দ্বিদলীয় রাজনীতির পরীক্ষা-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by সাবি্বর আহমেদ
রাজনৈতিক সংকট এড়ানোর পথ এখনও খোলা আছে। দুই দলকেই মনে রাখতে হবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংঘাতের পরিণতি হয় সাংবিধানিক সংকট, অন্য কথায় আরেকটি এক-এগারো। সংঘাত এবং আরেকটি এক-এগারো যদি বড় রাজনৈতিক দল দুটি এড়াতে চায় তবে সমঝোতায় আসতে হবে বাংলাদেশের বাই-পার্টিজান রাজনীতি এখন মুখোমুখি।
দুই দল তাদের জোটের শরিক দলগুলো নিয়ে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এমন অবস্থান গ্রহণ করেছে যে, কারও পক্ষে আর পিছু হটা কিংবা মধ্যপন্থা গ্রহণের পথ নেই। যেমন হয়েছিল ২০০৬ সালের শেষদিকে। ফলাফল ছিল সম্মুখ সমর। আবারও সে রকম একটা ব্যাপার হওয়ার জোগাড় হয়েছে। এ রকম বিপরীতমুখী অবস্থান কেন? এতে জনগণের, না রাজনৈতিক দলগুলোর, কার লাভ হয়? লাভ কি আসলেই কারও হয়? নাকি সব পক্ষেরই ক্ষতি? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাই বা এমন কেন?
বিএনপি আর আওয়ামী লীগ দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুরু থেকেই এমন বিরোধ চলে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু '৯০-এর গণআন্দোলন। এমনকি '৮৬-৮৮ সালেও তারা ভিন্ন অবস্থানে থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে। '৯০ সালে এসে ব্যাপক গণজোয়ারের সময়, বিশেষ করে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের এক রকম চাপে তারা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। কেন তারপর আর একপথে হাঁটা গেল না?
যাবে কী করে? পথ তো তাদের এক নয়। যদিও রাজনৈতিক দর্শন বিবেচনায় দল দুটো খুব একটা দূরের নয়। অর্থনীতির দৃষ্টিতে দু'দলকেই বুর্জোয়া অর্থনীতির ধারক এবং বাহক বলতে হবে। পার্থক্য এই যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। বিএনপি থাকলে টালবাহানা চলে। আদমজীর মতো প্রতিষ্ঠানকে বিএনপি হাওয়া করে দেয়। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দোয়েল কম্পিউটার বানায়। তবুও দেখি দু'দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ীরাই সংখ্যাগুরু। দু'দলের পার্থক্য দর্শনেও না, অর্থনীতিতেও না। পার্থক্য জন্মে। আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে, আর বিএনপির রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানে। পার্থক্য গণমুখিতায়।
বস্তুত, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট যেখানে দাঁড়িয়েছে তার থেকে পরিত্রাণের উপায় সহজ নয়। বিরোধীদলীয় নেতা লংমার্চ করছেন তার দাবির প্রতি জনসমর্থন জোগাড় করতে। তার এ অবস্থান থেকে বোঝা যায়, তার দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন প্রশ্নে মনের জোরের কমতি আছে। বিগত দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম বিবেচনায় রেখে, বিশেষ করে এক-এগারো-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ এবং স্বৈরাচারী শাসনের অভিজ্ঞতা আর তৎপূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়ার যে টালবাহানা বাঙালি দেখেছে, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মোহ বহুলাংশে কমেছে। তাই বলে শেষ হয়ে যায়নি কিংবা রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মানসিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়নি। এমতাবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে যে রায়, আর রায়ের শেষে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ এই জটিলতার জাল ছিন্ন করে সংবিধান সংশোধন করেছে। সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো স্থান নেই। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল আর সংবিধান বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মতামত দেওয়ার জন্য। সবাই আমন্ত্রণ রক্ষা করে মতামত দিয়েছিলেন, বিএনপি আর জামায়াত ছাড়া। তারা জানত যে, তাদের মতামত সরকারি দল গ্রহণ করবে না। বরং মতামত জানাতে গেলে তারা ওই সংশোধনীর অংশ হয়ে যাবে। জামায়াত-বিএনপি সে ফাঁদে পা রাখেনি।
আপাত রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বটা আসলে ক্ষমতার লড়াই। যে কোনোভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে বা ক্ষমতায় যেতে হবে। ক্ষমতায় থাকাটা অত্যন্ত জরুরি যেমন আওয়ামী লীগের জন্য, তেমনি জরুরি ক্ষমতায় আসাটা বিএনপির জন্য। ক্ষমতা ধরে রাখতে না পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়তো আবার ৪০ বছর পেছাবে। গ্রেনেড হামলার বিচার, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার, দেশের রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখার প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠা, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রক্ষা করা, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের যে স্বপ্ন আওয়ামী লীগ দেখে বা দেখায় তা পূরণ করা, ভিশন-২০২১কে বিমূর্ততা থেকে মূর্ত করা, সর্বোপরি আগামী নির্বাচনে যদি জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় চলে আসে তাহলে যে সম্ভাব্য প্রতিহিংসামূলক নিপীড়ন-নির্যাতন সইতে হবে তার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ভ্যাক্সিন ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জিততেই হবে। অন্যদিকে, বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বিএনপি যাদের ওপর ভর করে ক্ষমতা দখল এবং দল গঠন করেছিল, যাদের বঙ্গবন্ধু হত্যার পুরস্কারস্বরূপ বিচারের ঊধর্ে্ব স্থাপন করেছিল, আওয়ামী লীগ তাদের ফাঁসির ব্যবস্থা করেছে। যাদের সঙ্গে বিএনপির আজন্ম রাজনৈতিক গাঁটছড়া, আওয়ামী লীগ তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা এখন বিচারের কাঠগড়ায়। ক্রাউন প্রিন্স একাধিক দুর্নীতি মামলাসহ ২১ আগস্টে গ্রেনেড হত্যা মামলার আসামি, দেশছাড়া। আরেক প্রিন্সের অবস্থাও তথৈবচ। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অভ্যস্ত এ দলটি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় না আসতে পারলে তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে_ এমন ধারণা অমূলক নয়।
তবে রাজনৈতিক সংকট এড়ানোর পথ এখনও খোলা আছে। দুই দলকেই মনে রাখতে হবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংঘাতের পরিণতি হয় সাংবিধানিক সংকট, অন্য কথায় আরেকটি এক-এগারো। সংঘাত এবং আরেকটি এক-এগারো যদি বড় রাজনৈতিক দল দুটি এড়াতে চায় তবে সমঝোতায় আসতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা ভীষণ রকম বিরল। তবুও বলি, দু'দলের স্বার্থ রক্ষা করেই সমঝোতা সম্ভব। কী রকম সমঝোতা হওয়া সম্ভব?
বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগের অবস্থান, নিজেদের সরকারের অধীনে নির্বাচন। তবে নির্বাচনের সময় নির্বাচন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। নির্বাচন পরিচালনায় কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা, যাতে নির্বাচন স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য হয়। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের রায় হচ্ছে_ অনির্বাচিত সরকার সংবিধানসম্মত নয় এবং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় যদি রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর সদিচ্ছা কোনো কারণে উদয় হয় তবে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে ১১ জন সদস্য নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যেতে পারে। শর্ত হচ্ছে_ এই ১১ জন পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এ রকম একটি সরকার শুধু নির্বাচন চলাকালীন সরকারের রুটিন কাজগুলো করবে আর নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করবে। এই সরকার গঠন হবে মনোনয়নপত্র দাখিলের ঠিক আগে। আর তার মেয়াদ শেষ হবে নতুন সরকার গঠন হওয়া পর্যন্ত। মোটামুটি এক মাস সময়ের মতো হবে এ সরকারের মেয়াদকাল। এ পদ্ধতিতে সংবিধানের মূলনীতি অর্থাৎ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা না থাকা, বিএনপির মূল দাবি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন নয়, আর আওয়ামী লীগের অবস্থান আর নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে নির্বাচনী কারচুপি, সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণ_ এ রকম বড় বড় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ পদ্ধতিটির পরিমার্জন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব।
সাবি্বর আহমেদ : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত
No comments