বিচার-ব্যবস্থা-আইন বাতিল তবে ট্রাইব্যুনাল আছে by সা কা ম আনিছুর রহমান খান
জনজীবনে নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত বিঘ্নিত হতে শুরু করলে তা দমনের উদ্দেশ্যে বিশেষ বিধান-সংবলিত আইন প্রণয়নের জন্য ২০০০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন আইন, ২০০০’ প্রবর্তন করা হয়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ, গাড়ি ভাঙচুর ও সম্পদের ক্ষতিসাধন, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, মুক্তিপণ দাবি ও আদায়, ত্রাস সৃষ্টিসংক্রান্ত অপরাধগুলোকে এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়।
এসব অপরাধের তদন্ত ও বিচারের সময়সীমাও নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়।
আইনটি প্রবর্তিত হওয়ার পর সারা দেশে পক্ষে-বিপক্ষে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ আইনের ব্যবহার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে এই আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। সর্বৈব এ অভিযোগগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন ছিল না।
তবে এটাও মানতে হবে যে উল্লিখিত অপরাধগুলো দমন করতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। যাঁরা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয়ে বাস করেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে থাকেন, ওইরূপ গাড়িতে চড়েন, যাঁদের কর্মস্থল ও বাজারও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত—তাঁদের পক্ষে জন-অপরাধীদের দৌরাত্ম্যের সীমা অনুভব করা কষ্টকরই বটে।
এ আইন অনুসারে দায়ের করা প্রথম মামলাটি খুলনায় ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে ছয় কার্যদিবসে শেষ হয়। সব মামলায়ই রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে রায়ের জাবেদা নকল সরবরাহ করা হতে থাকে। খুলনার জনজীবনে নেমে আসে শান্তি। ট্রাইব্যুনাল লাভ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
চট্টগ্রামে ইফতারির দোকানে সংঘটিত একটি ঘটনাকে এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে পুলিশ গ্রহণ করলে আইনটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। হাইকোর্ট এ বিষয়ে রায় দিলে মূলত আইনটির অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। থানায় এ আইনে মামলা করা হলেও তা এই আইনের অধীনে লিপিবদ্ধ করা থেকে পুলিশ বিরত থাকে।
অতঃপর ২০০২ সালের ৩ এপ্রিল ‘জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) (রহিতকরণ) আইন, ২০০২’ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে এ আইন রহিত করা হয়। হেফাজত-সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়, এ আইন রহিতকরণ সত্ত্বেও ইতিমধ্যে দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত, অধিকতর তদন্ত, মামলার বিচার, আপিল ও অন্যান্য কার্যধারা অব্যাহত থাকবে। সরকার মামলা প্রত্যাহার করে নিলে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। এ আইনের অধীনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল, সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বিলুপ্ত না করা পর্যন্ত তা বহাল থাকবে।
এর পর টানা সাড়ে নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালগুলো বহাল আছে। এসব ট্রাইব্যুনালে ওই আইনের অধীনে দায়ের করা কোনো মামলা বিচারাধীন নেই। থানায় কোনো অভিযোগও তদন্তাধীন নেই। ট্রাইব্যুনালে নিয়োজিত বিচারকেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যেরূপ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা ও আপিলগুলো বিচারের জন্য বদলি করা, সেভাবে এই ট্রাইব্যুনালেও মামলা পাঠানো হয়ে থাকে
কিন্তু ট্রাইব্যুনালের আদিম এখতিয়ারের মামলা না থাকায় এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট বিচারকের জন্য তা অসম্মানজনক। তাঁরা জেলা জজ পদমর্যাদার হয়েও প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত জেলা জজ ও যুগ্ম জেলা জজের—তা-ও আবার অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর্মে নবীন জেলা জজের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের পদমর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো সরকারি বাসভবন সংরক্ষিত নেই, বেসরকারি ভবন ভাড়া করে স্বীয় কর্মস্থলে বিচারকের বসবাস করা শোভন নয়—বিচারক হিসেবে সুনাম ও ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তা করা উচিতও নয়।
কর্মস্থলে তাঁরা বাস করেন অতিরিক্ত জেলা জজদের জন্য উপযোগী সরকারি বাসভবনে অথবা সার্কিট হাউস অথবা জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর সাধারণ কক্ষে। তাঁদেরকে সার্কিট হাউসের ভিআইপি কক্ষ বা সম্মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কক্ষও বরাদ্দ দিতে জনপ্রশাসন কর্তৃপক্ষ অনীহ। এ বিষয়টি প্রবীণ বিচারকের জন্য পীড়াদায়কই বটে। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে একজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে এরূপ ট্রাইব্যুনালের বিচারক পদে বদলি করা হলে তিনি পদত্যাগ (!) করেন। বিচারক নিজে যখন পদায়নের জন্য মর্মপীড়া বোধ করেন, তখন সুষ্ঠু বিচারের পরিবেশ কোনো অবস্থায়ই থাকে না। তার পরও এরূপ ট্রাইব্যুনাল বহাল রাখার যৌক্তিকতা কোথায়?
সা কা ম আনিছুর রহমান খান: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ।
aniskamal44@yahoo.com
আইনটি প্রবর্তিত হওয়ার পর সারা দেশে পক্ষে-বিপক্ষে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ আইনের ব্যবহার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে এই আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। সর্বৈব এ অভিযোগগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন ছিল না।
তবে এটাও মানতে হবে যে উল্লিখিত অপরাধগুলো দমন করতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। যাঁরা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয়ে বাস করেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে থাকেন, ওইরূপ গাড়িতে চড়েন, যাঁদের কর্মস্থল ও বাজারও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত—তাঁদের পক্ষে জন-অপরাধীদের দৌরাত্ম্যের সীমা অনুভব করা কষ্টকরই বটে।
এ আইন অনুসারে দায়ের করা প্রথম মামলাটি খুলনায় ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে ছয় কার্যদিবসে শেষ হয়। সব মামলায়ই রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে রায়ের জাবেদা নকল সরবরাহ করা হতে থাকে। খুলনার জনজীবনে নেমে আসে শান্তি। ট্রাইব্যুনাল লাভ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
চট্টগ্রামে ইফতারির দোকানে সংঘটিত একটি ঘটনাকে এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে পুলিশ গ্রহণ করলে আইনটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। হাইকোর্ট এ বিষয়ে রায় দিলে মূলত আইনটির অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। থানায় এ আইনে মামলা করা হলেও তা এই আইনের অধীনে লিপিবদ্ধ করা থেকে পুলিশ বিরত থাকে।
অতঃপর ২০০২ সালের ৩ এপ্রিল ‘জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) (রহিতকরণ) আইন, ২০০২’ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে এ আইন রহিত করা হয়। হেফাজত-সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়, এ আইন রহিতকরণ সত্ত্বেও ইতিমধ্যে দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত, অধিকতর তদন্ত, মামলার বিচার, আপিল ও অন্যান্য কার্যধারা অব্যাহত থাকবে। সরকার মামলা প্রত্যাহার করে নিলে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। এ আইনের অধীনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল, সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বিলুপ্ত না করা পর্যন্ত তা বহাল থাকবে।
এর পর টানা সাড়ে নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালগুলো বহাল আছে। এসব ট্রাইব্যুনালে ওই আইনের অধীনে দায়ের করা কোনো মামলা বিচারাধীন নেই। থানায় কোনো অভিযোগও তদন্তাধীন নেই। ট্রাইব্যুনালে নিয়োজিত বিচারকেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যেরূপ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা ও আপিলগুলো বিচারের জন্য বদলি করা, সেভাবে এই ট্রাইব্যুনালেও মামলা পাঠানো হয়ে থাকে
কিন্তু ট্রাইব্যুনালের আদিম এখতিয়ারের মামলা না থাকায় এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট বিচারকের জন্য তা অসম্মানজনক। তাঁরা জেলা জজ পদমর্যাদার হয়েও প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত জেলা জজ ও যুগ্ম জেলা জজের—তা-ও আবার অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর্মে নবীন জেলা জজের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের পদমর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো সরকারি বাসভবন সংরক্ষিত নেই, বেসরকারি ভবন ভাড়া করে স্বীয় কর্মস্থলে বিচারকের বসবাস করা শোভন নয়—বিচারক হিসেবে সুনাম ও ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তা করা উচিতও নয়।
কর্মস্থলে তাঁরা বাস করেন অতিরিক্ত জেলা জজদের জন্য উপযোগী সরকারি বাসভবনে অথবা সার্কিট হাউস অথবা জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর সাধারণ কক্ষে। তাঁদেরকে সার্কিট হাউসের ভিআইপি কক্ষ বা সম্মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কক্ষও বরাদ্দ দিতে জনপ্রশাসন কর্তৃপক্ষ অনীহ। এ বিষয়টি প্রবীণ বিচারকের জন্য পীড়াদায়কই বটে। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে একজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে এরূপ ট্রাইব্যুনালের বিচারক পদে বদলি করা হলে তিনি পদত্যাগ (!) করেন। বিচারক নিজে যখন পদায়নের জন্য মর্মপীড়া বোধ করেন, তখন সুষ্ঠু বিচারের পরিবেশ কোনো অবস্থায়ই থাকে না। তার পরও এরূপ ট্রাইব্যুনাল বহাল রাখার যৌক্তিকতা কোথায়?
সা কা ম আনিছুর রহমান খান: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ।
aniskamal44@yahoo.com
No comments