচনা করার চিন্তাভাবনাকে আদৌ সমর্থন করে না। এই কারণেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ একদিকে তেলের ওপর দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য সাময়িকভাবে সব সময় প্রস্তুত, তেমনি তাদের মিডিয়াও সমান তত্পর, যাতে প্রমাণ করা যায়, ইসলাম একটা দানবীয় ধর্ম এবং মুসলমানমাত্রই সন্ত্রাসী। তাহলে মুসলমান দেশগুলোর ওপর দখলদারী কায়েম করা সহজ হয়। কারণ কাউকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘বর্বর’ প্রমাণ করা গেলে তাদের দেশ দখল করে নেয়া, তাদের ওপর সবরকমের জুলুম ও বেইনসাফিকে বৈধ প্রমাণ করা সহজ হয়। মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর প্রতি এই হচ্ছে সাধারণ নীতি ও বিবেচনা। সেই প্রেক্ষিতেই আজকে ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও সামরিক—প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য হামলা ও পশ্চিমা প্রচার-প্রপাগান্ডাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
মার্কিন লেখক Stephen Schwartz-এর মতে, ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে : ... the condemnation of the entirety of Islam and its history as extremist —সমগ্র ইসলাম ও তার ইতিহাসকে ঘৃণা করার নীতি। শোয়ার্টজের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে এ হচ্ছে নিরেট মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ, যা কিনা পশ্চিমের Anti-Semitism, Xenophobia, Racism, Intolerance প্রভৃতি পরিভাষার সমার্থক। অন্যথায় একটি সভ্যতার ইতিহাসকে রাতারাতি ‘জঙ্গি’, ‘বর্বর’ বানিয়ে দেয়া কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। ইংরেজি Phobia শব্দটার বাংলা হচ্ছে অহেতুক, অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক রকমের ভীতি। এ ধরনের ভীতি অনেক সময় অসুস্থতার পরিচায়ক। যেমন Hydrophobia (জলাতঙ্ক), Zoophobia (পশুভীতি), Social phobia (সামাজিক ভীতি)। পুরো পশ্চিমা সভ্যতা কি আজ ইসলামকে নিয়ে সেরকম কোনো অসুস্থায় ভুগছে? তারই নাম কি ইসলামোফোবিয়া? অথবা ইসলাম কি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি বা জন্তু-জানোয়ারের মতো কোনো একাট্টা জিনিস, যাকে ভয় পেতে হবে?
মানবেতিহাসে ইসলামের অবদান একটা বৈপ্লবিক ঘটনা। সাম্য, মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের যুগান্তকারী অবদান ইতিহাস থেকে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। বিপ্লবী ভাবুক এমএন রায় একবার লিখেছিলেন, ইসলামের বিদ্রোহ মানবতাকে রক্ষা করেছে। সেই ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে আজকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের কেজো যুক্তির শেষ নেই।
ইসলাম আতঙ্ক কেন আজ পশ্চিমাদের তাড়া করে ফিরছে সেখানকার পণ্ডিতরা তার একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন। অরুচিকর ঠেকলেও সেগুলোর উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
১. ইসলাম হচ্ছে একমার্গী (monolithic) ধর্ম, যা কিনা নিশ্চল ও পরিবর্তনবিমুখ।
২. এই ধর্ম অন্যের মূল্যবোধের সঙ্গে শরিক হতে চায় না। এটা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, অন্যকেও প্রভাবিত করে না।
৩. পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় ইসলাম অনেক নিচুস্তরের। এই ধর্মাবলম্বীরা বর্বর, যুক্তিহীন, আদিম ও যৌনতাড়িত।
৪. ইসলাম প্রকৃতিগতভাবে উত্তেজিত, মারমুখী, হুমকিস্বরূপ, সন্ত্রাসের সমর্থক, সভ্যতার সংঘাতের জন্য দায়ী।
৫. এটি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা কিনা রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
৬. মুসলিম কর্তৃক পশ্চিমের কোনো সমালোচনাকে সহজে গ্রহণ করা হয় না।
৭. ইসলামের প্রতি শত্রুতাকে, মুসলমানের প্রতি বৈষম্য ও মূলধারা থেকে মুসলমানদের অপসারণের পক্ষে যৌক্তিক কারণ হিসেবে দেখানো হয়।
৮. মুসলমানদের প্রতি শত্রুতাকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইসলামের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের উত্তর অনেকেই বিভিন্নভাবে দিয়েছেন; কিন্তু অজ্ঞানতা, অযৌক্তিকতা, ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা, লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র কি কখনও যুক্তিসঙ্গত বিচার-বিবেচনার প্রশ্রয় দেয়? সুতরাং পশ্চিমের বিবেচনায় এই ইসলামকে ঘৃণা করতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে, প্রয়োজনে শক্তির জোরে ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
এই ইসলাম আতঙ্কের ব্যাপারটা এত রগরগে হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের। যে কোনো যুদ্ধাবস্থার মতো তারাই ইসলামের চরিত্র হননে সবার আগে হাজির থাকে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী করপোরেট ব্যবস্থার স্বার্থ হাসিল করাই এই মিডিয়ার কাজ। মিডিয়াই ইসলামকে অবিরত ‘জঙ্গি’, ‘বর্বর’ হিসেবে চিত্রিত করছে এবং Islamic Terrorism, Islamic Bomb, Violent Islam প্রভৃতি পরিভাষার নিপুণ ব্যবহার করে ইসলামের একটি নেতিবাচক ইমেজ খাড়া করেছে।
অনেকের ধারণা, সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেসের প্রতিবাদে ব্রিটিশ মুসলমানদের ভূমিকা এবং ৯/১১-এর ঘটনা ইসলাম আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, পাশ্চাত্যে বেশি বেশিসংখ্যক মুসলমানের উপস্থিতিও ইসলাম আতঙ্কের স্ফীতি ঘটিয়েছে। যে কারণই হোক না কেন, পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় মানসিকতার কাছে ইসলাম কখনোই সমাদর পায়নি। ক্রুসেডের জামানা থেকেই পশ্চিমাদের ইসলামবিদ্বেষ গোপন কিছু বিষয় নয়। শুধু অবস্থা বৈগুণ্যে এই বর্ণবাদী চরিত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ নিয়েছে মাত্র। তথাকথিত সেক্যুলার পশ্চিমের আচরণ ইসলামের ক্ষেত্রে রাতারাতি কম্যুনাল হয়ে যায়। ইসলামোফোবিয়ার কারণে সামাজিকভাবে পাশ্চাত্যের মুসলমানদের আজ নানাভাবে নিগ্রহ ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। পুরো পশ্চিমা জগতে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ ও ভয়ভীতির মতো ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে এবং তাদের সংস্কৃতিকে অনবরত কটূক্তি করা হচ্ছে। যেমন : পশ্চিমা দেশগুলোতে পর্দানশীন মেয়েদের অনেক সময় হিজাব টেনে খুলে ফেলা হয়, মুসলমানদের লাদেন হিসেবে ডাকা হয়। এমনকি তাদের দিকে থুথু নিক্ষেপ করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্রান্সে সেক্যুলারিজমের কথা বলে আইন করে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ডেনমার্কের পত্রিকা ঞুষষধহফং চধংঃবহ রাসূলকে (সা.) ব্যঙ্গোক্তি করে কার্টুন প্রকাশ করেছে!
ইসলামোফোবিয়ার সাম্প্রতিক নমুনা হচ্ছে নিরপেক্ষ বলে পরিচিত সুইজারল্যান্ডের মানুষ রীতিমত গণভোট দিয়ে মসজিদের মিনার নির্মাণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কোনো সন্দেহ নেই, এটা মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত; কিন্তু রাষ্ট্রের সহযোগিতায় গণভোট দিয়ে মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা প্রমাণ করেছে ইউরোপীয় সমাজ ও সভ্যতা এমনকি রাষ্ট্রের সেক্যুলার হওয়ার দাবি কতখানি হাস্যকর। এটা আর যাই হোক, সেখানকার বিঘোষিত ধর্মীয় স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বের দাবির কোনো প্রমাণ হতে পারে না। এটা স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতি মুসলমানদের প্রতি কতখানি বৈষম্যমূলক। তাদের সেখানকার স্রেফ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই মনে করা হয়।
Islamophobia’র মতো পশ্চিমের বিদ্বত্সমাজ Islamo Fascism নামে আরেকটি শব্দ ইদানীং চালু করেছেন। Stephen Schwartz, Christopher Hitchens, Malise Ruthven প্রমুখ লেখক তাদের লেখায় এ শব্দটা অহরহ ব্যবহার করেন। বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নায়করা প্রচার-প্রপাগান্ডার উদ্দেশ্যে এই শব্দটা চালু করতে বেশি আগ্রহী হন। ইসলামকে ফ্যাসিবাদী আদর্শের সঙ্গে তুলনা করার পেছনে পশ্চিমের উদ্দেশ্য হলো এর বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার বৈধতা প্রতিপন্ন করা।
এই হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা আর তার মানবাধিকার বিষয়ক বিচার-বিবেচনা। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে যথার্থ বলেছেন, এটি হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার ঐতিহ্যের অংশ : Secret sharer in more general, antisemitic, western tradition.
আজকের বিশ্বব্যবস্থা যেহেতু ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, তাই সঙ্গত কারণেই ইসলাম আতঙ্ক শুধু পশ্চিমের খ্রিস্টীয় সমাজে সীমিত নেই। এই বর্ণবাদ আজ অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও প্রভাবিত করছে। ভারতে বিখ্যাত সাচার কমিটি দেখিয়ে দিয়েছে সেখানকার মুসলমানরা কিরকম ভয়াবহ অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। শুধু তাই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যেখানে প্রগতিশীল বলে পরিচিত বামপন্থীরা গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে শাসন করছে সেখানকার মুসলমানদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও চাকরি-বাকরিতে তাদের অবস্থান মাত্র ৩ শতাংশ।
সমাজতান্ত্রিক চীনে উইঘুর মুসলমানদের অবস্থাও তথৈবচ। তারা আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ হান চীনাদের জুলুমবাজির শিকার। তাদের ধর্মীয় আজ্ঞা পালনে বিভিন্ন সময় বাধা দেয়া হয়। হজ ও রোজা পালনকে নিরুত্সাহিত করা হয়। কোরআনের ওপর সেন্সর আরোপ করার চেষ্টা করা হয়। মোটকথা, সেখানকার কমিউনিস্ট প্রশাসন আজ সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে মুসলমানবিরোধী অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যাতে দুনিয়ার মানুষের চোখে ধুলো দেয়া যায়।
উল্লেখ্য, ইসলামোফোবিয়া আজ শুধু অমুসলিমদের ব্যাপার নয়, ইসলামের প্রতি এই ঘৃণা মুসলিম সমাজের ভেতরকার সেই অংশের মধ্যেও আছে, যারা কিনা ইসলাম ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমা ব্যবস্থাকে উত্কৃষ্ট বিবেচনায় আপন করে নিয়েছে। এরাই মুসলিম সমাজে কমবেশি সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বলে পরিচিত।
ইসলামোফোবিয়া নামের আধুনিক বর্ণবাদ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অবধারিত পরিণাম। এটা আজকের বিশ্বব্যবস্থা কর্তৃক ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপিত একটা ঘটনা। সুতরাং এই বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং একে অসম্ভব করে তোলাই হচ্ছে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় জরুরি কাজ। আজকে ইসলামপ্রধান ভূখণ্ডগুলো সারা দুনিয়ার মজলুম জনগণের প্রতীক হয়ে ওঠেছে এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের আন্তর্জাতিক ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর পক্ষে না দাঁড়ালে একালে কেউ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই করার দাবি করতে পারবে না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা সেই ক্ষেত্রে অন্তঃসারশূন্য বিমূর্ত কথাবার্তায় পর্যবসিত হবে। অনেক ইসলামবাদী নেতা, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী বলে থাকেন বহুত্ববাদী বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকতে হলে মুসলমানদের আজ ইসলামোফোবিয়ার কারণ দূর করতে হবে। একথা তারা সজ্ঞানে না অজ্ঞানে বলেন জানি না, তবে এর মাধ্যমে পুরো মুসলিম সমাজকেই যেন ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ছকের মধ্যে নিয়ে আসার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ইসলামোফোবিয়া নামের বর্ণবাদ মুসলিম সমাজের কোনো সমস্যা নয়। সব ধরনের বর্ণবাদ, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ আজ তার হীনউদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলামকে ‘বর্বর’, ‘জঙ্গি’ ধর্ম হিসেবে প্রচার করে। তার শরীরে ইসলামোফোবিয়ার লেবেল সেঁটে দেয়। এই কলঙ্ক মোচনের দায় মুসলমানরা নেবে কেন? এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে—এই কলঙ্কলেপনকারী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। একই সঙ্গে আমাদের ভেতরকার সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী শ্রেণীগুলো বিনাশের জন্য লড়াই করা। মনে রাখতে হবে, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই কখনও শেষ হয় না, যতক্ষণ না সাম্রাজ্যবাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলা যায়।
ভাবতে অবাক লাগে ‘সভ্য’, ‘অসাম্প্রদায়িক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে পরিচিত পশ্চিমা ব্যবস্থার মধ্যে এই বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। পশ্চিমারা দুনিয়াজুড়ে অসাম্প্রদায়িক, ‘সভ্য’ ও ‘প্রগতিশীল’ চেহারা নিয়ে নিজেদের জাহির করে আর মুসলমানরা ‘বর্বর’, ‘অসভ্য’, ‘সন্ত্রাসী’ বলে ক্রমাগত নিন্দিত হয়। তাদের কপালে আজ জুটেছে ‘ইসলামী মৌলবাদ’ নামের কলঙ্ক। পশ্চিমা প্রচার-প্রপাগান্ডা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোনো মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করাই আজ রীতিমত অপরাধের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামমাত্রই ‘সন্ত্রাসী’ ধর্ম, ‘বর্বর’ আর অসভ্যদের বিধান। তাদের নবী তরবারির জোরে এ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছে। অতএব এরা সন্ত্রাসী না হয়ে আর কী হবে!
ইসলাম আতঙ্ক শব্দটি পশ্চিমা মস্তিষ্কপ্রসূত। খ্রিস্টান আতঙ্ক, বৌদ্ধ আতঙ্ক, ইহুদি আতঙ্ক ইত্যাদি পরিভাষা আমরা এ যাবত্ শুনিনি। ভাবটা এমন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই কেবল মানুষ খুন করে, বোমা ফাটায়, সন্ত্রাসী হামলা চালায়। আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা ‘সুশীল’, ‘সভ্য’, বোমা ফাটায় না, সন্ত্রাস করতে জানে না। স্মর্তব্য, পাসপোর্টে নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটা থাকলে পশ্চিমের ইমিগ্রেশন কর্তারা এখন এমনভাবে চোখ তুলে তাকায় যেন এই বোধহয় কোনো সন্ত্রাসী তার ওপর বোমা নিয়ে হামলে পড়বে। ইউরোপে এক সময় Anti-Semitism-এর মতো বর্ণবাদী ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছিল। পশ্চিমের সেই বর্ণবাদী মানসিকতা আজ Islamophobia-র রূপ নিয়েছে।
ইসলামোফোবিয়া শব্দটি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামকে একটি দানবীয় শক্তি হিসেবে হাজির করা। পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলামকে এভাবে হাজির করার পেছনে কারণ হচ্ছে ইসলামের মতাদর্শিক শক্তি এবং ইসলামপ্রধান দেশগুলোর প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষত তেলের ওপর ভাগ বসানো।
মতাদর্শিকভাবে ইসলাম পশ্চিমের করপোরেট ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি, ভোগবাদ, আত্মস্বার্থপরতা, লাভ ও লোভকে চূড়ান্ত বিবেচনা করার চিন্তাভাবনাকে আদৌ সমর্থন করে না। এই কারণেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ একদিকে তেলের ওপর দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য সাময়িকভাবে সব সময় প্রস্তুত, তেমনি তাদের মিডিয়াও সমান তত্পর, যাতে প্রমাণ করা যায়, ইসলাম একটা দানবীয় ধর্ম এবং মুসলমানমাত্রই সন্ত্রাসী। তাহলে মুসলমান দেশগুলোর ওপর দখলদারী কায়েম করা সহজ হয়। কারণ কাউকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘বর্বর’ প্রমাণ করা গেলে তাদের দেশ দখল করে নেয়া, তাদের ওপর সবরকমের জুলুম ও বেইনসাফিকে বৈধ প্রমাণ করা সহজ হয়। মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর প্রতি এই হচ্ছে সাধারণ নীতি ও বিবেচনা। সেই প্রেক্ষিতেই আজকে ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও সামরিক—প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য হামলা ও পশ্চিমা প্রচার-প্রপাগান্ডাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
মার্কিন লেখক Stephen Schwartz-এর মতে, ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে : ... the condemnation of the entirety of Islam and its history as extremist —সমগ্র ইসলাম ও তার ইতিহাসকে ঘৃণা করার নীতি। শোয়ার্টজের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে এ হচ্ছে নিরেট মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ, যা কিনা পশ্চিমের Anti-Semitism, Xenophobia, Racism, Intolerance প্রভৃতি পরিভাষার সমার্থক। অন্যথায় একটি সভ্যতার ইতিহাসকে রাতারাতি ‘জঙ্গি’, ‘বর্বর’ বানিয়ে দেয়া কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। ইংরেজি Phobia শব্দটার বাংলা হচ্ছে অহেতুক, অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক রকমের ভীতি। এ ধরনের ভীতি অনেক সময় অসুস্থতার পরিচায়ক। যেমন Hydrophobia (জলাতঙ্ক), Zoophobia (পশুভীতি), Social phobia (সামাজিক ভীতি)। পুরো পশ্চিমা সভ্যতা কি আজ ইসলামকে নিয়ে সেরকম কোনো অসুস্থায় ভুগছে? তারই নাম কি ইসলামোফোবিয়া? অথবা ইসলাম কি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি বা জন্তু-জানোয়ারের মতো কোনো একাট্টা জিনিস, যাকে ভয় পেতে হবে?
মানবেতিহাসে ইসলামের অবদান একটা বৈপ্লবিক ঘটনা। সাম্য, মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের যুগান্তকারী অবদান ইতিহাস থেকে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। বিপ্লবী ভাবুক এমএন রায় একবার লিখেছিলেন, ইসলামের বিদ্রোহ মানবতাকে রক্ষা করেছে। সেই ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে আজকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের কেজো যুক্তির শেষ নেই।
ইসলাম আতঙ্ক কেন আজ পশ্চিমাদের তাড়া করে ফিরছে সেখানকার পণ্ডিতরা তার একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন। অরুচিকর ঠেকলেও সেগুলোর উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
১. ইসলাম হচ্ছে একমার্গী (monolithic) ধর্ম, যা কিনা নিশ্চল ও পরিবর্তনবিমুখ।
২. এই ধর্ম অন্যের মূল্যবোধের সঙ্গে শরিক হতে চায় না। এটা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, অন্যকেও প্রভাবিত করে না।
৩. পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় ইসলাম অনেক নিচুস্তরের। এই ধর্মাবলম্বীরা বর্বর, যুক্তিহীন, আদিম ও যৌনতাড়িত।
৪. ইসলাম প্রকৃতিগতভাবে উত্তেজিত, মারমুখী, হুমকিস্বরূপ, সন্ত্রাসের সমর্থক, সভ্যতার সংঘাতের জন্য দায়ী।
৫. এটি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা কিনা রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
৬. মুসলিম কর্তৃক পশ্চিমের কোনো সমালোচনাকে সহজে গ্রহণ করা হয় না।
৭. ইসলামের প্রতি শত্রুতাকে, মুসলমানের প্রতি বৈষম্য ও মূলধারা থেকে মুসলমানদের অপসারণের পক্ষে যৌক্তিক কারণ হিসেবে দেখানো হয়।
৮. মুসলমানদের প্রতি শত্রুতাকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইসলামের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের উত্তর অনেকেই বিভিন্নভাবে দিয়েছেন; কিন্তু অজ্ঞানতা, অযৌক্তিকতা, ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা, লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র কি কখনও যুক্তিসঙ্গত বিচার-বিবেচনার প্রশ্রয় দেয়? সুতরাং পশ্চিমের বিবেচনায় এই ইসলামকে ঘৃণা করতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে, প্রয়োজনে শক্তির জোরে ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
এই ইসলাম আতঙ্কের ব্যাপারটা এত রগরগে হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের। যে কোনো যুদ্ধাবস্থার মতো তারাই ইসলামের চরিত্র হননে সবার আগে হাজির থাকে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী করপোরেট ব্যবস্থার স্বার্থ হাসিল করাই এই মিডিয়ার কাজ। মিডিয়াই ইসলামকে অবিরত ‘জঙ্গি’, ‘বর্বর’ হিসেবে চিত্রিত করছে এবং Islamic Terrorism, Islamic Bomb, Violent Islam প্রভৃতি পরিভাষার নিপুণ ব্যবহার করে ইসলামের একটি নেতিবাচক ইমেজ খাড়া করেছে।
অনেকের ধারণা, সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেসের প্রতিবাদে ব্রিটিশ মুসলমানদের ভূমিকা এবং ৯/১১-এর ঘটনা ইসলাম আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, পাশ্চাত্যে বেশি বেশিসংখ্যক মুসলমানের উপস্থিতিও ইসলাম আতঙ্কের স্ফীতি ঘটিয়েছে। যে কারণই হোক না কেন, পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় মানসিকতার কাছে ইসলাম কখনোই সমাদর পায়নি। ক্রুসেডের জামানা থেকেই পশ্চিমাদের ইসলামবিদ্বেষ গোপন কিছু বিষয় নয়। শুধু অবস্থা বৈগুণ্যে এই বর্ণবাদী চরিত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ নিয়েছে মাত্র। তথাকথিত সেক্যুলার পশ্চিমের আচরণ ইসলামের ক্ষেত্রে রাতারাতি কম্যুনাল হয়ে যায়। ইসলামোফোবিয়ার কারণে সামাজিকভাবে পাশ্চাত্যের মুসলমানদের আজ নানাভাবে নিগ্রহ ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। পুরো পশ্চিমা জগতে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ ও ভয়ভীতির মতো ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে এবং তাদের সংস্কৃতিকে অনবরত কটূক্তি করা হচ্ছে। যেমন : পশ্চিমা দেশগুলোতে পর্দানশীন মেয়েদের অনেক সময় হিজাব টেনে খুলে ফেলা হয়, মুসলমানদের লাদেন হিসেবে ডাকা হয়। এমনকি তাদের দিকে থুথু নিক্ষেপ করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফ্রান্সে সেক্যুলারিজমের কথা বলে আইন করে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ডেনমার্কের পত্রিকা ঞুষষধহফং চধংঃবহ রাসূলকে (সা.) ব্যঙ্গোক্তি করে কার্টুন প্রকাশ করেছে!
ইসলামোফোবিয়ার সাম্প্রতিক নমুনা হচ্ছে নিরপেক্ষ বলে পরিচিত সুইজারল্যান্ডের মানুষ রীতিমত গণভোট দিয়ে মসজিদের মিনার নির্মাণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কোনো সন্দেহ নেই, এটা মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত; কিন্তু রাষ্ট্রের সহযোগিতায় গণভোট দিয়ে মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা প্রমাণ করেছে ইউরোপীয় সমাজ ও সভ্যতা এমনকি রাষ্ট্রের সেক্যুলার হওয়ার দাবি কতখানি হাস্যকর। এটা আর যাই হোক, সেখানকার বিঘোষিত ধর্মীয় স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বের দাবির কোনো প্রমাণ হতে পারে না। এটা স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতি মুসলমানদের প্রতি কতখানি বৈষম্যমূলক। তাদের সেখানকার স্রেফ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই মনে করা হয়।
Islamophobia’র মতো পশ্চিমের বিদ্বত্সমাজ Islamo Fascism নামে আরেকটি শব্দ ইদানীং চালু করেছেন। Stephen Schwartz, Christopher Hitchens, Malise Ruthven প্রমুখ লেখক তাদের লেখায় এ শব্দটা অহরহ ব্যবহার করেন। বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নায়করা প্রচার-প্রপাগান্ডার উদ্দেশ্যে এই শব্দটা চালু করতে বেশি আগ্রহী হন। ইসলামকে ফ্যাসিবাদী আদর্শের সঙ্গে তুলনা করার পেছনে পশ্চিমের উদ্দেশ্য হলো এর বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার বৈধতা প্রতিপন্ন করা।
এই হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা আর তার মানবাধিকার বিষয়ক বিচার-বিবেচনা। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে যথার্থ বলেছেন, এটি হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার ঐতিহ্যের অংশ : Secret sharer in more general, antisemitic, western tradition.
আজকের বিশ্বব্যবস্থা যেহেতু ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, তাই সঙ্গত কারণেই ইসলাম আতঙ্ক শুধু পশ্চিমের খ্রিস্টীয় সমাজে সীমিত নেই। এই বর্ণবাদ আজ অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও প্রভাবিত করছে। ভারতে বিখ্যাত সাচার কমিটি দেখিয়ে দিয়েছে সেখানকার মুসলমানরা কিরকম ভয়াবহ অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। শুধু তাই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যেখানে প্রগতিশীল বলে পরিচিত বামপন্থীরা গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে শাসন করছে সেখানকার মুসলমানদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও চাকরি-বাকরিতে তাদের অবস্থান মাত্র ৩ শতাংশ।
সমাজতান্ত্রিক চীনে উইঘুর মুসলমানদের অবস্থাও তথৈবচ। তারা আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ হান চীনাদের জুলুমবাজির শিকার। তাদের ধর্মীয় আজ্ঞা পালনে বিভিন্ন সময় বাধা দেয়া হয়। হজ ও রোজা পালনকে নিরুত্সাহিত করা হয়। কোরআনের ওপর সেন্সর আরোপ করার চেষ্টা করা হয়। মোটকথা, সেখানকার কমিউনিস্ট প্রশাসন আজ সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে মুসলমানবিরোধী অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যাতে দুনিয়ার মানুষের চোখে ধুলো দেয়া যায়।
উল্লেখ্য, ইসলামোফোবিয়া আজ শুধু অমুসলিমদের ব্যাপার নয়, ইসলামের প্রতি এই ঘৃণা মুসলিম সমাজের ভেতরকার সেই অংশের মধ্যেও আছে, যারা কিনা ইসলাম ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমা ব্যবস্থাকে উত্কৃষ্ট বিবেচনায় আপন করে নিয়েছে। এরাই মুসলিম সমাজে কমবেশি সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বলে পরিচিত।
ইসলামোফোবিয়া নামের আধুনিক বর্ণবাদ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অবধারিত পরিণাম। এটা আজকের বিশ্বব্যবস্থা কর্তৃক ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপিত একটা ঘটনা। সুতরাং এই বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং একে অসম্ভব করে তোলাই হচ্ছে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় জরুরি কাজ। আজকে ইসলামপ্রধান ভূখণ্ডগুলো সারা দুনিয়ার মজলুম জনগণের প্রতীক হয়ে ওঠেছে এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের আন্তর্জাতিক ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, ইসলাম ও ইসলামপ্রধান জনগোষ্ঠীর পক্ষে না দাঁড়ালে একালে কেউ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই করার দাবি করতে পারবে না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা সেই ক্ষেত্রে অন্তঃসারশূন্য বিমূর্ত কথাবার্তায় পর্যবসিত হবে। অনেক ইসলামবাদী নেতা, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী বলে থাকেন বহুত্ববাদী বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকতে হলে মুসলমানদের আজ ইসলামোফোবিয়ার কারণ দূর করতে হবে। একথা তারা সজ্ঞানে না অজ্ঞানে বলেন জানি না, তবে এর মাধ্যমে পুরো মুসলিম সমাজকেই যেন ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ছকের মধ্যে নিয়ে আসার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ইসলামোফোবিয়া নামের বর্ণবাদ মুসলিম সমাজের কোনো সমস্যা নয়। সব ধরনের বর্ণবাদ, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ আজ তার হীনউদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলামকে ‘বর্বর’, ‘জঙ্গি’ ধর্ম হিসেবে প্রচার করে। তার শরীরে ইসলামোফোবিয়ার লেবেল সেঁটে দেয়। এই কলঙ্ক মোচনের দায় মুসলমানরা নেবে কেন? এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে—এই কলঙ্কলেপনকারী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। একই সঙ্গে আমাদের ভেতরকার সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী শ্রেণীগুলো বিনাশের জন্য লড়াই করা। মনে রাখতে হবে, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই কখনও শেষ হয় না, যতক্ষণ না সাম্রাজ্যবাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলা যায়।
No comments