পরিবর্তন-খালেদা জিয়া ও আমাদের বিএনপি-ভাবনা by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
এই কিছুদিন আগে ঈদ উপলক্ষে বেগম খালেদা জিয়া আমাদের জানিয়ে দিলেন যে দেশবাসী ভালো অবস্থায় নেই এবং তাদের এ অবস্থার কারণে তিনিও ভালো নেই। এরই মধ্যে আবার তাঁর দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলে দিলেন যে সরকার পরিবর্তন ছাড়া দেশ সংকটমুক্ত হবে না। অবশ্য
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কথাটা বললেন আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ইদানীংকালের একটি মন্তব্যের সূত্র ধরে। সেনগুপ্ত তাঁর নিজ দলীয় সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে যে এই মুহূর্তে কোনো রদবদল না হলে, কোনো পুনর্মূল্যায়ন না হলে সরকারকে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতার এ কথাগুলোই আমরা সবাই বিভিন্নভাবে বলে আসছি একেবারে খোলাখুলিভাবে। কোন মন্ত্রীকে বাদ দিতে হবে, কোন মন্ত্রী সর্বদা বিদেশ সফর করতে ব্যস্ত, কোন মন্ত্রী শ্রমিক নেতার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন, কোন সাংসদ নিজ এলাকায় জমি দখল করে নিচ্ছেন—এসব বিষয়ে কয়েক মাস ধরে লেখালেখি হচ্ছে। মনে হয় না ওই লেখাগুলো সরকারি মহলে পড়া হয়। হয়ে থাকলেও সরকার এসব বিষয় ভালো চোখে দেখে না। এর পেছনেও একটি নেতিবাচক ঐতিহ্য রয়েছে। আর তা হলো এই যে আমাদের দেশে সব সরকারই মনে করেছে যে তাদের চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ আর কেউ নেই। তাঁরাই জানেন এবং বোঝেন। কোনো সরকারপ্রধান কিংবা কোনো মন্ত্রী কোনো ভুল করতে পারেন না। আগের মতো আজকালও আমরা লক্ষ করছি, কী করে পদের অমর্যাদা করে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী নিজেদের পারিবারিক ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে ব্যস্ত। এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। এতে সরকার বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। মন্ত্রী বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আর এক মন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সেই বিষয়েও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সেই পুরোনো ধারার তদন্ত চলছে। তদন্তের পর আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে কি চলবে না, এই প্রশ্ন আবার জনমনে জেগে উঠেছে।
হ্যাঁ, বেগম জিয়া ঠিকই বলেছেন, আমরা কেউ ভালো অবস্থায় নেই। আগেও ভালো ছিলাম না, এখনো নেই। আর আসছে দিনগুলোতে হঠাৎ একটি ভালো ধরনের পরিবর্তন আমাদের জীবনে আসবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অবশ্য বেগম জিয়া ও তাঁর দলীয় নেতারা আমাদের সব সময়ই ধারণা দিয়ে এসেছেন যে তাঁরা আবার ক্ষমতায় ফিরে গেলেই সব দুঃখ আমাদের দূর হয়ে যাবে। তাঁরা এটা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন যে আমাদের জাতীয় জীবনে বর্তমানে যে সংকট বিরাজমান তার জন্য বহুলাংশে দায়ী তাঁদেরই দল ও সরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয় এবং প্রায়ই সরকারি দল পরাজিত হয়ে বিরোধী দলে রূপান্তরিত হয়। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম এবং পরাজিত হওয়ার পর একটি দল জরুরি ভিত্তিতে নিজেকে এবং তার নীতিকে পুনর্মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হয়। গণতন্ত্র হচ্ছে একটি অভিজ্ঞতা এবং এই অভিজ্ঞতার মঞ্চ দিয়ে একটি জাতি, একটি দল সর্বদাই নতুন শিক্ষা লাভ করে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতে হয় যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার শীর্ষস্থানীয় নেতারা এই শিক্ষা রপ্ত করতে পারেননি। দলটি জাতীয় সংসদ বর্জন করে চলেছে। দলের সাংসদদের যে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার প্রতি একটি দায়িত্ব রয়েছে, এই ব্যাপারে তাঁদের বিবেক বিন্দুমাত্র নাড়া দেয় না। আত্মসম্মানবোধ বলে একটি কথা আছে। আপনি-আমি যদি অনুভব করি যে আমাদের কর্মস্থলের প্রতি আমাদের আস্থা নেই, তখন আমরা স্বেচ্ছায় সেই কর্মস্থল ত্যাগ করব। কাজ করব না অথচ বেতন-ভাতা নিতেই থাকব—এমনটি তো হয় না। হলে তা মহা লজ্জার বিষয় হবে। তাই বেগম জিয়া যখন বলেন দেশ ভালো অবস্থায় নেই, তখন আমাদের কেবল একটি প্রশ্ন তাঁর উদ্দেশে—আপনি তো দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কি দেশ ভালো অবস্থায় ছিল? আমরা তো দেখেছি কী করে ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির ফলে গোটা জাতি এক নতুন সংকটের সম্মুখীন হলো। যখন বিএনপি পুনরায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় এল তখন আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে এই দফায় বেগম জিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা আগের তুলনায় আরও সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা করবেন। তা তো হলোই না, বরং নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দেশের সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে ফেললেন। বহু হিন্দু পরিবার একেবারে সেই পুরোনো পাকিস্তানি কায়দায় আক্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাঁদের নিজ গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সম্মানিত রাজনীতিবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটকথা বাঙালি জাতি ২০০১ সালে আবার অন্ধকারে পতিত হয়েছে।
বেগম জিয়া ও তাঁর দলের বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে এসব ঘটনা এবং আরও অনেক ঘটনার জন্য দুঃখ ও অনুতাপ প্রকাশ করা উচিত ছিল। যেকোনো আধুনিক মানের রাজনৈতিক দল এমনটিই করে থাকে, বিশেষ করে যদি সে দল আবার ক্ষমতায় যেতে চায়। এই প্রথাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয়, রি-ইনভেনশন। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই কাজ রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই করে থাকে। এমনকি আমাদের এই বাংলাদেশেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ অতীতের ভুল-ত্রুটির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। বিএনপি সেটা কোনো দিন করেনি। উল্টো এমন ধারণা দিয়েছেন দলের নেতারা যে বিজয় তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিগত নির্বাচনের পর প্রায় তিন বছর চলে গেল, কিন্তু বিএনপি এখনো আমাদের বলেনি কেন তাদের শাসনামলে এক কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিল বিচারপতি এম এ আজিজ পরিচালিত নির্বাচন কমিশন। আমাদের জানানো হয়নি কী করে ওই সময়কার যোগাযোগমন্ত্রী তাঁর স্ত্রীর মানবাধিকার সংস্থার নামে সরকারি রেলওয়ের জমি বরাদ্দ করেছিলেন। মন্ত্রিসভায় ১৯৭১ সালের চিহ্নিত রাজাকারদের ঠাঁই দিয়ে যে গোটা বাঙালি জাতিকে এবং তার ইতিহাসকে অপমান করা হলো, সেই কথা কি বেগম জিয়া আজ পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারেননি? বেগম জিয়ার পরিবার ও বিএনপির বিভিন্ন শ্রেণীর নেতা-কর্মী কী করে দুঃশাসন চালিয়েছেন এবং দুর্নীতিতে লিপ্ত রয়েছেন, সেই সত্যগুলো তো আমরা ভুলিনি। বেগম জিয়া আজকাল নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তিহীনভাবে। তিনি কি ভুলে গেছেন তাঁর সময়কার নির্বাচন কমিশন কী অভিনব পদ্ধতিতে পুরো জাতিকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছিল? আমরা সবাই জানি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কী কী ভুল করে যাচ্ছে এবং এই সরকারের দণ্ড কতটা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারকে আমরা কেউ কোনো রকমের স্থান দিচ্ছি না। কিন্তু এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই, আমাদের মনে বিশ্বাস জেগেছে যে বিএনপি ফিরে এলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দলটির অতীতের শাসনামল আমাদের কোনো রকম উৎসাহ দেয় না। বিগত বিএনপি সরকার দেশের সংবিধানে অসত্যের অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে বলতে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, যখন আমরা জানি তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে—একটি রাজনৈতিক দল এ ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেবে কেন?
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে এলেই জাতি তার সামনে আশার আলো দেখতে পাবে, এমনটি ভেবে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে দল এখনো স্পষ্ট ও ইতিহাসমুখী কোনো অবস্থান নেয়নি। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাঁরা নির্বাক কেন? কেনই বা তাঁরা এমন একটি দলে থাকবেন যে দল মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের মধ্যে কোনো পার্থক্যও দেখে না? যে দল ১৯৭১-এর রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে বিশ্বাস রাখে না, সেই দলকে কী করে একজন ইতিহাস-সচেতন বাঙালি, একজন জ্ঞানী মানুষ, একজন মুক্তিযোদ্ধা সমর্থন দেবেন?
হ্যাঁ, দেশে সংকট রয়েছে। কিন্তু সেই সংকট নিরসনের দায়িত্ব বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল পালন করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে আমাদের সবার সন্দেহ রয়েছে। আর এদিকে আওয়ামী লীগও প্রায় ভুলতে বসেছে যে যদি সরকার একের পর এক ভুল করে যায় তাহলে আগামী নির্বাচনে পরাজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা খুব একটা দুরূহ ব্যাপার হবে না। সেই পরাজয় এলে জাতি হিসেবে আমরা সবাই কি পরাজিত হব না? আমাদের ইতিহাস কি আর এক দফা পরাজিত হবে না?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
হ্যাঁ, বেগম জিয়া ঠিকই বলেছেন, আমরা কেউ ভালো অবস্থায় নেই। আগেও ভালো ছিলাম না, এখনো নেই। আর আসছে দিনগুলোতে হঠাৎ একটি ভালো ধরনের পরিবর্তন আমাদের জীবনে আসবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অবশ্য বেগম জিয়া ও তাঁর দলীয় নেতারা আমাদের সব সময়ই ধারণা দিয়ে এসেছেন যে তাঁরা আবার ক্ষমতায় ফিরে গেলেই সব দুঃখ আমাদের দূর হয়ে যাবে। তাঁরা এটা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন যে আমাদের জাতীয় জীবনে বর্তমানে যে সংকট বিরাজমান তার জন্য বহুলাংশে দায়ী তাঁদেরই দল ও সরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয় এবং প্রায়ই সরকারি দল পরাজিত হয়ে বিরোধী দলে রূপান্তরিত হয়। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম এবং পরাজিত হওয়ার পর একটি দল জরুরি ভিত্তিতে নিজেকে এবং তার নীতিকে পুনর্মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হয়। গণতন্ত্র হচ্ছে একটি অভিজ্ঞতা এবং এই অভিজ্ঞতার মঞ্চ দিয়ে একটি জাতি, একটি দল সর্বদাই নতুন শিক্ষা লাভ করে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতে হয় যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার শীর্ষস্থানীয় নেতারা এই শিক্ষা রপ্ত করতে পারেননি। দলটি জাতীয় সংসদ বর্জন করে চলেছে। দলের সাংসদদের যে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার প্রতি একটি দায়িত্ব রয়েছে, এই ব্যাপারে তাঁদের বিবেক বিন্দুমাত্র নাড়া দেয় না। আত্মসম্মানবোধ বলে একটি কথা আছে। আপনি-আমি যদি অনুভব করি যে আমাদের কর্মস্থলের প্রতি আমাদের আস্থা নেই, তখন আমরা স্বেচ্ছায় সেই কর্মস্থল ত্যাগ করব। কাজ করব না অথচ বেতন-ভাতা নিতেই থাকব—এমনটি তো হয় না। হলে তা মহা লজ্জার বিষয় হবে। তাই বেগম জিয়া যখন বলেন দেশ ভালো অবস্থায় নেই, তখন আমাদের কেবল একটি প্রশ্ন তাঁর উদ্দেশে—আপনি তো দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কি দেশ ভালো অবস্থায় ছিল? আমরা তো দেখেছি কী করে ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির ফলে গোটা জাতি এক নতুন সংকটের সম্মুখীন হলো। যখন বিএনপি পুনরায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় এল তখন আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে এই দফায় বেগম জিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা আগের তুলনায় আরও সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা করবেন। তা তো হলোই না, বরং নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দেশের সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে ফেললেন। বহু হিন্দু পরিবার একেবারে সেই পুরোনো পাকিস্তানি কায়দায় আক্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাঁদের নিজ গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সম্মানিত রাজনীতিবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটকথা বাঙালি জাতি ২০০১ সালে আবার অন্ধকারে পতিত হয়েছে।
বেগম জিয়া ও তাঁর দলের বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে এসব ঘটনা এবং আরও অনেক ঘটনার জন্য দুঃখ ও অনুতাপ প্রকাশ করা উচিত ছিল। যেকোনো আধুনিক মানের রাজনৈতিক দল এমনটিই করে থাকে, বিশেষ করে যদি সে দল আবার ক্ষমতায় যেতে চায়। এই প্রথাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয়, রি-ইনভেনশন। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই কাজ রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই করে থাকে। এমনকি আমাদের এই বাংলাদেশেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ অতীতের ভুল-ত্রুটির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। বিএনপি সেটা কোনো দিন করেনি। উল্টো এমন ধারণা দিয়েছেন দলের নেতারা যে বিজয় তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিগত নির্বাচনের পর প্রায় তিন বছর চলে গেল, কিন্তু বিএনপি এখনো আমাদের বলেনি কেন তাদের শাসনামলে এক কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিল বিচারপতি এম এ আজিজ পরিচালিত নির্বাচন কমিশন। আমাদের জানানো হয়নি কী করে ওই সময়কার যোগাযোগমন্ত্রী তাঁর স্ত্রীর মানবাধিকার সংস্থার নামে সরকারি রেলওয়ের জমি বরাদ্দ করেছিলেন। মন্ত্রিসভায় ১৯৭১ সালের চিহ্নিত রাজাকারদের ঠাঁই দিয়ে যে গোটা বাঙালি জাতিকে এবং তার ইতিহাসকে অপমান করা হলো, সেই কথা কি বেগম জিয়া আজ পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারেননি? বেগম জিয়ার পরিবার ও বিএনপির বিভিন্ন শ্রেণীর নেতা-কর্মী কী করে দুঃশাসন চালিয়েছেন এবং দুর্নীতিতে লিপ্ত রয়েছেন, সেই সত্যগুলো তো আমরা ভুলিনি। বেগম জিয়া আজকাল নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তিহীনভাবে। তিনি কি ভুলে গেছেন তাঁর সময়কার নির্বাচন কমিশন কী অভিনব পদ্ধতিতে পুরো জাতিকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছিল? আমরা সবাই জানি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কী কী ভুল করে যাচ্ছে এবং এই সরকারের দণ্ড কতটা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারকে আমরা কেউ কোনো রকমের স্থান দিচ্ছি না। কিন্তু এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই, আমাদের মনে বিশ্বাস জেগেছে যে বিএনপি ফিরে এলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দলটির অতীতের শাসনামল আমাদের কোনো রকম উৎসাহ দেয় না। বিগত বিএনপি সরকার দেশের সংবিধানে অসত্যের অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে বলতে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, যখন আমরা জানি তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে—একটি রাজনৈতিক দল এ ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেবে কেন?
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে এলেই জাতি তার সামনে আশার আলো দেখতে পাবে, এমনটি ভেবে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে দল এখনো স্পষ্ট ও ইতিহাসমুখী কোনো অবস্থান নেয়নি। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাঁরা নির্বাক কেন? কেনই বা তাঁরা এমন একটি দলে থাকবেন যে দল মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের মধ্যে কোনো পার্থক্যও দেখে না? যে দল ১৯৭১-এর রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে বিশ্বাস রাখে না, সেই দলকে কী করে একজন ইতিহাস-সচেতন বাঙালি, একজন জ্ঞানী মানুষ, একজন মুক্তিযোদ্ধা সমর্থন দেবেন?
হ্যাঁ, দেশে সংকট রয়েছে। কিন্তু সেই সংকট নিরসনের দায়িত্ব বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল পালন করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে আমাদের সবার সন্দেহ রয়েছে। আর এদিকে আওয়ামী লীগও প্রায় ভুলতে বসেছে যে যদি সরকার একের পর এক ভুল করে যায় তাহলে আগামী নির্বাচনে পরাজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা খুব একটা দুরূহ ব্যাপার হবে না। সেই পরাজয় এলে জাতি হিসেবে আমরা সবাই কি পরাজিত হব না? আমাদের ইতিহাস কি আর এক দফা পরাজিত হবে না?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments