বদলে যাওয়া গ্রামে তারুণ্যের প্রত্যাশা কে পূরণ করবে?-সময়ের কথা by অজয় দাশগুপ্ত
গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তনে নতুন চাহিদা সৃষ্টি করছে। এখানে অর্থের জোন আসছে নানা সূত্রে। গত কয়েক বছর ধরে কৃষিপণ্যের দাম ভালো ছিল। এতে নিত্যদিন যারা চাল-সবজি-ডাল কিনে খায় তাদের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু কৃষকদের হাতে টাকা আসছে এবং তারা নানা শিল্পপণ্য_ ফ্রিজ, টিভি, খাট-চেয়ার-টেবিল কিনছে।
যে কোনো গ্রামের বাজারে এখন ১০-১২টা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান রয়েছে। টিন-সিমেন্ট-রড-ইটেরও ভালো বাজার গ্রামে। দিনমজুররাও আগের তুলনায় ভালো হারে মজুরি পায়
বাংলাদেশের ১০ কোটিরও বেশি লোক গ্রামে বাস করে। এ তথ্যে তেমন নতুনত্ব নেই। প্রায় ৪৮ হাজার গ্রামে বিদ্যুৎ পেঁৗছানো সম্ভব হয়েছে, এ তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করা হতে পারে_ এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারে কি এ সুবিধা পেঁৗছেছে? সবার ঘরে কি কারেন্ট বাতি জ্বলে, টিভি দেখা যায়? এ প্রশ্নে কেউ বলবেন, বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর তালিকায় থাকা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ অর্জন বেশ ভালোই। কেউবা বলবেন, ৫০ বছর আগে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ তো আমাদের মতোই পিছিয়ে ছিল। তারা এগিয়ে যেতে পারল, আমরা কেন পারলাম না? এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা প্রথমেই বলা হবে।
মঙ্গলবার কনজামসন অ্যান্ড মিডিয়া হ্যাবিট অব রুরাল বাংলাদেশ শীর্ষক নেলসন পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে গ্রামে এ ধরনের পরিবর্তনের আরও কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। যেমন_ গ্রামে মোবাইল টেলিফোন রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবারে। ইন্টারনেট সুবিধা প্রবেশ করছে। সপ্তাহে অন্তত একদিন পত্রিকা পড়ে ২০-২২ শতাংশ লোক। তবে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে অনেক বেশি লোক। টিভি বিনোদনের ভালো মাধ্যম। এ কাজে পড়াশোনা জানার দরকার পড়ে না। তবে তাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু থাকলে সেটা গ্রহণ করে। তারা বাংলাদেশ টেলিভিশন ও চ্যানেল আইয়ে শাইখ সিরাজের কৃষি সংক্রান্ত অনুষ্ঠান দেখে এবং কৃষি কাজে তার প্রয়োগ ঘটাতে চেষ্টা করে।
শিক্ষার যে প্রসার ঘটছে দেশে, সেটা আমাদের জানা। সরকার তিন কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছে। এ এক অসাধ্য সাধন বলতে হবে। আমাদের সরকারি প্রশাসনের অনেক বদনাম আছে। দুর্নীতি-অদক্ষতা বিস্তর। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে এক কোটি ৬৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। আরও একটি তথ্য_ গত দুই বছরে অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ২৮ লাখ শিক্ষার্থী। এদের অর্ধেক অর্থাৎ ১৪ লাখ ছাত্রী। তাদের বড় অংশের বসবাস গ্রামে। প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ১০ লাখের মতো ছাত্রছাত্রী_ এ তথ্যও উৎসাহব্যঞ্জক। বলা যায়, বাংলাদেশে বড় ধরনের একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠছে। তারা শহরে আছে, রাজধানীর বস্তিতে আছে, প্রত্যন্ত গ্রামে আছে। তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কতটা ভাবেন, সেটা কিন্তু বড় প্রশ্ন। তারা চাকরি চায়, ভালো বাসস্থান চায়। বিনোদনের আয়োজন চায়।
আরেকটি তথ্য_ বাংলাদেশের বর্তমানে যে লোকসংখ্যা তার চার ভাগের তিন ভাগের বেশির জন্ম ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর। শিক্ষার আলোয় কমবেশি তারা আলোকিত। তাদের হাতে হাতে ঘুরছে মোবাইল টেলিফোন। এ মোবাইল এক সময় ছিল কেবলই কত কথা বলার, কিন্তু এখন তা ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চাকরির তথ্য জানা যায় মোবাইল ফোন থেকে। এ সুবিধা তারা কাজে লাগাতে সচেষ্ট। ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল। তারা আইয়ুব খানের সামরিক দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। একাত্তরে দেশকে স্বাধীন করেছে। ওই প্রজন্মের সন্তানরাই এখন তরুণ-তরুণী। তাদের বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। তবে সরকারের মতোই দায় রয়েছে সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির। তাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি যেমন সবাইকে মনোযোগী থাকতে হয়, তেমনি মূল্যবোধ, সততা ও ন্যায়নীতির আদর্শে যেন তারা গড়ে উঠতে পারে সে জন্যও চাই সচেতন প্রচেষ্টা। উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যর্থতা রয়েছে এবং বলা যায় তার মাত্রা যথেষ্ট। শাসক দলের 'তরুণরা' ব্যস্ত টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিতে।
বাংলাদেশে এখন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল পুলিশের সহায়তা নিয়ে ছাত্রলীগকে কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয় না। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ছাত্রলীগ একইভাবে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে যেতে দেয় না। এর উদ্দেশ্য শিক্ষার মান বাড়ানো নয়, বরং দখলদারদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিবাণিজ্য ও নির্মাণ কাজ থেকে বখরা আদায়।
তাদের কারণে ক্যাম্পাস নিরাপদ হয় না। পড়াশোনার নির্বিঘ্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। ছাত্রদল নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে অন্যায় সুবিধা ভোগের ইস্যুতে। ছাত্রলীগ এখন তা করছে। এটা থামাতে বিএনপি তৎপর হয়নি। আওয়ামী লীগও তৎপর নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কেবল নিয়মিত ছাত্রছাত্রীরা যাতে প্রতিদ্বন্দ্বি্বতা করতে পারে, সে প্রস্তাব রয়েছে অনেকের। কিন্তু সরকার তার প্রতি মনোযোগী নয়, বিএনপিও নয়। তরুণ যে প্রজন্মের কথা বললাম, তারা কি এসব পছন্দ করছে? এর উত্তর এক কথায় হচ্ছে _ না। এটা শাসকদের অজানা নয়। বিরোধী দলে যারা থাকে তাদেরও নয়। কিন্তু কেউ এর প্রতি কর্ণপাত করছে না।
গ্রামের কথায় ফিরে যাই। কমবেশি পড়াশোনা জানা লোক এখন প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে আছে। ঘরে ঘরে রয়েছে ছাত্রছাত্রী। তারা চাহিদা সৃষ্টি করছে। গ্রামের বাজারে এখন শহরের মতো পোশাকের দোকান। ফ্রিজে রাখা পেপসি-কোক-প্রাণের জুস মেলে সেখানে। স্কুলের বড় মাঠে শুধু নয়, একটু ফাঁকা স্থান পেলেও ক্রিকেট নিয়ে মেতে ওঠে বালক-কিশোররা। খেলাধুলায় মেয়েরা অবশ্য পিছিয়ে। শিক্ষায় এগিয়ে এলেও বাইরের জগতে ছেলেদের সমান সুবিধা মিলছে না। সামাজিক বাধাও যথেষ্ট। তারপরও বলতে হয়_ নারীর ক্ষমতায়নে একটু একটু হলেও আমরা এগিয়ে চলেছি। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোতে বিপুলসংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে একজন করে নারী ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। তাদের নির্দিষ্ট কাজ খুব একটা বেশি নেই। তারপরও স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিরা সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। তাদের জন্য যথাযথ দায়িত্ব বণ্টন করা হলে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের কাজের গুণগত মান উন্নত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়গুলোতে তাদের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়া সম্ভব। সরকারে যারা নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন, তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে ভাবতে হবে। এ কাজ ধর্মান্ধ শক্তি করবে না। নারী সমাজ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠুক, সেটা তারা চায় না। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের শরিকরাও কি বিষয়টি নিয়ে খুব ভাবছে? এখন পর্যন্ত কিন্তু তেমন লক্ষণ নেই।
গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তন নতুন চাহিদা সৃষ্টি করছে। এখানে অর্থের জোগান আসছে নানা সূত্রে। গত কয়েক বছর কৃষিপণ্যের দাম ভালো ছিল। এতে নিত্যদিন যারা চাল-সবজি-ডাল কিনে খায় তাদের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু কৃষকদের হাতে টাকা আসছে এবং তারা নানা শিল্পপণ্য_ ফ্রিজ, টিভি, খাট-চেয়ার-টেবিল কিনছে। যে কোনো গ্রামের বাজারে এখন ১০-১২টা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান রয়েছে। টিন-সিমেন্ট-রড-ইটেরও ভালো বাজার গ্রামে। দিনমজুররাও আগের তুলনায় ভালো হারে মজুরি পায়। আশির দশকে ক্ষেতমজুরদের দাবি ছিল, দিনে সাড়ে তিন কেজি চালের মূল্যের সমান মজুরি দিতে হবে। এখন বলা যায়, গড় মজুরি এর দ্বিগুণ কিংবা অনেক ক্ষেত্রে তারও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায়, তাদের বড় অংশের বাস গ্রামে। তাদের পাঠানো অর্থও গ্রামের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারে সহায়ক। তারা ঋণ দিচ্ছে, কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছে।
এই নতুন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। নেলসন যে গবেষণা করেছে সেটা কিন্তু এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেখেছি বিজ্ঞাপন ব্যবসায় যুক্ত অনেককে। তারা জেনে গেলেন, সংবাদপত্রের চেয়ে টেলিভিশনের কদর বেশি। বিভিন্ন কোম্পানির কিছু নির্দিষ্ট ধরনের বিজ্ঞাপন বণ্টনে তারা টিভিকে গুরুত্ব দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। টিভি-ফ্রিজ চালাতে হলে চাই বিদ্যুৎ। মোবাইল ফোন এবং ইজিবাইক চালাতেও বিদ্যুৎ চাই। বাল্ব-পাখার জন্যও তা চাই। এর চাহিদা হুহু করে বাড়ছে। কোনো সরকারের পক্ষেই এ চাহিদা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় পরিবহন ব্যবস্থা উপেক্ষা করা। জরিপে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত গ্রামেও বাড়ি থেকে ২০ মিনিট বা তারও কম সময় হাঁটলেই পাওয়া যায় বাস বা যন্ত্রচালিত নানা ধরনের যানবাহন। এক সময় তো সারাদিন হেঁটেও এ সুবিধা মিলত না। গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে যে মানুষ তাদের সঙ্গে সরকার কি তাল মেলাচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলো কি তাল মেলাচ্ছে? নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলো কি তাল মেলাচ্ছে? গ্রামে টিভি দেখা কৃষক-দিনমজুররা চাইবে ইউনিয়ন পরিষদের কাছ থেকে আরও ভালো মানের সেবা। দেশের অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকরা অনুপস্থিত থাকেন, এ তথ্য এখন তাদের জানা। এ নিয়ে এক স্থানে বিক্ষোভের খবর দেখলে অনেক স্থানে তেমনটি করার উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলেও যে ক্ষোভ হয়, সেটা তারা টিভি দেখে বুঝতে পারে। যুগ যুগ ধরে ধারণা রয়েছে_ কৃষক ফসল ফলাবে অন্যদের জন্য। তারা সামান্য লাভে বিক্রি করে দেবে পণ্য। কিংবা অনেক সময় লাভও করবে না। মধ্যবিত্তরা খুশি থাকে কম দামে চাল-ডাল-মাছ-ডিম-দুধ পেলে। কৃষকের কাজ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা। সরকারও এমনটি এতকাল চেয়েছে। কিন্তু এখন কৃষক-দিনমজুর পরিবারেও অনেক চাহিদা। তাদের সন্তানদের পড়াশোনা করাতে হয়। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিতে হয়। ভালো পোশাক কিনে দিতে হয়। ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টনের ব্যাট ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে দিতে হয়। আর নেলসনের জরিপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় তথ্য কি জানেন_ খাদ্যের পরেই গ্রামের মানুষের ব্যয় শিক্ষা খাতে। শহরেও কিন্তু এমনই চিত্র মিলবে। গ্রামে পরিবর্তনের কথা যদি ধরেন, তাহলে বলব যে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যে শিক্ষিত, কর্মোদ্যোগী নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাদের রাষ্ট্র কতটা প্রস্তুত? তারা আরও পড়ার জন্য কিংবা চাকরি-ব্যবসার সুবাদে শহরে আসবে। কিংবা গ্রামেই থাকবে। তাদের উপেক্ষা করা হলে পরিণতি কিন্তু ভালো হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলব, কেবল দলীয় কিছু কোটারি স্বার্থ নিয়ে চললে এ প্রজন্মের মন জয় করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এটা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারছেন যে, ক্ষমতাসীনরা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না বলেই এ নবীন প্রজন্ম পাঁচ বছর পর দল বদলাতে চায় কিংবা অন্য কেউ এলে তাকে বাজিয়ে দেখতে চায়। তারা কি নিজেদের বললাবে না?
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
বাংলাদেশের ১০ কোটিরও বেশি লোক গ্রামে বাস করে। এ তথ্যে তেমন নতুনত্ব নেই। প্রায় ৪৮ হাজার গ্রামে বিদ্যুৎ পেঁৗছানো সম্ভব হয়েছে, এ তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করা হতে পারে_ এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারে কি এ সুবিধা পেঁৗছেছে? সবার ঘরে কি কারেন্ট বাতি জ্বলে, টিভি দেখা যায়? এ প্রশ্নে কেউ বলবেন, বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর তালিকায় থাকা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ অর্জন বেশ ভালোই। কেউবা বলবেন, ৫০ বছর আগে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ তো আমাদের মতোই পিছিয়ে ছিল। তারা এগিয়ে যেতে পারল, আমরা কেন পারলাম না? এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা প্রথমেই বলা হবে।
মঙ্গলবার কনজামসন অ্যান্ড মিডিয়া হ্যাবিট অব রুরাল বাংলাদেশ শীর্ষক নেলসন পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে গ্রামে এ ধরনের পরিবর্তনের আরও কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। যেমন_ গ্রামে মোবাইল টেলিফোন রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবারে। ইন্টারনেট সুবিধা প্রবেশ করছে। সপ্তাহে অন্তত একদিন পত্রিকা পড়ে ২০-২২ শতাংশ লোক। তবে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে অনেক বেশি লোক। টিভি বিনোদনের ভালো মাধ্যম। এ কাজে পড়াশোনা জানার দরকার পড়ে না। তবে তাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু থাকলে সেটা গ্রহণ করে। তারা বাংলাদেশ টেলিভিশন ও চ্যানেল আইয়ে শাইখ সিরাজের কৃষি সংক্রান্ত অনুষ্ঠান দেখে এবং কৃষি কাজে তার প্রয়োগ ঘটাতে চেষ্টা করে।
শিক্ষার যে প্রসার ঘটছে দেশে, সেটা আমাদের জানা। সরকার তিন কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছে। এ এক অসাধ্য সাধন বলতে হবে। আমাদের সরকারি প্রশাসনের অনেক বদনাম আছে। দুর্নীতি-অদক্ষতা বিস্তর। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে এক কোটি ৬৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। আরও একটি তথ্য_ গত দুই বছরে অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ২৮ লাখ শিক্ষার্থী। এদের অর্ধেক অর্থাৎ ১৪ লাখ ছাত্রী। তাদের বড় অংশের বসবাস গ্রামে। প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ১০ লাখের মতো ছাত্রছাত্রী_ এ তথ্যও উৎসাহব্যঞ্জক। বলা যায়, বাংলাদেশে বড় ধরনের একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠছে। তারা শহরে আছে, রাজধানীর বস্তিতে আছে, প্রত্যন্ত গ্রামে আছে। তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কতটা ভাবেন, সেটা কিন্তু বড় প্রশ্ন। তারা চাকরি চায়, ভালো বাসস্থান চায়। বিনোদনের আয়োজন চায়।
আরেকটি তথ্য_ বাংলাদেশের বর্তমানে যে লোকসংখ্যা তার চার ভাগের তিন ভাগের বেশির জন্ম ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর। শিক্ষার আলোয় কমবেশি তারা আলোকিত। তাদের হাতে হাতে ঘুরছে মোবাইল টেলিফোন। এ মোবাইল এক সময় ছিল কেবলই কত কথা বলার, কিন্তু এখন তা ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চাকরির তথ্য জানা যায় মোবাইল ফোন থেকে। এ সুবিধা তারা কাজে লাগাতে সচেষ্ট। ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল। তারা আইয়ুব খানের সামরিক দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। একাত্তরে দেশকে স্বাধীন করেছে। ওই প্রজন্মের সন্তানরাই এখন তরুণ-তরুণী। তাদের বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। তবে সরকারের মতোই দায় রয়েছে সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির। তাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি যেমন সবাইকে মনোযোগী থাকতে হয়, তেমনি মূল্যবোধ, সততা ও ন্যায়নীতির আদর্শে যেন তারা গড়ে উঠতে পারে সে জন্যও চাই সচেতন প্রচেষ্টা। উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যর্থতা রয়েছে এবং বলা যায় তার মাত্রা যথেষ্ট। শাসক দলের 'তরুণরা' ব্যস্ত টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিতে।
বাংলাদেশে এখন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল পুলিশের সহায়তা নিয়ে ছাত্রলীগকে কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয় না। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ছাত্রলীগ একইভাবে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে যেতে দেয় না। এর উদ্দেশ্য শিক্ষার মান বাড়ানো নয়, বরং দখলদারদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিবাণিজ্য ও নির্মাণ কাজ থেকে বখরা আদায়।
তাদের কারণে ক্যাম্পাস নিরাপদ হয় না। পড়াশোনার নির্বিঘ্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। ছাত্রদল নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে অন্যায় সুবিধা ভোগের ইস্যুতে। ছাত্রলীগ এখন তা করছে। এটা থামাতে বিএনপি তৎপর হয়নি। আওয়ামী লীগও তৎপর নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কেবল নিয়মিত ছাত্রছাত্রীরা যাতে প্রতিদ্বন্দ্বি্বতা করতে পারে, সে প্রস্তাব রয়েছে অনেকের। কিন্তু সরকার তার প্রতি মনোযোগী নয়, বিএনপিও নয়। তরুণ যে প্রজন্মের কথা বললাম, তারা কি এসব পছন্দ করছে? এর উত্তর এক কথায় হচ্ছে _ না। এটা শাসকদের অজানা নয়। বিরোধী দলে যারা থাকে তাদেরও নয়। কিন্তু কেউ এর প্রতি কর্ণপাত করছে না।
গ্রামের কথায় ফিরে যাই। কমবেশি পড়াশোনা জানা লোক এখন প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে আছে। ঘরে ঘরে রয়েছে ছাত্রছাত্রী। তারা চাহিদা সৃষ্টি করছে। গ্রামের বাজারে এখন শহরের মতো পোশাকের দোকান। ফ্রিজে রাখা পেপসি-কোক-প্রাণের জুস মেলে সেখানে। স্কুলের বড় মাঠে শুধু নয়, একটু ফাঁকা স্থান পেলেও ক্রিকেট নিয়ে মেতে ওঠে বালক-কিশোররা। খেলাধুলায় মেয়েরা অবশ্য পিছিয়ে। শিক্ষায় এগিয়ে এলেও বাইরের জগতে ছেলেদের সমান সুবিধা মিলছে না। সামাজিক বাধাও যথেষ্ট। তারপরও বলতে হয়_ নারীর ক্ষমতায়নে একটু একটু হলেও আমরা এগিয়ে চলেছি। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোতে বিপুলসংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে একজন করে নারী ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। তাদের নির্দিষ্ট কাজ খুব একটা বেশি নেই। তারপরও স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিরা সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। তাদের জন্য যথাযথ দায়িত্ব বণ্টন করা হলে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের কাজের গুণগত মান উন্নত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়গুলোতে তাদের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়া সম্ভব। সরকারে যারা নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন, তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে ভাবতে হবে। এ কাজ ধর্মান্ধ শক্তি করবে না। নারী সমাজ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠুক, সেটা তারা চায় না। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের শরিকরাও কি বিষয়টি নিয়ে খুব ভাবছে? এখন পর্যন্ত কিন্তু তেমন লক্ষণ নেই।
গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তন নতুন চাহিদা সৃষ্টি করছে। এখানে অর্থের জোগান আসছে নানা সূত্রে। গত কয়েক বছর কৃষিপণ্যের দাম ভালো ছিল। এতে নিত্যদিন যারা চাল-সবজি-ডাল কিনে খায় তাদের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু কৃষকদের হাতে টাকা আসছে এবং তারা নানা শিল্পপণ্য_ ফ্রিজ, টিভি, খাট-চেয়ার-টেবিল কিনছে। যে কোনো গ্রামের বাজারে এখন ১০-১২টা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান রয়েছে। টিন-সিমেন্ট-রড-ইটেরও ভালো বাজার গ্রামে। দিনমজুররাও আগের তুলনায় ভালো হারে মজুরি পায়। আশির দশকে ক্ষেতমজুরদের দাবি ছিল, দিনে সাড়ে তিন কেজি চালের মূল্যের সমান মজুরি দিতে হবে। এখন বলা যায়, গড় মজুরি এর দ্বিগুণ কিংবা অনেক ক্ষেত্রে তারও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায়, তাদের বড় অংশের বাস গ্রামে। তাদের পাঠানো অর্থও গ্রামের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারে সহায়ক। তারা ঋণ দিচ্ছে, কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছে।
এই নতুন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। নেলসন যে গবেষণা করেছে সেটা কিন্তু এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেখেছি বিজ্ঞাপন ব্যবসায় যুক্ত অনেককে। তারা জেনে গেলেন, সংবাদপত্রের চেয়ে টেলিভিশনের কদর বেশি। বিভিন্ন কোম্পানির কিছু নির্দিষ্ট ধরনের বিজ্ঞাপন বণ্টনে তারা টিভিকে গুরুত্ব দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। টিভি-ফ্রিজ চালাতে হলে চাই বিদ্যুৎ। মোবাইল ফোন এবং ইজিবাইক চালাতেও বিদ্যুৎ চাই। বাল্ব-পাখার জন্যও তা চাই। এর চাহিদা হুহু করে বাড়ছে। কোনো সরকারের পক্ষেই এ চাহিদা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় পরিবহন ব্যবস্থা উপেক্ষা করা। জরিপে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত গ্রামেও বাড়ি থেকে ২০ মিনিট বা তারও কম সময় হাঁটলেই পাওয়া যায় বাস বা যন্ত্রচালিত নানা ধরনের যানবাহন। এক সময় তো সারাদিন হেঁটেও এ সুবিধা মিলত না। গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে যে মানুষ তাদের সঙ্গে সরকার কি তাল মেলাচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলো কি তাল মেলাচ্ছে? নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলো কি তাল মেলাচ্ছে? গ্রামে টিভি দেখা কৃষক-দিনমজুররা চাইবে ইউনিয়ন পরিষদের কাছ থেকে আরও ভালো মানের সেবা। দেশের অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকরা অনুপস্থিত থাকেন, এ তথ্য এখন তাদের জানা। এ নিয়ে এক স্থানে বিক্ষোভের খবর দেখলে অনেক স্থানে তেমনটি করার উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলেও যে ক্ষোভ হয়, সেটা তারা টিভি দেখে বুঝতে পারে। যুগ যুগ ধরে ধারণা রয়েছে_ কৃষক ফসল ফলাবে অন্যদের জন্য। তারা সামান্য লাভে বিক্রি করে দেবে পণ্য। কিংবা অনেক সময় লাভও করবে না। মধ্যবিত্তরা খুশি থাকে কম দামে চাল-ডাল-মাছ-ডিম-দুধ পেলে। কৃষকের কাজ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা। সরকারও এমনটি এতকাল চেয়েছে। কিন্তু এখন কৃষক-দিনমজুর পরিবারেও অনেক চাহিদা। তাদের সন্তানদের পড়াশোনা করাতে হয়। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিতে হয়। ভালো পোশাক কিনে দিতে হয়। ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টনের ব্যাট ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে দিতে হয়। আর নেলসনের জরিপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় তথ্য কি জানেন_ খাদ্যের পরেই গ্রামের মানুষের ব্যয় শিক্ষা খাতে। শহরেও কিন্তু এমনই চিত্র মিলবে। গ্রামে পরিবর্তনের কথা যদি ধরেন, তাহলে বলব যে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যে শিক্ষিত, কর্মোদ্যোগী নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে তাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাদের রাষ্ট্র কতটা প্রস্তুত? তারা আরও পড়ার জন্য কিংবা চাকরি-ব্যবসার সুবাদে শহরে আসবে। কিংবা গ্রামেই থাকবে। তাদের উপেক্ষা করা হলে পরিণতি কিন্তু ভালো হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলব, কেবল দলীয় কিছু কোটারি স্বার্থ নিয়ে চললে এ প্রজন্মের মন জয় করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এটা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারছেন যে, ক্ষমতাসীনরা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না বলেই এ নবীন প্রজন্ম পাঁচ বছর পর দল বদলাতে চায় কিংবা অন্য কেউ এলে তাকে বাজিয়ে দেখতে চায়। তারা কি নিজেদের বললাবে না?
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments