রিমান্ডের কথা by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব ধ্যানস্থ হইয়া যোগাসনে বসিয়া ছিলেন। শিষ্য তাহার পদপ্রান্তে বসিয়া প্রভুর মুখের দিকে তাকাইয়া ছিল। ধীরে ধীরে ওই মুখমণ্ডল হইতে এক ঐশ্বরিক আভা চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িল। শিষ্য এই অলৌকিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া অভিভূত হইয়া রহিল। এক সময়ে গুরুদেব চক্ষুদ্বয় উন্মীলিত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান কর।
আমি প্রস্তুত প্রভু। শিষ্য বলিল।
আমি প্রস্তুত প্রভু। শিষ্য বলিল।
বিএনপির কাউন্সিল সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?
এই কাউন্সিল ছিল উত্সবমুখর ও বর্ণাঢ্য, যা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়।
আর কোন মন্তব্য?
বিএনপির কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। উক্ত দলের পক্ষ হইতে যে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখা হয়, তাহাতে কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বিএনপির যে প্রতিনিধিদলটি যোগদান করিয়াছিল, তাহাদিগকে কোন শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয় নাই।
অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমার নজরে পড়িয়াছে কী?
মহাত্মন! বিএনপির কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভিডিওতে ধারণকৃত তারেক রহমানের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রচারিত হয়। ওই বেদনদায়ক বক্তৃতাটি আমার নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হইয়াছে।
তারেক রহমানের বক্তব্যকে তুমি বেদনাদায়ক বলিলে কী কারণে?
প্রভু! জরুরি অবস্থা জারির পর তারেক রহমানকে রিমান্ডে নিয়া যে পৈশাচিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়, ভিডিও বক্তব্যে তারেক রহমান উহার উল্লেখ করেন। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী ২৪টি টেলিভিশনের ছোট-বড় পর্দায় প্রায় এক লাখ নেতাকর্মী ও অতিথি পিনপতন স্তব্ধতায় উহা শ্রবণ করে।
শিষ্যের কথা শুনিয়া গুরুদেব তাহার ল্যাপটপের বোতাম টিপিলেন। স্ক্রিনে প্রেসক্লাবের সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদের সহিত তারেক রহমানের লন্ডনে গৃহীত সাক্ষাত্কারটি ভাসিয়া উঠিল। গুরুদেবের ইশারায় শিষ্য তাহা পাঠ করিল। তারেক রহমান বলিয়াছেন : ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বার বার ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি। ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় আমি কারাগারে। কোন ডাক্তার নেই। চিকিত্সা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে?’ (‘জিয়া পরিবার আর কত নির্যাতন সইবে’, আমার দেশ, ৬ ডিসেম্বর ২০০৯।)
শিষ্যের পাঠ শেষ হইলে গুরুদেব কহিলেন, কী বুঝিলে?
প্রত্যুত্তরে শিষ্য বলিল, ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতিকদিগকে রিমান্ডে নেয়ার নামে যে নির্যাতন করা হয়, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে উহার কোন বিচার হইল না কেন, তাহা বুঝিতে পারি না।
বিষয়টি তোমার না বুঝিবারই কথা। গুরুদেব জানাইলেন, জাতীয় সংসদে ওয়ান-ইলেভনের হোতাদের বিচারের জন্য যে হম্বিতম্বি করা হইয়াছিল, কোন রহস্যজনক কারণে তাহা স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। যে সকল সংসদ সদস্যকে জরুরি অবস্থায় রিমান্ডে নিয়া টর্চার করা হয়, তাহারাও এখন নিশ্চুপ।
শিষ্য কহিল, স্যার! ডক্টর মহিউদ্দীন খান আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল জলিল প্রমুখ নেতা তাহাদিগকে রিমান্ডে নির্যাতন প্রসঙ্গে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করিবেন বলিয়া ঘোষণা দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহারা এখন আর ওই বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না।
তোমার বক্তব্যের তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক নহে। কয়েকদিন পূর্বে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জনসভায় বলিয়াছেন, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে জনতার আদালতে মামলা হইবে। ইহার অর্থ কি বুঝিতে পার?
ইহার অর্থ তিনি আদালতের মামলা হইতে সরিয়া গিয়া জনতার আদালতের মুখাপেক্ষী হইয়াছেন। শিষ্য জানাইল।
সাধু! গুরুদেব কহিলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি রাজনৈতিক। ওই বিষয়ে কি কারণে সকলেই নীরবতা পালন করিতেছেন, তাহা লইয়া আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্যদের রিমান্ডে নিয়া যে অমানবিক নির্যাতন করা হয়, একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে উহার দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা উচিত ছিল। এই নির্যাতনের বিচার হওয়া আবশ্যক।
কিন্তু দেশে তখন সেনা সমর্থিত সরকার বিদ্যমান ছিল। শিষ্য কহিল, সম্ভবত জরুরি অবস্থায় সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তির অধিকার স্থগিত ছিল বলিয়াই এইরূপ টর্চার করা হইয়াছে।
হুঁ! গুরুদেব গম্ভীর মুখে বলিলেন, ব্যক্তির অধিকার স্থগিত হইলেই মানুষকে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করিতে হইবে, ইহা কোথায় লেখা আছে? আসলে আমাদের জিজ্ঞাসা, কাহার নির্দেশে কাহারা এইরূপ নির্যাতন চালাইয়াছিল? গুরুদেব পুনরায় কহিলেন, রিমান্ডের সেই ট্রাডিশন এখনও সমানে চলিতেছে।
বলেন কী প্রভু? শিষ্য সবিস্ময়ে কহিল।
ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। গুরুদেব বলিলেন, বাংলাদেশে বিস্ময়ের কিছুই ঘটে না। সকল বিস্ময়পূর্ণ ঘটনাই স্বাভাবিক। তুমি এই বিষয়ে জ্ঞাত নহ বলিয়াই এহেন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিয়াছ।
আমার অজ্ঞতা মার্জনা করিতে আজ্ঞা হয়। শিষ্য করজোড়ে কহিল।
বত্স! কেবল ঢাকা মহানগরীতে নভেম্বর পর্যন্ত এক মাস ২৮ দিনে ২ হাজার ৫ জনকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়াছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করিয়া ওই সময়ে রিমান্ডে নেওয়া হয় ১৭২ জনকে। ঢাকা মহানগরীর ৯টি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট দিনে ৩৫ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করিয়াছেন। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আসামিদিগকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। ড. শাহদিন মালিক বলিয়াছেন, ‘ইদানীং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ভয়াবহতা এত বেড়ে গেছে যে, আমরা যেন একটি বর্বর জাতি হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।’
হুজুর! রিমান্ডের বর্তমান চিত্রটি ভয়াবহ বলিলে অধিক বলা হয় না।
কিন্তু রিমান্ড সম্পর্কে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়াছিল, উহা কেহই প্রতিপালন করিতেছে না।
কী সেই নির্দেশনা জানিতে ইচ্ছা হইতেছে। শিষ্য জিজ্ঞাসিল।
গুরুদেব জানাইলেন, উহার পিছনে একটি করুণ ইতিহাস আছে। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেনডেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেলকে ৫৪ ধারায় আটক করিয়া ডিবি পুলিশ রিমান্ডে নেয়। রিমান্ডের ভয়াবহ নির্যাতনে তাহার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর মানবাধিকার সংস্থা ‘ব্লাস্ট’ হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট করে। উক্ত রিটের রায়ে বলা হয়, কোন ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হইলে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের কারণ লিপিবদ্ধ করিত হইবে। অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করিতে হইবে। জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কাহারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে হইবে। রায়ে আরও বলা হয়, কোন গোপন স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাইবে না। এই রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ প্রদানের পরও সেই নির্দেশনা মানা হয় নাই। যাহারা রিমান্ডে নেয়, তাহারা হাইকোর্টের উক্ত রায়ের ব্যাপারে কোন তোয়াক্কা করে না। গুরুদেব থামিলেন।
শিষ্য পুনরায় জিজ্ঞাসিল, প্রভু! যাহারা বর্তমানে ক্ষমতাসীন, তাহাদের অনেকেরই জরুরি অবস্থায় রিমান্ডের অভিজ্ঞতা আছে। রিমান্ডের নামে টর্চার বন্ধ করা তাহাদের উচিত ছিল নাকি?
গুরুদেব কহিলেন, দুঃখজনক বিষয় হইতেছে তাহাই। গত অক্টোবরে জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে রিমান্ডে নেয়ায় হাইকোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করিয়া হাইকোর্ট বলিয়াছেন, ‘আপনারা শুনানিতে সময় নেবেন আবার রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করবেন, এটা কোন ধরনের আচরণ? মানুষকে লিবার্টি দেয়ার জন্য আমরা এখানে বসেছি। আপনি আজ রাষ্ট্রপক্ষে আছেন। কাল অন্যপক্ষেও থাকতে পারেন। এটা ভালো নয়। আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরকেও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাইকোর্ট উঠিয়ে দিন।’ (আমার দেশ, ১১ অক্টোবর, ২০০৯।)
শিষ্য শিহরিয়া কহিল, কী আশ্চর্য! ইহার পরও রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ করিতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই!
পুলিশ কিংবা সামরিক হেফাজতে মৃত্যুরোধে একটি নতুন আইন হইতেছে। এই আইনে অবৈধ আটকাদেশে ও গ্রেফতারকালে, পুলিশ রিমান্ডে বা যে কোন কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদকালে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হইলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। কিন্তু আইনটি পাস হইলেও ইহার কার্যকারিতা থাকিবে কি-না, সেই বিষয়ে সন্দেহ রহিয়াছে।
কেন এইরূপ সন্দেহ?
সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনাই আইন এবং উহা মানিতে সংশ্লিষ্ট সকলেই বাধ্য। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানিলে কাহার কি বলার আছে বলিয়া এই প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক উল হক হতাশা ব্যক্ত করিয়াছেন।
স্যার! আমরা কি কোন বর্বর জাতি?
তোমার এই জিজ্ঞাসা অসঙ্গত নহে। রিমান্ডে ও ক্রসফায়ারের ঘটনায় এইরূপ জিজ্ঞাসা মনে জাগা স্বাভাবিক। গুরুদেব বিষাদপূর্ণ কণ্ঠে বলিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’ পড়িয়া আমার মনে হইয়াছে, আমরা কোন সভ্য জাতি নহি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও ‘লাইফ ইন প্রিজন’ নামক বই লিখিয়া জরুরি অবস্থাকালে তাহার রিমান্ডের পৈশাচিক কাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন। সত্যিকার অর্থে এই সকল গ্রন্থে জাতির দুর্ভাগ্য বর্ণিত হইয়াছে।
মহাত্মন! আমরা তারেক রহমানের রিমান্ডের ঘটনা লইয়া আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। এই আলোচনায় রিমান্ড সম্পর্কে অনেক বিষয়ই অবহিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল। একটু থামিয়া শিষ্য পুনরায় বলিল, বিএনপির কাউন্সিলে তারেক রহমানকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করায় সমগ্র জাতি হতাশ হইয়াছে বলিয়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ বক্তব্য দিয়াছেন। কিন্তু তারেক রহমানকে টর্চারের বিষয়ে সামান্যতম সহানুভূতিও প্রকাশ করেন নাই।
ইহাই আমাদের রাজনৈতিক কালচার। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়ে তুমি বড় বেশি আশা করিতেছ।
প্রভু! এই অবস্থা দেখিয়া আমি কিঞ্চিত্ হতাশ হইয়াছি।
বত্স! তোমার হতাশ হওয়ার কিছুই নাই। গুরুদেব শান্তকণ্ঠে কহিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাাদক থাকাকালে আবদুল জলিলকে রিমান্ডে নির্যাতন করায় তাহার দলের কেহ সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া জানা যায় নাই। আশা করি ইহা ভাবিলে তোমার হতাশা কাটিয়া যাইবে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ইমেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
এই কাউন্সিল ছিল উত্সবমুখর ও বর্ণাঢ্য, যা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়।
আর কোন মন্তব্য?
বিএনপির কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। উক্ত দলের পক্ষ হইতে যে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখা হয়, তাহাতে কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বিএনপির যে প্রতিনিধিদলটি যোগদান করিয়াছিল, তাহাদিগকে কোন শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয় নাই।
অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমার নজরে পড়িয়াছে কী?
মহাত্মন! বিএনপির কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভিডিওতে ধারণকৃত তারেক রহমানের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রচারিত হয়। ওই বেদনদায়ক বক্তৃতাটি আমার নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হইয়াছে।
তারেক রহমানের বক্তব্যকে তুমি বেদনাদায়ক বলিলে কী কারণে?
প্রভু! জরুরি অবস্থা জারির পর তারেক রহমানকে রিমান্ডে নিয়া যে পৈশাচিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়, ভিডিও বক্তব্যে তারেক রহমান উহার উল্লেখ করেন। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী ২৪টি টেলিভিশনের ছোট-বড় পর্দায় প্রায় এক লাখ নেতাকর্মী ও অতিথি পিনপতন স্তব্ধতায় উহা শ্রবণ করে।
শিষ্যের কথা শুনিয়া গুরুদেব তাহার ল্যাপটপের বোতাম টিপিলেন। স্ক্রিনে প্রেসক্লাবের সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদের সহিত তারেক রহমানের লন্ডনে গৃহীত সাক্ষাত্কারটি ভাসিয়া উঠিল। গুরুদেবের ইশারায় শিষ্য তাহা পাঠ করিল। তারেক রহমান বলিয়াছেন : ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বার বার ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি। ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় আমি কারাগারে। কোন ডাক্তার নেই। চিকিত্সা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে?’ (‘জিয়া পরিবার আর কত নির্যাতন সইবে’, আমার দেশ, ৬ ডিসেম্বর ২০০৯।)
শিষ্যের পাঠ শেষ হইলে গুরুদেব কহিলেন, কী বুঝিলে?
প্রত্যুত্তরে শিষ্য বলিল, ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতিকদিগকে রিমান্ডে নেয়ার নামে যে নির্যাতন করা হয়, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে উহার কোন বিচার হইল না কেন, তাহা বুঝিতে পারি না।
বিষয়টি তোমার না বুঝিবারই কথা। গুরুদেব জানাইলেন, জাতীয় সংসদে ওয়ান-ইলেভনের হোতাদের বিচারের জন্য যে হম্বিতম্বি করা হইয়াছিল, কোন রহস্যজনক কারণে তাহা স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। যে সকল সংসদ সদস্যকে জরুরি অবস্থায় রিমান্ডে নিয়া টর্চার করা হয়, তাহারাও এখন নিশ্চুপ।
শিষ্য কহিল, স্যার! ডক্টর মহিউদ্দীন খান আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল জলিল প্রমুখ নেতা তাহাদিগকে রিমান্ডে নির্যাতন প্রসঙ্গে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করিবেন বলিয়া ঘোষণা দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহারা এখন আর ওই বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না।
তোমার বক্তব্যের তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক নহে। কয়েকদিন পূর্বে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জনসভায় বলিয়াছেন, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে জনতার আদালতে মামলা হইবে। ইহার অর্থ কি বুঝিতে পার?
ইহার অর্থ তিনি আদালতের মামলা হইতে সরিয়া গিয়া জনতার আদালতের মুখাপেক্ষী হইয়াছেন। শিষ্য জানাইল।
সাধু! গুরুদেব কহিলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি রাজনৈতিক। ওই বিষয়ে কি কারণে সকলেই নীরবতা পালন করিতেছেন, তাহা লইয়া আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্যদের রিমান্ডে নিয়া যে অমানবিক নির্যাতন করা হয়, একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে উহার দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা উচিত ছিল। এই নির্যাতনের বিচার হওয়া আবশ্যক।
কিন্তু দেশে তখন সেনা সমর্থিত সরকার বিদ্যমান ছিল। শিষ্য কহিল, সম্ভবত জরুরি অবস্থায় সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তির অধিকার স্থগিত ছিল বলিয়াই এইরূপ টর্চার করা হইয়াছে।
হুঁ! গুরুদেব গম্ভীর মুখে বলিলেন, ব্যক্তির অধিকার স্থগিত হইলেই মানুষকে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করিতে হইবে, ইহা কোথায় লেখা আছে? আসলে আমাদের জিজ্ঞাসা, কাহার নির্দেশে কাহারা এইরূপ নির্যাতন চালাইয়াছিল? গুরুদেব পুনরায় কহিলেন, রিমান্ডের সেই ট্রাডিশন এখনও সমানে চলিতেছে।
বলেন কী প্রভু? শিষ্য সবিস্ময়ে কহিল।
ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। গুরুদেব বলিলেন, বাংলাদেশে বিস্ময়ের কিছুই ঘটে না। সকল বিস্ময়পূর্ণ ঘটনাই স্বাভাবিক। তুমি এই বিষয়ে জ্ঞাত নহ বলিয়াই এহেন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিয়াছ।
আমার অজ্ঞতা মার্জনা করিতে আজ্ঞা হয়। শিষ্য করজোড়ে কহিল।
বত্স! কেবল ঢাকা মহানগরীতে নভেম্বর পর্যন্ত এক মাস ২৮ দিনে ২ হাজার ৫ জনকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়াছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করিয়া ওই সময়ে রিমান্ডে নেওয়া হয় ১৭২ জনকে। ঢাকা মহানগরীর ৯টি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট দিনে ৩৫ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করিয়াছেন। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আসামিদিগকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। ড. শাহদিন মালিক বলিয়াছেন, ‘ইদানীং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ভয়াবহতা এত বেড়ে গেছে যে, আমরা যেন একটি বর্বর জাতি হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।’
হুজুর! রিমান্ডের বর্তমান চিত্রটি ভয়াবহ বলিলে অধিক বলা হয় না।
কিন্তু রিমান্ড সম্পর্কে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়াছিল, উহা কেহই প্রতিপালন করিতেছে না।
কী সেই নির্দেশনা জানিতে ইচ্ছা হইতেছে। শিষ্য জিজ্ঞাসিল।
গুরুদেব জানাইলেন, উহার পিছনে একটি করুণ ইতিহাস আছে। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেনডেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেলকে ৫৪ ধারায় আটক করিয়া ডিবি পুলিশ রিমান্ডে নেয়। রিমান্ডের ভয়াবহ নির্যাতনে তাহার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর মানবাধিকার সংস্থা ‘ব্লাস্ট’ হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট করে। উক্ত রিটের রায়ে বলা হয়, কোন ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হইলে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের কারণ লিপিবদ্ধ করিত হইবে। অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করিতে হইবে। জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কাহারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে হইবে। রায়ে আরও বলা হয়, কোন গোপন স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাইবে না। এই রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ প্রদানের পরও সেই নির্দেশনা মানা হয় নাই। যাহারা রিমান্ডে নেয়, তাহারা হাইকোর্টের উক্ত রায়ের ব্যাপারে কোন তোয়াক্কা করে না। গুরুদেব থামিলেন।
শিষ্য পুনরায় জিজ্ঞাসিল, প্রভু! যাহারা বর্তমানে ক্ষমতাসীন, তাহাদের অনেকেরই জরুরি অবস্থায় রিমান্ডের অভিজ্ঞতা আছে। রিমান্ডের নামে টর্চার বন্ধ করা তাহাদের উচিত ছিল নাকি?
গুরুদেব কহিলেন, দুঃখজনক বিষয় হইতেছে তাহাই। গত অক্টোবরে জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে রিমান্ডে নেয়ায় হাইকোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করিয়া হাইকোর্ট বলিয়াছেন, ‘আপনারা শুনানিতে সময় নেবেন আবার রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করবেন, এটা কোন ধরনের আচরণ? মানুষকে লিবার্টি দেয়ার জন্য আমরা এখানে বসেছি। আপনি আজ রাষ্ট্রপক্ষে আছেন। কাল অন্যপক্ষেও থাকতে পারেন। এটা ভালো নয়। আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরকেও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাইকোর্ট উঠিয়ে দিন।’ (আমার দেশ, ১১ অক্টোবর, ২০০৯।)
শিষ্য শিহরিয়া কহিল, কী আশ্চর্য! ইহার পরও রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ করিতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই!
পুলিশ কিংবা সামরিক হেফাজতে মৃত্যুরোধে একটি নতুন আইন হইতেছে। এই আইনে অবৈধ আটকাদেশে ও গ্রেফতারকালে, পুলিশ রিমান্ডে বা যে কোন কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদকালে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হইলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। কিন্তু আইনটি পাস হইলেও ইহার কার্যকারিতা থাকিবে কি-না, সেই বিষয়ে সন্দেহ রহিয়াছে।
কেন এইরূপ সন্দেহ?
সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনাই আইন এবং উহা মানিতে সংশ্লিষ্ট সকলেই বাধ্য। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানিলে কাহার কি বলার আছে বলিয়া এই প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক উল হক হতাশা ব্যক্ত করিয়াছেন।
স্যার! আমরা কি কোন বর্বর জাতি?
তোমার এই জিজ্ঞাসা অসঙ্গত নহে। রিমান্ডে ও ক্রসফায়ারের ঘটনায় এইরূপ জিজ্ঞাসা মনে জাগা স্বাভাবিক। গুরুদেব বিষাদপূর্ণ কণ্ঠে বলিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’ পড়িয়া আমার মনে হইয়াছে, আমরা কোন সভ্য জাতি নহি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও ‘লাইফ ইন প্রিজন’ নামক বই লিখিয়া জরুরি অবস্থাকালে তাহার রিমান্ডের পৈশাচিক কাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন। সত্যিকার অর্থে এই সকল গ্রন্থে জাতির দুর্ভাগ্য বর্ণিত হইয়াছে।
মহাত্মন! আমরা তারেক রহমানের রিমান্ডের ঘটনা লইয়া আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। এই আলোচনায় রিমান্ড সম্পর্কে অনেক বিষয়ই অবহিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল। একটু থামিয়া শিষ্য পুনরায় বলিল, বিএনপির কাউন্সিলে তারেক রহমানকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করায় সমগ্র জাতি হতাশ হইয়াছে বলিয়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ বক্তব্য দিয়াছেন। কিন্তু তারেক রহমানকে টর্চারের বিষয়ে সামান্যতম সহানুভূতিও প্রকাশ করেন নাই।
ইহাই আমাদের রাজনৈতিক কালচার। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়ে তুমি বড় বেশি আশা করিতেছ।
প্রভু! এই অবস্থা দেখিয়া আমি কিঞ্চিত্ হতাশ হইয়াছি।
বত্স! তোমার হতাশ হওয়ার কিছুই নাই। গুরুদেব শান্তকণ্ঠে কহিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাাদক থাকাকালে আবদুল জলিলকে রিমান্ডে নির্যাতন করায় তাহার দলের কেহ সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া জানা যায় নাই। আশা করি ইহা ভাবিলে তোমার হতাশা কাটিয়া যাইবে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ইমেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
No comments