পরবর্তী শীর্ষ বৈঠকটি কবে?-মনমোহনের সফর by আশফাকুর রহমান
চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অনেকবার খেয়াল করেছি, ঢাকাসহ বাংলাদেশের নানা স্থানে সংঘটিত অনেক ঘটনা বেইজিং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাদের দূতাবাসেরও আগে পেঁৗছে যেত। চীনের হয়ে ঢাকায় যারা দায়িত্ব পালন করতেন, এটা অবশ্যই তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনার পর তারা প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে চেয়ে আমাদের দূতাবাসে যোগাযোগ করে।
মাস চারেক আগে চীনের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফর করে গেছেন এবং সে সময়ে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র শত শত বোমা ফাটার ঘটনায় দেশটি কোন পথে চলেছে, সে বিষয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল স্বাভাবিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তার ঢাকা আসার কেবল আগের দিন তিনি নিশ্চিত হলেন যে বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফরসঙ্গী তো হচ্ছেনই না, এমনকি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতেও তার ঘোরতর আপত্তি। হঠাৎ করে এমনটি ঘটেছে বলে মনে করার কারণ নেই। প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই ছিল। সেটা কি আমাদের দিলি্ল হাইকমিশন অফিস থেকে জানানো হয়েছিল? পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন অফিস রয়েছে। সে শহরের রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নতুন কর্ত্রীর ধ্যান-ধারণা ও মেজাজ সম্পর্কে কি কোনো বার্তা যথাসময়ে ঢাকা এসেছিল? ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ বৈঠক-পরবর্তী পর্যালোচনায় এ বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের দাবি রাখে। আগেভাগে এ খবর পেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো সফর নিয়ে ভিন্ন ভাবনা করতে পারতেন।
ভারত তিস্তা প্রশ্নে তার অবস্থান থেকে অ্যাবাউট টার্ন করেছে, বাংলাদেশও পাল্টা হিসেবে ট্রানজিট চুক্তি সই না করে সাহসের পরিচয় দিয়েছে_ অনেকে এ ধরনের সরল ব্যাখ্যা দিতে চান। এতে কোনো সন্দেহ নেই এক যুগ পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় সফর কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারেনি। আমি সফরকে ব্যর্থ বলব না, তবে উভয় পক্ষের হতাশা যে চরমে তাতে সন্দেহ নেই। এর মধ্যেও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা কূটনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত সবাইকেই চমকিত না করে পারে না। প্রথমেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা বলি। তার দিলি্ল সফরের ২০ মাস পর অনুষ্ঠিত ফিরতি সফরে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল ঢাকা ও দিলি্লতে। এটা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করাও হতে থাকে। কিন্তু অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু তিনি ছিলেন শান্ত ও ধীর-স্থির। তার পররাষ্ট্র বিষয়ে একাধিক উপদেষ্টা রয়েছে। কিন্তু তারা আগে যে ধারণা দিয়েছিলেন, গণমাধ্যমে যে আশাবাদ বারবার তারা ব্যক্ত করেছিলেন তার সঙ্গে শেষ মুহূর্তের বাস্তবতার মিল সামান্যই দেখা গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখেই শীর্ষ বৈঠকের পুরো আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। নিশ্চিতভাবে সার্বিক পরিস্থিতি তাকেও ব্যথিত, এমনকি হতাশও করে থাকবে। তবে তার প্রকাশ ঘটাতে দেননি। কূটনীতির ভাষায় বলা চলে_ হ্যান্ডেলড দ্য সিচুয়েশন ওয়েল। মনমোহন সিং অর্থনীতিতে দ্রুত বিশ্বের পরাশক্তি হয়ে উঠতে চলার দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্ক যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে, সেটা বুঝতে তার সমস্যা হয়নি। এ কারণে প্রথম সুযোগেই ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনদের সমাবেশে তিনি বলে দিলেন : 'তিস্তা চুক্তি না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।' এজন্য বাংলাদেশের কোনো দায় নেই, বরং সমস্যাটির উদ্ভব যে ভারতে সে বার্তাও তিনি দিয়ে গেলেন। এ থেকে কিন্তু আমাদের নেতৃত্বও কিছু শিক্ষা নিতে পারেন। সৌজন্যের মাত্রা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রনেতাদের জন্যও কিন্তু একটি সুন্দর বার্তা তিনি রেখে গেলেন। আমরা একে প্রকৃতই বলতে পারি 'মনমোহনীয়'।
মনমোহন সিংয়ের ঢাকা ত্যাগ করার আগেই দুই দেশ যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে তাতে স্পষ্ট করেই বলে দেওয়া হয়েছে যে পানি বণ্টন হবে 'ফেয়ার অ্যান্ড ইক্যুইটেবল বেসিসে'। এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অধিকর্তার অঙ্গীকার। তাদের বিভিন্ন রাজ্য কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো দফতরকে এ বিষয়ে ঐকমত্যে আনার দায় সম্পূর্ণই তাদের। এখন আর চুক্তি সম্পাদনে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। দুই দেশের পানিসম্পদ দফতরের মন্ত্রী এ কাজটি করতে পারেন। এ সংক্রান্ত বৈঠকটি ঢাকা বা দিলি্লতে হতে পারে। মূল বিষয় হচ্ছে যৌথ বিবৃতি অনুসরণ করে চলা। কোনো রাজ্যের (প্রকৃতপক্ষে মমতা ব্যানার্জির) আপত্তির মুখে ভারতের এ অবস্থান থেকে সরে আসার অবকাশ নেই। এ কাজটি যতদিন ঝুলে থাকবে, দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বাড়বে। আমি এখনই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিলি্ল যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সেটা সঙ্গতও হবে না। এর পটভূমি নতুন করে তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। যৌথ নদী কমিশন, সীমান্ত সংক্রান্ত কমিটি, ট্রানজিট কমিটি, বাণিজ্য কমিটি প্রভৃতি যেসব ফোরাম রয়েছে সেগুলো এখন পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়ে তা সৃষ্টি করতে পারে। মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও আমাদের আলোচনা চলতে পারে। বাংলাদেশ কেবল দিলি্লর সঙ্গে কথা বলবে, এমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সব সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। মনমোহন সিং বাংলাদেশের চার প্রতিবেশী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গী করে এনেছিলেন। পঞ্চমাকে আনার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তবে বাংলাদেশের প্রতি তারও যেন অনুকূল মনোভাব গড়ে ওঠে, সেজন্য আমাদের যদি দু'চার কদম ফেলতে হয়_ তাতে দ্বিধা করা উচিত নয়। তাকে আমরা ঢাকা সফরের জন্য বিশেষ আমন্ত্রণও জানাতে পারি। তিনি একবার আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হননি সে কারণে চিরকাল মুখ ফিরিয়ে রাখা কূটনীতির দর্শনে পড়ে না। ত্রিপুরায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল যেন দ্রুত গড়ে ওঠে তার চেষ্টাও আমরা করতে পারি। এর অবকাঠামো গড়ে দেবে ভারত। সেখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য পণ্য উৎপাদন হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে অনেক কিছু মিলবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ঝুলি খুলে দেখা গেল, তাতে তেমন কিছু আসলে ছিলই না। এ ক্ষতির পরিমাণ অনেক বড়, কিন্তু তা পূরণ করা যেতেই পারে। আমরা অনেক প্রত্যাশা করেছি, কিন্তু তার সবটা পূরণ হয়নি। তবে কেন পূরণ হয়নি, সেটা জানা গেছে দ্রুতই এবং এখন যে পথে এগোতে হবে তাতে আলো ফেলুন। ঢাকায় দুই দেশ যেসব বিষয়ে সহমতে এসেছে তার ব্যাখ্যা আমাদের জনগণের কাছে দিতে হবে। বৈঠকের আগে বাংলাদেশ সরকারের তরফে বলা হয়েছে, সব চুক্তি-সমঝোতা ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। তবে তাতেই কিন্তু স্বচ্ছতার দাবি পূরণ হয় না। বিতর্ক করতে দেবেন না, কেবল ফল জানাবেন_ সেটা কেমন কথা? চুক্তি সইয়ের আগে ও পরে সংসদে আলোচনার প্রয়োজন পড়ে। নাগরিক সমাজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হয়। এখন যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারত কী শর্তে ব্যবহার করবে, সেটা প্রকাশ করতে হবে। এজন্য অবকাঠামো সুবিধা অনেক বাড়াতে হবে। বন্দর থেকে ভারতে কত ট্রেন যাবে, তাতে আমাদের রেলগাড়ির চলাচল বিঘি্নত হবে কি-না সেসব নিয়ে জনমনে উদ্বেগ রয়েছে। ভারত ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা দিয়েছে। তা কাজে লাগানোর পথে অ-শুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) কী আসবে, সেটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার। তিস্তা বাদে অন্যান্য অভিন্ন নদনদীর পানি বণ্টন বিষয়েও দেশবাসীকে অবহিত করতে হবে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাদে অন্য ছিটমহলগুলোতে এখন বিক্ষোভ চলছে। যে সমঝোতা হয়েছে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন কবে হবে, সেটা দ্রুত স্পষ্ট করুন। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি চার দশকেও বাস্তবায়ন হয়নি। এবারের চুক্তির পরিণতি কী হবে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা বিষয়ে। আমাদের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ৬ সেপ্টেম্বরের আগে বলেছিলেন, দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করেই চুক্তি হচ্ছে। কিন্তু চুক্তিই হলো না। এখন অর্থমন্ত্রী বলছেন, তিন মাসের মধ্যে চুক্তি হবে। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করতে চাইবে না। এ আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতি সরকারের ভেতরের সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে। আমি বিশেষভাবে বলব সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা। এর পুনর্গঠনের কথা গভীরভাবে ভাবতে হবে। কেবল ব্যক্তি বদলের মধ্যে নয়, সমাধান নিহিত রয়েছে নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের মধ্যে। আমাদের কাছেই রয়েছে ভারত ও চীনের মতো দুটি জনবহুল দেশ, যাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে এবং তা থেকে আমাদেরও অনেক কিছু পাওয়ার রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে উন্নত করা যায় এবং আমাদের প্রয়োজন মেটাতে বেইজিং-দিলি্ল কী করতে পারে তার রূপরেখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই তুলে ধরতে হবে। ভারতের সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, তা নিয়ে নানা পর্যায়ে আলোচনা চালানো এবং প্রয়োজনে দর কষাকষি করার মতো দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। মনমোহন সিং ঢাকায় এসে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বামপন্থি নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের স্বার্থে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বার্তা অভিন্ন হয়েছে, এটাই আমরা ধরে নিতে চাই। তবে এ ধরনের বার্তা যাতে যে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেই দেওয়া যায়, তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ কিন্তু আসতে হয় সরকারের দিক থেকেই।
আশফাকুর রহমান :সাবেক রাষ্ট্রদূত
No comments