এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার-বেকারত্বের চাপ মোকাবিলায় শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য

জাতীয় ও বৈশ্বিক কর্মসংস্থান নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলো: বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছে। এই চাপ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের করণীয় কী?
ফজলুল হক: বেকারত্ব মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের যে একটি সর্বাত্মক পরিকল্পনা রয়েছে, তা বলা যাবে না।


তবে শিল্প-ব্যবসার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বেসরকারি খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তথা বেকারত্ব মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে। যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, যখন শিল্পকারখানা তৈরি হয়, তখন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, মানবসম্পদের প্রয়োজন হয়। আর সেই প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যমে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশে এখন বেসরকারি খাতই কিন্তু কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।
প্রথম আলো: সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, গত তিন বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা অন্তত পাঁচ লাখ বেড়েছে। তাহলে কি বেসরকারি খাত কাজ দিতে পারছে না?
ফজলুল হক: আসলে বেসরকারি খাত বহু ক্ষেত্রেই তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে শ্রমশক্তি পাচ্ছে না। আজকে আমরা যখন বিশ্বায়নের যুগে সারা দুনিয়ার সঙ্গে তাল রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য করছি, তখন শ্রমশক্তির গুণগত মানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ জন্য দক্ষ ও কুশলী হতে হবে। আমাদের এখানে এই জায়গাটিতে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটা ঠিক যে, কাজ করে অভিজ্ঞতা ও কর্ম-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা-কুশলতা বাড়ে। কিন্তু একটা ভালো ভিত্তি ছাড়া শুরু করলে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া কঠিন। বিশেষ করে কারিগরি জ্ঞান ও কুশলতার অভাব প্রকট।
প্রথম আলো: এটা কেন হচ্ছে? আর এ থেকে উত্তরণেরই বা উপায় কী?
ফজলুল হক: এর মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ। অনেক ক্ষেত্রেই পাঠ্যক্রমগুলো যুগোপযোগী নয়। শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছে না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণমানে ভালো—এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সীমিত। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বা উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কাজ পায় না। কারিগরি শিক্ষার অবস্থা আরও খারাপ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো প্রায় পুরোটাই সরকারিভাবে পরিচালিত। তবে মান উন্নয়নের দিকে নজর খুব কম। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎপাদনমুখী করা ছাড়া বিকল্প নেই। সরকারকে এই কাজটি দ্রুত করতে হবে। বেসরকারি খাত এ জন্য সহযোগিতা দেবে। আসলে সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টাতেই কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো: ডিসেন্ট ওয়ার্ক বা শোভন কাজের বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) অনেক দিন ধরেই বলে আসছে। নিয়োগদাতা হিসেবে আপনারা এ বিষয়ে কতটা সচেষ্ট ও সচেতন?
ফজলুল হক: ডিসেন্ট ওয়ার্কের মূল বিষয়টি হলো একটি সুস্থ ও সুুষ্ঠু কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে আমরা এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে কাজ করছি। বিভিন্ন খাতে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। কেননা, কাজের পরিবেশ ভালো হলে কাজটাও ভালো হয়, শ্রমিক-কর্মী ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এটা গোটা উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় শতভাগ ডিসেন্ট ওয়ার্ক প্রত্যাশা করা যায় না। আমরা এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে রাতারাতি হবে না।
প্রথম আলো: আইএলও বলেছে, আগামী এক দশকে ৬০ কোটি লোকের কর্মসংস্থান করতে হবে। বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের এই চ্যালেঞ্জ আমাদের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে?
ফজলুল হক: আসলে বাংলাদেশের জন্যও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে এটা আরও বাড়বে। কেননা, প্রযুক্তিগত বিকাশের প্রভাবে কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। মানে, কৃষি খাতে কর্মসংস্থান খুব একটা বাড়ার সুযোগ কম। সে ক্ষেত্রে সেবা খাতে কাজের সুযোগ তৈরির চাপ বাড়বে। কিন্তু প্রতিবছর গড়ে ২২ লাখ মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টির যে চাপ এখন বাংলাদেশে রয়েছে, তা মোকাবিলা করতে হলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির দিকেই সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ, যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত সংকট শিল্প খাতের বিকাশে বড় বাধা হয়ে উঠেছে। সরকারের এদিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে, সামাজিক বৈষম্য বেড়ে যাবে।
[সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসজাদুল কিবরিয়া]

No comments

Powered by Blogger.