অবহেলিত জনপদের জন্য সুদিনের অপেক্ষা by তানজিনা হক বিয়াস
যদি আমি আঁকিয়ে হতাম তাহলে কষ্টের কী রঙ বা কোন রঙে কষ্টকে আঁকা যায় সেই ছবি এঁকে দেখাতাম সবাইকে। কল্পনা করুন, একজন মা কাঁদছেন তার পাঁচ মাসের শিশুকন্যাটি বুকে নিয়ে। শিশুটি শ্বাস নিচ্ছে তো ফেলতে পারছে না বা ফেলছে তো নিতে পারছে না, বুকটা খুব জোরে ওঠানামা করছে, নিউমোনিয়া হয়েছে, ছোট্ট এই মানুষটির বেঁচে থাকার কী সংগ্রাম! আবার কিছুক্ষণ পর শোনা গেল গ্রামের অন্য প্রান্তে আরেক মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
এ কষ্টের ছবি আমি কী রঙ দিয়ে আঁকব বলুন! আমি এই বাংলাদেশেরই একজন সাধারণ নাগরিক, কর্মের সুবাদে ঘুরে বেড়াই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ দেশের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষকে অনেক কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আমার আজ কথা বলা তাদের একাংশকে নিয়েই।
আমরা জানি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের দরিদ্রতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভূ-প্রকৃতিগত কারণে এ দেশের কিছু অঞ্চল সারা বছর মূল ভূখণ্ড থেকে সবসময় বা খণ্ডকালীন সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকে। আমার দেখা তেমনি এক বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হলো হাওর। বছরের ছয় থেকে সাত মাস ছোট ছোট ভূখণ্ড বা হাটিকে আগলে রাখে হাওরের টইটম্বুর পানি। বড় বড় ঢেউ (আফাল) হাটিকে করে আঘাত, ভাঙন ওই জনপদের মানুষের নিত্য বছরের সাথী, কেড়ে নেয় ঘরবাড়ি। প্রকৃতি তাদের করেছে বিপদাপন্ন, করেছে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আর সরকারি অব্যবস্থাপনা এবং আমরা তথাকথিত সুসভ্য মানুষেরা করেছি ওই বিপদাপন্ন মানুষদের সামাজিক ও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দু'মুঠো খাবারের সংস্থান হয় না যাদের, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু রক্ষা করতে ব্যস্ত যারা সর্বক্ষণ তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা অন্যান্য সামাজিক সুবিধার কথা ভাববার ফুরসত কোথায়! তবু ভাবনায় না আসুক, রোগশোক সবসময় তাড়া করে ফেরে তাদের দেহকে। এই অভাজনরা সব হারানোর কষ্টকে বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে, যেন ডারউইন তার 'যোগ্যতমের জয়' তত্ত্বটি এসব মানুষকে দেখেই দিয়েছেন।
প্রথমেই যে গ্রামের গল্পটি বললাম তার নাম রংপুরহাটি, ধরমপাশা উপজেলার একটি গ্রাম। মজার ব্যাপার হলো সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকে ধান শুকানো হয়, করা হয় কাঠ গুদামজাত, ডাক্তার সাহেব নামে কখনও কাউকে দেখা যায়নি কমিউনিটি ক্লিনিকে। ডিসপেনসারির ওষুধ বিক্রেতা ডাক্তার হিসেবে পরিচিত, দিয়ে থাকেন ব্যবস্থাপত্র আর ওষুধ। নবজাতক প্রথমেই দেখে অদক্ষ ধাত্রীর মুখ অথবা ধাত্রীর অদক্ষতার ফসল হিসেবে অভিমানী জননী তার মৃত সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। সেখানে মাতৃস্বাস্থ্যের কথা বা শিশুস্বাস্থ্যের কথা জানেন খুব অল্পজনেই এবং খুব কমই কেউ আসেন তাদের জানাতে এসব কথা। স্বাস্থ্যকর্মী বা পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের আসাও অনিয়মিত। এ তো গেল একটি গ্রামের গল্প। ইউনিয়ন থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতেও দেখা যায় বেহাল অবস্থা। শূন্য পদ রয়েছে কিন্তু কর্মকর্তা বা কর্মী নিয়োগ হয়নি। সেই উপজেলায় পরিকল্পিত একটি কমিউনিটি ক্লিনিকও চালু হয়নি। গত দু'মাসে হাওর অঞ্চলে চারটি জেলার চারটি উপজেলা দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। সবখানেই রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তাররা দুপুরের পর প্রাইভেট রোগী দেখেন। তারা আরও জানান, প্রাইভেট ব্যবস্থায় তুলনামূলক ভালো চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। 'একটা সুই (ইঞ্জেকশন) দিতে নার্স বেটি ৫০ টাকা খুঁজে, খারাপ ব্যবহার করে'_ জানালেন তারা। বাইরে থেকে কিনতে হয় ওষুধ, তাই সরকারি ডাক্তারের প্রাইভেট ব্যবস্থাই ভালো।
আমরা দাবি করছি মাতৃ মৃত্যুহার কমেছে, কমেছে শিশু মৃত্যুহার, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ কেমন এগিয়ে যাওয়া! কাকের মতো চোখ বন্ধ করে! আমরা কি পারি না তাদের এই কষ্ট প্রশমিত করতে! হাওর এলাকায় যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন তারা যদি এই অবহেলিত জনপদের কান্না আর হাহাকারকে জাতীয় সংসদে তুলে ধরেন তাহলেই সম্ভব, না হয় কোনোভাবেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা জানি স্থানীয় অনেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আছে যারা এসব মানুষের জীবিকার উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ করছে, যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। পাশাপাশি তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে, শূন্য পদ পূরণে, অঞ্চলের প্রেক্ষাপট উপযোগী বরাদ্দ ও নীতিমালা পরিবর্তনে সরকারের সঙ্গে পলিসি অ্যাডভোকেসি করতে পারেন এবং স্থানীয় সুশীল সমাজও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। অপরদিকে যারা সরকারিভাবে ওই অঞ্চলে কর্মরত, তারা যদি সেবার মন নিয়ে কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখেন তবেই সম্ভব অবহেলিত হাওর জনপদের মানুষের এসব কষ্ট প্রশমিত করা। জানি না আমার লেখা কারও মনে দাগ কাটবে কি-না। তবু সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
No comments