ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার পাট যেন চুকে না যায় by ডা. এম এ হাসান
একাত্তরে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম কেবল ক্ষোভ ও দ্রোহের কারণে নয়, জীবনের মুক্তি, সংস্কৃতির মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, একটি বিশাল সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে দেশকে মুক্ত করেছিলাম সেদিন। খেটে খাওয়া মানুষসহ সমষ্টির ভাগ্যোন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। যুক্তিভিত্তিক প্রেরণা, জাতিগত ঐক্য এবং সমষ্টিগত সহনশীলতা আমাদের পথ বেঁধে দিয়েছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই স্বাধীনতাযুদ্ধে সব মুক্তিসংগ্রামের মতো প্রতিবিপ্লবের ছায়া পড়ে। সমাজের সুবিধাবাদী অংশ মুক্তির অর্জন ও প্রাপ্তিগুলো দৃশ্যমান ভেবে নানা চক্রান্তে মেতে ওঠে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধকে তারা একটি আদর্শিক যুদ্ধে পরিণত হতে দেয়নি। জাতীয় দর্শন ও মূল্যবোধকেও মোটা দাগে পরিস্ফুটিত হতে দেয়নি। এতে আদর্শ ও মূল্যবোধ যেমন স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়নি ও লিখিতভাবে প্রক্ষেপিত হয়নি, তেমনি দুষ্টচক্রকে শৃঙ্খলে আনার কোনো প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দৃশ্যমান হয়নি। অথচ সাধারণ গণমানুষ, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সব মূল্য দিয়েছেন এবং সমাজের নারী, যাঁরা প্রাণের মূল্যে এবং সম্ভ্রমের মূল্যে স্বাধীনতা এনেছেন, তাঁরাই হয়েছেন অবহেলিত। এই সাধারণ জনগণকে কখনো আস্থায় আনা হয়নি, বিশ্বাসে নেওয়া হয়নি। শীতের পাখির মতো তাঁরা ফিরে গেছেন যাঁর যাঁর গৃহে। ইতিমধ্যে তাঁদের অর্জন এবং তাঁদের গৌরব লুণ্ঠন হয়ে গেছে। তাঁদের অসাধারণ প্রণোদনা, সৃষ্টিশীল কর্ম ও সীমাহীন ত্যাগ এবং সব উদ্ভাসিত স্বপ্ন এক হীমকৃষ্ণ অধ্যায়ে নিমজ্জিত হয়েছে। কিছু ব্যক্তি ও লুটেরা তাঁদের সব গৌরব ও অর্জন হরণ করেছে। এতে সাধারণ মানুষের অসাধারণ ত্যাগ কথার কথা হয়ে রইল এবং তাঁরা সবাই পরিণত হলেন নলখাগড়ায়। এর পরের ইতিহাস নলখাগড়ার কথা এবং তাঁদের কথা। সমষ্টির কথা আমরা এবং আমিত্বের ব্র্যাকেটে আবদ্ধ হলো। একটি জাতির বিশাল স্বপ্ন এবং অন্তহীন ত্যাগের শ্রেষ্ঠ গল্প এটি।
১৯৭১ সালের এপ্রিলে লালপুরে যুদ্ধ করে অথবা মার্চের শেষে এবং এপ্রিলের শুরুতে সরাইলের চুনটায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এবং বীরসেনারা আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করে স্থানীয় জনগণের যে ক্ষতি সাধন করেছি, তা পরিমাপ করতে আমার নিজের লেগেছিল প্রায় ১৫ বছর। আমার কর্মীদের লেগেছে প্রায় ৩০ বছর। দেশের প্রশাসন এবং বরণীয় ব্যক্তিরা এখনো সে জায়গাটি ছুঁতে পারেননি। অথচ চুনটায় ওই কারণে ২২ জন হিন্দু গণহত্যার শিকার হয়েছিল। আর লালপুরে নিহত পুরুষ এবং নির্যাতিত নারীর সংখ্যা কয়েক ডজন। আমি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে এ কথাগুলো বলছি।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ডাক্তারদের দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। খুব ভালো কাজ করেছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষপদ থেকে এমন ন্যায্য কথা যত বেশি উচ্চারিত হবে, যত বেশি তা কথার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কর্মে পরিণত হবে, তত বেশি ভালো কাজ হবে। এ ক্ষেত্রে আমার বিনীত পরামর্শ যে সবাইকে নিজের দায়টা বুঝতে হবে। কে কতটা সমাজ থেকে সুবিধা নিল, কে কতটা রাষ্ট্র থেকে গ্রহণ করল, কী পরিমাণ সুবিধা ও সম্মান ভোগ করল, তা সবাইকে মনে করতে হবে। যার যার স্থানে এই রাষ্ট্রীয় দায় ও সামাজিক দায় পরিশোধ করতে হবে। রাজনীতিবিদদের কথামালার রাজনীতি এবং নেপথ্যে বহুমুখী বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষককে বুঝতে হবে যে বিশাল ভূমির ওপর তাঁদের স্থাপনা বা বাসস্থল তার বাজারমূল্য কত, এর মাসিক বা বার্ষিক আয় কত হতে পারে। কর্মঘণ্টা অনুপাতে যে মাসিক বেতন ও অন্যান্য সুবিধা তাঁরা পান, রাষ্ট্রীয় খরচে যেসব বৃত্তি ভোগ করেন; সবেতন ও বিনা বেতনে বছরের পর বছর যে ছুটি ভোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন এনজিওসহ বেসরকারি যেসব সুবিধা ভোগ করেন, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেসব ফায়দা লোটেন_তার সব কিছু চিন্তা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চিন্তা করতে হবে তাদের স্কুলজীবনের শ্রম, ত্যাগ, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার কথা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাটোমিক অ্যাডজরপশন স্পেকট্রো ফটোমিটারসহ যেসব মূল্যবান যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে, তার কথা বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা এবং ভূমির মূল্য তথা শিক্ষকের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা চিন্তা করতে হবে।
প্রকৌশলীদের চিন্তা করতে হবে, তাঁরা কতজন সততার সঙ্গে কাজ করছেন এবং নৈতিকতার সঙ্গে মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু অবদান রেখেছেন।
একাত্তরের পর যে লুটেরা সমাজের উত্থান হয়, যে লুমপেন বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে, তার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের নিতে হবে। চৌর্যবৃত্তি এবং সামগ্রিক অসহিষ্ণুতাসহ বহুমুখী সন্ত্রাসের দায়ও রাজনীতিবিদদের। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, কৃষকের অর্জন, অভিবাসী শ্রমিকের অর্জনগুলোকে নিজেদের অর্জন বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা জনগণ ভালো চোখে দেখবে না। গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষকদের জীবনের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি যা দরকার, তা হলো শিক্ষা ও প্রযুক্তিজ্ঞানের বিস্তার। তাদের জীবনের মানোন্নয়নে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিদ্যুৎ ও নূ্যনতম অবকাঠামো নির্মাণ। এই অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন হতে পারে অর্থবোধক প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। বিকল্প শক্তি, বায়োগ্যাস, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদির ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন সহজ করা সম্ভব। আইটিকেন্দ্র এবং নগ্নপদ চিকিৎসকদের সাহায্যে পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা গেলে স্বাস্থ্যসেবাকে একেবারে তৃণমূল পর্যায় নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি রেডিও এবং মোবাইল টেকনোলজি স্বাস্থ্যসেবার প্রসারসহ সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিকল্প বিচার ও সমঝোতামূলক বিচারকে তৃণমূলে না নিতে পারলে সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। সমাজ ও সমষ্টির অংশীদারি ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত। রাজধানীতে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সেবা উন্নয়নে রাজনীতি থেকে সরে এসে সেবার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে মেডিক্যাল হাসপাতালের পরিধি বাড়িয়ে রোগীপ্রতি ওষুধের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। হাসপাতালের খরচ মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ১১টি মেডিসিন ইউনিটের প্রতিটি ইউনিটে প্রায় ৩০ জন অনারারি তথা অনাহারি চিকিৎসক দিনরাত কাজ করছেন। এবং রাজনৈতিকভাবে নিয়োজিত চিকিৎসকরা তৈলমর্দন ছাড়াও তদবির এবং অন্যান্য নিজস্ব কর্মে ব্যস্ত থাকেন। আর রোগীর ওষুধ চুরি করে যাচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর গ্যাংগুলো। পরিবর্তন প্রয়োজন সবার মন ও মানসিকতার।
আমার স্বর্গীয় পিতা, পিতৃব্য এবং পূর্বপুরুষরা শত বছর এই পেশায় জড়িত থাকার কারণে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রকৃত অবস্থা আমার নখদর্পণে। এখানে যারা মানুষ পেটায় এবং প্রকাশ্যে সন্ত্রাসে জড়িত হয় বা নেশা করে, তাদের অনেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ অধ্যাপকের পদগুলো অলংকৃত করে। এটা রাজনীতির খেলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পারবেন কি এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে? তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা আমার জানা। ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজের পরিবেশ যেমন সৃষ্টি করতে হবে, তেমনি যাতায়াতসহ বাসস্থান ও কর্মস্থান ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। ওষুধ ও নূ্যনতম পরীক্ষার ব্যবস্থাসহ সহকারীদের জন্য একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশু ও মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো। এ জন্য কিছু হরমোন টেস্টও জরুরি। সর্বোপরি সব সরকারি কর্মচারীকে একপর্যায়ে তৃণমূলে ঘুরিয়ে আনতে পারলে ভালো ফল হতে পারে। তবে এই ৯ মণ তেল জোগাতে মন্ত্রী ও সচিবরা কতটা পারঙ্গম তা দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী আদেশ দিলেই নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষক তিন মাস করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিস্তার ঘটাতে পারেন। আসুন, আমরা কিউবা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। ইতিহাস থেকে পাঠ নেওয়া খুব জরুরি। ইতিহাসের অধ্যায়গুলো মানুষের মূল্যবোধ ও চেতনার মধ্যে থাকুক। সমাজ বাজার এবং যথার্থ সমাজ অর্থনীতি (ড. ইউনূসের ভাবনার সমার্থক নয়) কেবল সাম্যবাদ সমর্থিত অর্থনীতি নয়, সমাজবান্ধব রাজনীতির বিকাশ ঘটাতে পারে। লুটেরাতন্ত্র এবং গ্লোবালাইজেশনের ফাঁদ থেকে সমাজকে মুক্ত করে নতুন পথ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে দেশের মেহনতি মানুষ, নারী এবং বিবেকবান গোষ্ঠী সাহসী হয়ে দ্রুত পথে নামবে_এটাই বিশ্বাস। আলো জ্বলুক ঘরে ঘরে। যে আগুন নিভে গেছে, সেই আগুন জ্বলে উঠুক আবার।
লেখক : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক
১৯৭১ সালের এপ্রিলে লালপুরে যুদ্ধ করে অথবা মার্চের শেষে এবং এপ্রিলের শুরুতে সরাইলের চুনটায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এবং বীরসেনারা আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করে স্থানীয় জনগণের যে ক্ষতি সাধন করেছি, তা পরিমাপ করতে আমার নিজের লেগেছিল প্রায় ১৫ বছর। আমার কর্মীদের লেগেছে প্রায় ৩০ বছর। দেশের প্রশাসন এবং বরণীয় ব্যক্তিরা এখনো সে জায়গাটি ছুঁতে পারেননি। অথচ চুনটায় ওই কারণে ২২ জন হিন্দু গণহত্যার শিকার হয়েছিল। আর লালপুরে নিহত পুরুষ এবং নির্যাতিত নারীর সংখ্যা কয়েক ডজন। আমি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে এ কথাগুলো বলছি।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ডাক্তারদের দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। খুব ভালো কাজ করেছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষপদ থেকে এমন ন্যায্য কথা যত বেশি উচ্চারিত হবে, যত বেশি তা কথার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কর্মে পরিণত হবে, তত বেশি ভালো কাজ হবে। এ ক্ষেত্রে আমার বিনীত পরামর্শ যে সবাইকে নিজের দায়টা বুঝতে হবে। কে কতটা সমাজ থেকে সুবিধা নিল, কে কতটা রাষ্ট্র থেকে গ্রহণ করল, কী পরিমাণ সুবিধা ও সম্মান ভোগ করল, তা সবাইকে মনে করতে হবে। যার যার স্থানে এই রাষ্ট্রীয় দায় ও সামাজিক দায় পরিশোধ করতে হবে। রাজনীতিবিদদের কথামালার রাজনীতি এবং নেপথ্যে বহুমুখী বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষককে বুঝতে হবে যে বিশাল ভূমির ওপর তাঁদের স্থাপনা বা বাসস্থল তার বাজারমূল্য কত, এর মাসিক বা বার্ষিক আয় কত হতে পারে। কর্মঘণ্টা অনুপাতে যে মাসিক বেতন ও অন্যান্য সুবিধা তাঁরা পান, রাষ্ট্রীয় খরচে যেসব বৃত্তি ভোগ করেন; সবেতন ও বিনা বেতনে বছরের পর বছর যে ছুটি ভোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন এনজিওসহ বেসরকারি যেসব সুবিধা ভোগ করেন, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেসব ফায়দা লোটেন_তার সব কিছু চিন্তা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চিন্তা করতে হবে তাদের স্কুলজীবনের শ্রম, ত্যাগ, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার কথা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাটোমিক অ্যাডজরপশন স্পেকট্রো ফটোমিটারসহ যেসব মূল্যবান যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে, তার কথা বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা এবং ভূমির মূল্য তথা শিক্ষকের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা চিন্তা করতে হবে।
প্রকৌশলীদের চিন্তা করতে হবে, তাঁরা কতজন সততার সঙ্গে কাজ করছেন এবং নৈতিকতার সঙ্গে মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু অবদান রেখেছেন।
একাত্তরের পর যে লুটেরা সমাজের উত্থান হয়, যে লুমপেন বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে, তার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের নিতে হবে। চৌর্যবৃত্তি এবং সামগ্রিক অসহিষ্ণুতাসহ বহুমুখী সন্ত্রাসের দায়ও রাজনীতিবিদদের। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, কৃষকের অর্জন, অভিবাসী শ্রমিকের অর্জনগুলোকে নিজেদের অর্জন বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা জনগণ ভালো চোখে দেখবে না। গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষকদের জীবনের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি যা দরকার, তা হলো শিক্ষা ও প্রযুক্তিজ্ঞানের বিস্তার। তাদের জীবনের মানোন্নয়নে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিদ্যুৎ ও নূ্যনতম অবকাঠামো নির্মাণ। এই অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন হতে পারে অর্থবোধক প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। বিকল্প শক্তি, বায়োগ্যাস, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদির ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন সহজ করা সম্ভব। আইটিকেন্দ্র এবং নগ্নপদ চিকিৎসকদের সাহায্যে পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা গেলে স্বাস্থ্যসেবাকে একেবারে তৃণমূল পর্যায় নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি রেডিও এবং মোবাইল টেকনোলজি স্বাস্থ্যসেবার প্রসারসহ সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিকল্প বিচার ও সমঝোতামূলক বিচারকে তৃণমূলে না নিতে পারলে সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। সমাজ ও সমষ্টির অংশীদারি ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত। রাজধানীতে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সেবা উন্নয়নে রাজনীতি থেকে সরে এসে সেবার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে মেডিক্যাল হাসপাতালের পরিধি বাড়িয়ে রোগীপ্রতি ওষুধের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। হাসপাতালের খরচ মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ১১টি মেডিসিন ইউনিটের প্রতিটি ইউনিটে প্রায় ৩০ জন অনারারি তথা অনাহারি চিকিৎসক দিনরাত কাজ করছেন। এবং রাজনৈতিকভাবে নিয়োজিত চিকিৎসকরা তৈলমর্দন ছাড়াও তদবির এবং অন্যান্য নিজস্ব কর্মে ব্যস্ত থাকেন। আর রোগীর ওষুধ চুরি করে যাচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর গ্যাংগুলো। পরিবর্তন প্রয়োজন সবার মন ও মানসিকতার।
আমার স্বর্গীয় পিতা, পিতৃব্য এবং পূর্বপুরুষরা শত বছর এই পেশায় জড়িত থাকার কারণে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রকৃত অবস্থা আমার নখদর্পণে। এখানে যারা মানুষ পেটায় এবং প্রকাশ্যে সন্ত্রাসে জড়িত হয় বা নেশা করে, তাদের অনেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ অধ্যাপকের পদগুলো অলংকৃত করে। এটা রাজনীতির খেলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পারবেন কি এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে? তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা আমার জানা। ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজের পরিবেশ যেমন সৃষ্টি করতে হবে, তেমনি যাতায়াতসহ বাসস্থান ও কর্মস্থান ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। ওষুধ ও নূ্যনতম পরীক্ষার ব্যবস্থাসহ সহকারীদের জন্য একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশু ও মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো। এ জন্য কিছু হরমোন টেস্টও জরুরি। সর্বোপরি সব সরকারি কর্মচারীকে একপর্যায়ে তৃণমূলে ঘুরিয়ে আনতে পারলে ভালো ফল হতে পারে। তবে এই ৯ মণ তেল জোগাতে মন্ত্রী ও সচিবরা কতটা পারঙ্গম তা দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী আদেশ দিলেই নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষক তিন মাস করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিস্তার ঘটাতে পারেন। আসুন, আমরা কিউবা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। ইতিহাস থেকে পাঠ নেওয়া খুব জরুরি। ইতিহাসের অধ্যায়গুলো মানুষের মূল্যবোধ ও চেতনার মধ্যে থাকুক। সমাজ বাজার এবং যথার্থ সমাজ অর্থনীতি (ড. ইউনূসের ভাবনার সমার্থক নয়) কেবল সাম্যবাদ সমর্থিত অর্থনীতি নয়, সমাজবান্ধব রাজনীতির বিকাশ ঘটাতে পারে। লুটেরাতন্ত্র এবং গ্লোবালাইজেশনের ফাঁদ থেকে সমাজকে মুক্ত করে নতুন পথ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে দেশের মেহনতি মানুষ, নারী এবং বিবেকবান গোষ্ঠী সাহসী হয়ে দ্রুত পথে নামবে_এটাই বিশ্বাস। আলো জ্বলুক ঘরে ঘরে। যে আগুন নিভে গেছে, সেই আগুন জ্বলে উঠুক আবার।
লেখক : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক
No comments