সব 'স্বপ্নই' 'দিবাস্বপ্ন' নয় by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ
নের সঙ্গে ভারতের প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা আজকে নতুন নয়। এর ইতিহাস অনেক দিনের। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর দেশ দুটির রেষারেষি তীব্র আকার ধারণ করে এবং তাদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে পড়ে সব ক্ষেত্রে। আজ তারা সামরিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ইতিহাস, ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও তারা কেউ কারো কাছে হার মানতে রাজি নয়।
প্রতিযোগিতা হলেই যে এটা ক্ষতিকর বা অস্বাস্থ্যকর তা কিন্তু বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে তো নয়ই। চীন-ভারত প্রতিযোগিতা ও জেদাজেদির কারণে দুই দেশই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। সীমান্ত উত্তেজনার সময় আন্তর্জাতিক এবং দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি যদি সমরবিদদের সফলভাবে সামলাতে পারে, তাহলে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আমি খারাপ কিছু দেখি না। বরং উভয় দেশের জনগণের জন্য এটা ভালো।
চীন-ভারত প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের ধরে মাত্র সেদিন ১৪ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা 'দিবাস্বপ্ন' শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয় ছেপেছে। ওই নিবন্ধে সম্পাদক মহোদয়ের বক্তব্য সংক্ষেপে নিম্নরূপ। তিনি বলেছেন, আজকাল চীনের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিযোগিতা যেন একটি জাতীয় ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী সবাই সব সময়ই 'চীন-ভারতকে' একই বন্ধনীতে এমনভাবে উচ্চারণ করছেন যেন দেশ দুটি সমগোত্রীয় হয়ে গেছে। এত সব দেখে আনন্দবাজারের মনে হচ্ছে, নতুন শতাব্দীর শুরুতে 'হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই' স্লোগান যেন পুনর্জীবন লাভ করল। পত্রিকা সম্পাদক আরো বলেছেন, রাজপথের রাজনৈতিক বক্তৃতায় কিংবা টিভি টক শোতে চললেও পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে চীন-ভারতের সমগোত্রীয় বিবেচনা একেবারেই চলে না। তাঁর মতে, 'কোথায় চীন আর কোথায় ভারত।' আইএমএফের তথ্য সূত্র ধরে তিনি লিখেছেন, ভারতের জিডিপি যেখানে দুই লাখ কোটি ডলারের নিচে, সেখানে চীনের অর্থনীতি সাত লাখ কোটি ডলারের কাছাকাছি। অর্থনীতিতে প্রায় চার গুণ শক্তিশালী একটি দেশের সঙ্গে সব সময় তুলনা করা একটা বেকুবি ছাড়া আর কিছু নয়।
আধুনিক ভারত ও চীনের মধ্যকার মিল-অমিলের তুলনামূলক আলোচনা অনেকভাবেই হতে পারে, কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের একটি ক্ষেদোক্তির সূত্র ধরে মাত্র একটি তুলনাই করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্র্রতিক দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ভারত চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।' কারণ স্বরূপ আনন্দবাজার সম্পাদক বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ভারতের সরকারি বিনিয়োগ প্রতিপক্ষ দেশের চেয়ে অনেক কম। ভারত এ খাতে প্রতিবছর বরাদ্দ করে থাকে তার জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশ। ডলারের হিসাবে এটা দাঁড়ায় মাত্র এক হাজার ৬৫০ কোটিতে। পক্ষান্তরে চীন এ খাতে বিনিয়োগ করে তার জিডিপির দুই শতাংশ এবং এখানেই শেষ নয়, তারা এই অঙ্ক অচিরেই বাড়িয়ে তিন শতাংশ করার পথে। অন্যদিকে ভারত তার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, ২০১৭ সালে বিজ্ঞান গবেষণায় বরাদ্দ দেবে জিডিপির দুই শতাংশ। বর্তমানে ভারতের এক হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের বিপরীতে চীন এ খাতে বিনিয়োগ করে থাকে ১৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। একটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির ধারা নির্ভর করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বর্তমান বিনিয়োগের ওপর। তাই আনন্দবাজারের মতে, এমতাবস্থায় ভারত কোনো দিনই প্রতিযোগিতায় চীনের ধারেকাছে যেতে পারবে না, চীনকে অতিক্রম করার তো প্রশ্নই ওঠে না। এই বলে আনন্দবাজার সম্পাদক 'চীন-ভারত' প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে একটি 'দিবাস্বপ্ন' বলে আখ্যায়িত করেছেন।
স্থূল অর্থে, আনন্দবাজারের সঙ্গে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ এটা ঠিক, অলৌকিক কোনো ঘটনা না ঘটলে অদূর এমনকি সুদূর ভবিষ্যতেও ভারত চীনের কাছে যেতে পারবে না। তথাপি সার্বিক অর্থে এ তুলনাই শেষ কথা নয় এবং এ উপসংহারই চূড়ান্ত নয়। কথা আরো আছে এবং ভারতের জন্য হতাশারও তেমন কিছু নেই। এখানে আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় মন্তব্যে ব্যবহৃত তথ্যের একটু ব্যাখ্যাও প্রয়োজন। চীনের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক পার্থক্যটা আইএমএফ যত বড় করে দেখিয়েছে, আসলে সেটা তত বড় নয়। আইএমএফের অঙ্কগুলো নমিনাল। প্রকৃত তুলনা করা উচিত পিপিপি অ্যাডজাস্টেড জিডিপি দিয়ে। সেই হিসাবে চীনের পিপিপি অ্যাডজাস্টেড জিডিপি যেখানে ১০ লাখ কোটি, সেখানে ভারতের চার লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ চীনের অর্থনীতি ভারতের আড়াই গুণ, চার গুণ নয়।
প্রতিযোগিতায় ভারত চীনকে টপকাতে না পারলেও চীনের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এটাও ভারতের জন্য কম বড় প্রাপ্তি নয়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আমি আরো কিছু পরিসংখ্যান আলোচনায় নিয়ে আসতে চাই। সম্প্রতি সেন্টার ফর ইকোনমিঙ্ অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তির তালিকায় এখন ব্রিটেনকে সরিয়ে ষষ্ঠ স্থান দখল করে ফেলেছে ব্রাজিল। এই প্রথমবারের মতো ব্রাজিল একটি প্রাচীন ও প্রধান শিল্পোন্নত ইউরোপীয় দেশকে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় হারাল। ২০১০-১১ সালে গড়ে প্রতিবছর ব্রাজিলের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৫ শতাংশ করে। অন্যদিকে ২০০৭-০৮ সালের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস এবং পরবর্তীকালে মন্দার কারণে ব্রিটিশ অর্থনীতি বলতে গেলে একেবারেই এগোতে পারেনি। আর তাই যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নেমে এলো ষষ্ঠ থেকে সপ্তম স্থানে। বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা যদি এভাবে অব্যাহত থাকে, তবে সিইবিআরের ধারণা, ১০ বছরের মধ্যে ব্রাজিল ষষ্ঠ স্থানেই থাকবে, কিন্তু রাশিয়া এবং ভারত, জার্মানি ও ফ্রান্সকে টপকিয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান দখল করে নেবে। আমার মতে, এখানে সিইবিআরের পর্যালোচনায় ১০ বছর সময় একটু কম দেখানো হয়েছে। সিইবিআরের এ প্রক্ষালনের জন্য ১০ বছরের পরিবর্তে ২০ বছর অধিক বাস্তবসম্মত সময়। যা-ই হোক, অর্থনীতির আকার অনুযায়ী তখন বড় দেশগুলোর ক্রমিক অবস্থান হবে এরূপ_মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া, তার পরেই আসবে ভারতের স্থান। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভারত চীনকে ছুঁতে না পারলেও জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে বিশ্বের পঞ্চম শক্তিধর অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারবে, সেটাই বা কম কি? এই যদি হয় ভারতের স্বপ্ন, তাহলে আমি এটাকে 'স্বপ্নই' বলব, কোনোক্রমেই 'দিবাস্বপ্ন' বলব না।
তবে এখানে ভারতকে আরেকটি কথা খেয়াল রাখতে হবে। সার্বিক অর্থনীতির আকার বড় হলেই কেল্লা ফতে হয়ে গেল না। ভারতের অর্থনীতি জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা ইংল্যান্ডের চেয়ে বড় হলেও একজন সাধারণ ভারতীয়ের জীবনযাত্রা এবং জীবনমান একজন সাধারণ জার্মান, ফরাসি কিংবা ব্রিটিশের চেয়ে কোনো অংশে উন্নত হবে না। কারণ প্রাক্কলিত সময়ে তাদের দেশীয় অর্থনীতি ভারতের চেয়ে ছোট হলেও লোকসংখ্যার স্বল্পতা হেতু তাদের মাথাপিছু গড় আয় ভারতীয়দের থেকে থাকবে অনেক বেশি। এ ছাড়া একজন ভারতীয়ের পক্ষে একজন ইউরোপীয়র মতো খরচের অভ্যাস গড়ে তুলতে সময় লাগবে যুগ যুগ। তাই আজকের নিবন্ধ শেষ করছি এভাবে। 'সেদিন অনেক দূরে, যেদিন একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের বৈঠকখানায় শোভা পাবে একটি ৪২ ইঞ্চি এলসিডি টিভি এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে একটি এঙ্ বঙ্ ও ঘরের কোণে সাজানো থাকবে ডজনখানেক ননপাইরেটেড অরিজিনাল ভিডিও গেইম।' সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভারত ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেলেও সার্বিক জীবনযাত্রার মানে ইউরোপ ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর_জার্নাল অব ডেভেলপিং অ্যারিয়াজ
Email: awahid2569@gmail.com
চীন-ভারত প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের ধরে মাত্র সেদিন ১৪ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা 'দিবাস্বপ্ন' শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয় ছেপেছে। ওই নিবন্ধে সম্পাদক মহোদয়ের বক্তব্য সংক্ষেপে নিম্নরূপ। তিনি বলেছেন, আজকাল চীনের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিযোগিতা যেন একটি জাতীয় ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী সবাই সব সময়ই 'চীন-ভারতকে' একই বন্ধনীতে এমনভাবে উচ্চারণ করছেন যেন দেশ দুটি সমগোত্রীয় হয়ে গেছে। এত সব দেখে আনন্দবাজারের মনে হচ্ছে, নতুন শতাব্দীর শুরুতে 'হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই' স্লোগান যেন পুনর্জীবন লাভ করল। পত্রিকা সম্পাদক আরো বলেছেন, রাজপথের রাজনৈতিক বক্তৃতায় কিংবা টিভি টক শোতে চললেও পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে চীন-ভারতের সমগোত্রীয় বিবেচনা একেবারেই চলে না। তাঁর মতে, 'কোথায় চীন আর কোথায় ভারত।' আইএমএফের তথ্য সূত্র ধরে তিনি লিখেছেন, ভারতের জিডিপি যেখানে দুই লাখ কোটি ডলারের নিচে, সেখানে চীনের অর্থনীতি সাত লাখ কোটি ডলারের কাছাকাছি। অর্থনীতিতে প্রায় চার গুণ শক্তিশালী একটি দেশের সঙ্গে সব সময় তুলনা করা একটা বেকুবি ছাড়া আর কিছু নয়।
আধুনিক ভারত ও চীনের মধ্যকার মিল-অমিলের তুলনামূলক আলোচনা অনেকভাবেই হতে পারে, কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের একটি ক্ষেদোক্তির সূত্র ধরে মাত্র একটি তুলনাই করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্র্রতিক দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ভারত চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।' কারণ স্বরূপ আনন্দবাজার সম্পাদক বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ভারতের সরকারি বিনিয়োগ প্রতিপক্ষ দেশের চেয়ে অনেক কম। ভারত এ খাতে প্রতিবছর বরাদ্দ করে থাকে তার জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশ। ডলারের হিসাবে এটা দাঁড়ায় মাত্র এক হাজার ৬৫০ কোটিতে। পক্ষান্তরে চীন এ খাতে বিনিয়োগ করে তার জিডিপির দুই শতাংশ এবং এখানেই শেষ নয়, তারা এই অঙ্ক অচিরেই বাড়িয়ে তিন শতাংশ করার পথে। অন্যদিকে ভারত তার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, ২০১৭ সালে বিজ্ঞান গবেষণায় বরাদ্দ দেবে জিডিপির দুই শতাংশ। বর্তমানে ভারতের এক হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের বিপরীতে চীন এ খাতে বিনিয়োগ করে থাকে ১৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। একটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির ধারা নির্ভর করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বর্তমান বিনিয়োগের ওপর। তাই আনন্দবাজারের মতে, এমতাবস্থায় ভারত কোনো দিনই প্রতিযোগিতায় চীনের ধারেকাছে যেতে পারবে না, চীনকে অতিক্রম করার তো প্রশ্নই ওঠে না। এই বলে আনন্দবাজার সম্পাদক 'চীন-ভারত' প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে একটি 'দিবাস্বপ্ন' বলে আখ্যায়িত করেছেন।
স্থূল অর্থে, আনন্দবাজারের সঙ্গে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ এটা ঠিক, অলৌকিক কোনো ঘটনা না ঘটলে অদূর এমনকি সুদূর ভবিষ্যতেও ভারত চীনের কাছে যেতে পারবে না। তথাপি সার্বিক অর্থে এ তুলনাই শেষ কথা নয় এবং এ উপসংহারই চূড়ান্ত নয়। কথা আরো আছে এবং ভারতের জন্য হতাশারও তেমন কিছু নেই। এখানে আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় মন্তব্যে ব্যবহৃত তথ্যের একটু ব্যাখ্যাও প্রয়োজন। চীনের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক পার্থক্যটা আইএমএফ যত বড় করে দেখিয়েছে, আসলে সেটা তত বড় নয়। আইএমএফের অঙ্কগুলো নমিনাল। প্রকৃত তুলনা করা উচিত পিপিপি অ্যাডজাস্টেড জিডিপি দিয়ে। সেই হিসাবে চীনের পিপিপি অ্যাডজাস্টেড জিডিপি যেখানে ১০ লাখ কোটি, সেখানে ভারতের চার লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ চীনের অর্থনীতি ভারতের আড়াই গুণ, চার গুণ নয়।
প্রতিযোগিতায় ভারত চীনকে টপকাতে না পারলেও চীনের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এটাও ভারতের জন্য কম বড় প্রাপ্তি নয়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আমি আরো কিছু পরিসংখ্যান আলোচনায় নিয়ে আসতে চাই। সম্প্রতি সেন্টার ফর ইকোনমিঙ্ অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তির তালিকায় এখন ব্রিটেনকে সরিয়ে ষষ্ঠ স্থান দখল করে ফেলেছে ব্রাজিল। এই প্রথমবারের মতো ব্রাজিল একটি প্রাচীন ও প্রধান শিল্পোন্নত ইউরোপীয় দেশকে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় হারাল। ২০১০-১১ সালে গড়ে প্রতিবছর ব্রাজিলের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৫ শতাংশ করে। অন্যদিকে ২০০৭-০৮ সালের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস এবং পরবর্তীকালে মন্দার কারণে ব্রিটিশ অর্থনীতি বলতে গেলে একেবারেই এগোতে পারেনি। আর তাই যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নেমে এলো ষষ্ঠ থেকে সপ্তম স্থানে। বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা যদি এভাবে অব্যাহত থাকে, তবে সিইবিআরের ধারণা, ১০ বছরের মধ্যে ব্রাজিল ষষ্ঠ স্থানেই থাকবে, কিন্তু রাশিয়া এবং ভারত, জার্মানি ও ফ্রান্সকে টপকিয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান দখল করে নেবে। আমার মতে, এখানে সিইবিআরের পর্যালোচনায় ১০ বছর সময় একটু কম দেখানো হয়েছে। সিইবিআরের এ প্রক্ষালনের জন্য ১০ বছরের পরিবর্তে ২০ বছর অধিক বাস্তবসম্মত সময়। যা-ই হোক, অর্থনীতির আকার অনুযায়ী তখন বড় দেশগুলোর ক্রমিক অবস্থান হবে এরূপ_মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া, তার পরেই আসবে ভারতের স্থান। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভারত চীনকে ছুঁতে না পারলেও জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ব্রাজিলকে পেছনে ফেলে বিশ্বের পঞ্চম শক্তিধর অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারবে, সেটাই বা কম কি? এই যদি হয় ভারতের স্বপ্ন, তাহলে আমি এটাকে 'স্বপ্নই' বলব, কোনোক্রমেই 'দিবাস্বপ্ন' বলব না।
তবে এখানে ভারতকে আরেকটি কথা খেয়াল রাখতে হবে। সার্বিক অর্থনীতির আকার বড় হলেই কেল্লা ফতে হয়ে গেল না। ভারতের অর্থনীতি জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা ইংল্যান্ডের চেয়ে বড় হলেও একজন সাধারণ ভারতীয়ের জীবনযাত্রা এবং জীবনমান একজন সাধারণ জার্মান, ফরাসি কিংবা ব্রিটিশের চেয়ে কোনো অংশে উন্নত হবে না। কারণ প্রাক্কলিত সময়ে তাদের দেশীয় অর্থনীতি ভারতের চেয়ে ছোট হলেও লোকসংখ্যার স্বল্পতা হেতু তাদের মাথাপিছু গড় আয় ভারতীয়দের থেকে থাকবে অনেক বেশি। এ ছাড়া একজন ভারতীয়ের পক্ষে একজন ইউরোপীয়র মতো খরচের অভ্যাস গড়ে তুলতে সময় লাগবে যুগ যুগ। তাই আজকের নিবন্ধ শেষ করছি এভাবে। 'সেদিন অনেক দূরে, যেদিন একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের বৈঠকখানায় শোভা পাবে একটি ৪২ ইঞ্চি এলসিডি টিভি এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে একটি এঙ্ বঙ্ ও ঘরের কোণে সাজানো থাকবে ডজনখানেক ননপাইরেটেড অরিজিনাল ভিডিও গেইম।' সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভারত ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেলেও সার্বিক জীবনযাত্রার মানে ইউরোপ ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর_জার্নাল অব ডেভেলপিং অ্যারিয়াজ
Email: awahid2569@gmail.com
No comments