গদ্যকার্টুন-অঘ্রান এসেছে আজ by আনিসুল হক
‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর ’পরে— বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;—অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে; সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে—সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে হাঁটলাম,
চিল উড়ে চলে গেছে—কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায়
ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়;
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হূদয়ের মতো নীরবতা...’
(অঘ্রাণ প্রান্তরে/বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ)
রোদের রং যখন হলুদ হয়ে আসে, ছায়াগুলো দীর্ঘ হয়, এই রকম কোনো অঘ্রানের বিকেলবেলায়, আমার কেবলি শৈশবের কথা মনে পড়ে। আর দিবাভাগও ফুরিয়ে যায় কত দ্রুত, বিকেল যেন ঝপ করে নেমে আসে আকাশ থেকে। বাতাসে শীতের ঘ্রাণ। আমি চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিই, ঠিক আমার ছেলেবেলাকার অঘ্রানের গন্ধ। আমার মনে হয়, আমার শৈশবেও এমনি করেই হেমন্ত আসত, আর হেমন্তের হাত ধরে আসত শীত।
মাঠের মধ্যে লম্বা ছায়া পড়ত সুপরিগাছগুলোর, টিনের চালের ওপরে চিরুনির মতো অ্যান্টেনার, তাতে বসা একটা পায়রার। বাসার সামনের কাঁঠালগাছ থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ত হলুদ পাতা। স্কুলের মাঠ হলুদ হয়ে আছে আলোয়। ছুটে যেতাম মাঠে। একা একা স্কুল বিল্ডিংয়ের দেয়ালে ৩ নম্বর ফুটবলটা সজোরে মারছি, ধপধপ আওয়াজ উঠছে, আর এক এক করে জড়ো হচ্ছে পাড়ার ছোটদের দল। চোরকাঁটা ভরা মাঠে রঙিন পাখা মেলে দিয়েছে ফড়িঙের দল। আমরা বলতাম, আজ ফড়িংদের হাটবার। তাই এত ফড়িংয়ের মেলা বসেছে এখানে। ওই পাশে একটা গরু অলস শুয়ে আছে, তার পিঠে কি কানের কাছে পোকা খুটছে দুটো ফিঙেপাখি।
কিংবা চলে গেছি গ্রামের বাড়ি। বিকেলবেলা কুয়াশা আর ধোঁয়া গাছপালা ঢাকা বাড়িগুলোর ওপরে স্তব্ধ হয়ে আছে। বরইগাছের নিচে ছেলেমেয়েদের জটলা। ঢিল ছুড়ে ওই কাঁচা বরইয়ের ঝাঁক থেকে একটা কি দুটো ঈষৎ পক্ব কুল কে পাড়তে পারে, তারই প্রতিযোগিতা।
মাঠভরা পাকা ধান। অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে মায়ের মুখের মধুর হাসিই যেন ছড়ানো। মাঝেমধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছে কাকতাড়ুয়া। ধানকাটা শুরু হলো তো শুরু হয়ে গেল উৎসবের দিন। মামুর কিষান বলতে একটা জিনিস ছিল। তাতে ধানকাটা কিষানদের খাওয়ানো হতো পেটপুরে। আমরাও বসে যেতাম সেই কিষানদের পঙিক্ততে। কাটা ধান বাঁকে নিয়ে, মাথায় নিয়ে চাষিরা ঘরে ফিরছে। সোনালি খড়ের শোভায় কোন বরিশালে জীবনানন্দ দাশ ব্যাকুল হয়ে উঠছেন। আবার ধান কাটা হয়ে গেলে যে শূন্য ক্ষেত, তার নিঃসঙ্গতাতেও তিনি ব্যথা পাচ্ছেন। বাড়ির খোলায় চলছে ধান মাড়াই। কিষানেরা মাথার ওপরে তুলে আছড়ে ধান ছাড়াচ্ছে শিষ থেকে। তারপর গরুগুলো চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে বিচালির ওপর দিয়ে। ধান সেদ্ধর কাজ চলছে সারা রাত। সারা দিন সেই ধান উঠোনজুড়ে শুকোতে দেওয়া হবে। বিশাল কঞ্চি নিয়ে একপাশে বসে থাকি, পাখি তাড়াতে হবে। তারপর শুরু হলো ঢেঁকির ধানভানা মধুর আওয়াজ। কেমন করে চুড়িপরা হাতগুলো ঢেঁকির ধনেশ পাখির মতো ঠোঁটটা নেমে আসার আগেই ধানগুলো, কুড়োগুলো নেড়ে দিয়ে সরে পড়ে। কী ছন্দ, কী নিয়ম, কী সৌন্দর্য! নরম চাল থেকে সাদা আটাও ভানা হচ্ছে ওই ঢেঁকিতেই। তারপর শুরু হলো পিঠা বানানোর উৎসব। ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা। আমরা বলতাম, কলা পিঠা...।
ধানের মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে আসতেন ভাঁড়ওয়ালা। বাঁকে করে আনতেন জিলেপি, সাবান, বিস্কুট, কাচের চুড়ি। প্রধানত চিটা ধানই দেওয়া হতো তাঁকে, ধামা ভরে ভরে, আর জিনিসপাতি কেনা হতো। কিনতেন বউঝিরাই।
ধান কাটার পর ফাঁকা মাঠে বিকেলবেলায় জমে উঠত ফুটবল খেলা। শুকনো কচুরিপানা দলা পাকিয়ে বল বানানো হতো। সেটা বেশ ফুটবলের মতোই মাটিতে লাফাতে পারত।
আরেকটু এগিয়ে গেলেই রোগা নদী। কুয়াশা থমকে আছে তার ওপরে। জলও যেন নড়ছে না। নদীর জলে পাতাশূন্য ডালপালার ওপরে স্থির হয়ে বসে আছে একটা মাছরাঙা।
আবার ফিরে আসি রংপুরে। নিজেদের বাগানে ফুলকপি, বাঁধাকপির চারা রোপা হয়েছে। কলাগাছের বাকল দিয়ে প্রতিটা গাছের জন্য আলাদা ছায়ার ব্যবস্থা। বিকেলবেলা টিউবওয়েল থেকে বালতিতে করে পানি টেনে এনে ঝাঁঝরি দিয়ে প্রত্যেকটা গাছের গোড়ায় দেওয়া। সকালবেলা সেই গাছের পাতায় শিশির টলমল করছে। তার গায়ে পড়েছে সকালবেলার চনমনে রোদ। কী রকম ঝিকমিকিয়ে যে উঠছে! মায়ের হাতে উলের বল, দুটো কাঁটা কী কৌশলে বুনে যাচ্ছে লাল সোয়েটার! সুযোগ পেলেই হাত থেকে নেমে সেই বল লাফাতে লাফাতে চলে যাচ্ছে অগম্য কোনো কোনায়।
সবকিছু বদলে যায়। কিছুই আর ফিরে আসে না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এই অঘ্রানের রাতেও বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে মাথার ওপরে, এই ঢাকায়। তবু পথ চলতে গিয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা শীর্ণ শিউলিগুলো একবার থেমে হাতে তুলে নিই। বাতাসে অঘ্রানের ঘ্রাণ, টের পাই।
সকালের রোদে হাঁটতে ভালো লাগে।
বিকেলে রোদের রংকে ঠিক আমারই শৈশবের মতো হলুদ দেখে ভাবি, নাকি কিছুই বদলায়নি, শুধু চুলগুলো পেকে যাওয়া ছাড়া।
অন্য কোনো মাসে যেন নয়, অঘ্রান এলেই কেন যেন এলোমেলো হয়ে যাই।
মনে হয়, জীবনানন্দ দাশের মতো করে বিড়বিড় করে বলি—
‘বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে,
হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে পড়ে গেছি ঝরে।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায়
ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়;
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হূদয়ের মতো নীরবতা...’
(অঘ্রাণ প্রান্তরে/বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ)
রোদের রং যখন হলুদ হয়ে আসে, ছায়াগুলো দীর্ঘ হয়, এই রকম কোনো অঘ্রানের বিকেলবেলায়, আমার কেবলি শৈশবের কথা মনে পড়ে। আর দিবাভাগও ফুরিয়ে যায় কত দ্রুত, বিকেল যেন ঝপ করে নেমে আসে আকাশ থেকে। বাতাসে শীতের ঘ্রাণ। আমি চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিই, ঠিক আমার ছেলেবেলাকার অঘ্রানের গন্ধ। আমার মনে হয়, আমার শৈশবেও এমনি করেই হেমন্ত আসত, আর হেমন্তের হাত ধরে আসত শীত।
মাঠের মধ্যে লম্বা ছায়া পড়ত সুপরিগাছগুলোর, টিনের চালের ওপরে চিরুনির মতো অ্যান্টেনার, তাতে বসা একটা পায়রার। বাসার সামনের কাঁঠালগাছ থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ত হলুদ পাতা। স্কুলের মাঠ হলুদ হয়ে আছে আলোয়। ছুটে যেতাম মাঠে। একা একা স্কুল বিল্ডিংয়ের দেয়ালে ৩ নম্বর ফুটবলটা সজোরে মারছি, ধপধপ আওয়াজ উঠছে, আর এক এক করে জড়ো হচ্ছে পাড়ার ছোটদের দল। চোরকাঁটা ভরা মাঠে রঙিন পাখা মেলে দিয়েছে ফড়িঙের দল। আমরা বলতাম, আজ ফড়িংদের হাটবার। তাই এত ফড়িংয়ের মেলা বসেছে এখানে। ওই পাশে একটা গরু অলস শুয়ে আছে, তার পিঠে কি কানের কাছে পোকা খুটছে দুটো ফিঙেপাখি।
কিংবা চলে গেছি গ্রামের বাড়ি। বিকেলবেলা কুয়াশা আর ধোঁয়া গাছপালা ঢাকা বাড়িগুলোর ওপরে স্তব্ধ হয়ে আছে। বরইগাছের নিচে ছেলেমেয়েদের জটলা। ঢিল ছুড়ে ওই কাঁচা বরইয়ের ঝাঁক থেকে একটা কি দুটো ঈষৎ পক্ব কুল কে পাড়তে পারে, তারই প্রতিযোগিতা।
মাঠভরা পাকা ধান। অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে মায়ের মুখের মধুর হাসিই যেন ছড়ানো। মাঝেমধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছে কাকতাড়ুয়া। ধানকাটা শুরু হলো তো শুরু হয়ে গেল উৎসবের দিন। মামুর কিষান বলতে একটা জিনিস ছিল। তাতে ধানকাটা কিষানদের খাওয়ানো হতো পেটপুরে। আমরাও বসে যেতাম সেই কিষানদের পঙিক্ততে। কাটা ধান বাঁকে নিয়ে, মাথায় নিয়ে চাষিরা ঘরে ফিরছে। সোনালি খড়ের শোভায় কোন বরিশালে জীবনানন্দ দাশ ব্যাকুল হয়ে উঠছেন। আবার ধান কাটা হয়ে গেলে যে শূন্য ক্ষেত, তার নিঃসঙ্গতাতেও তিনি ব্যথা পাচ্ছেন। বাড়ির খোলায় চলছে ধান মাড়াই। কিষানেরা মাথার ওপরে তুলে আছড়ে ধান ছাড়াচ্ছে শিষ থেকে। তারপর গরুগুলো চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে বিচালির ওপর দিয়ে। ধান সেদ্ধর কাজ চলছে সারা রাত। সারা দিন সেই ধান উঠোনজুড়ে শুকোতে দেওয়া হবে। বিশাল কঞ্চি নিয়ে একপাশে বসে থাকি, পাখি তাড়াতে হবে। তারপর শুরু হলো ঢেঁকির ধানভানা মধুর আওয়াজ। কেমন করে চুড়িপরা হাতগুলো ঢেঁকির ধনেশ পাখির মতো ঠোঁটটা নেমে আসার আগেই ধানগুলো, কুড়োগুলো নেড়ে দিয়ে সরে পড়ে। কী ছন্দ, কী নিয়ম, কী সৌন্দর্য! নরম চাল থেকে সাদা আটাও ভানা হচ্ছে ওই ঢেঁকিতেই। তারপর শুরু হলো পিঠা বানানোর উৎসব। ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা। আমরা বলতাম, কলা পিঠা...।
ধানের মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে আসতেন ভাঁড়ওয়ালা। বাঁকে করে আনতেন জিলেপি, সাবান, বিস্কুট, কাচের চুড়ি। প্রধানত চিটা ধানই দেওয়া হতো তাঁকে, ধামা ভরে ভরে, আর জিনিসপাতি কেনা হতো। কিনতেন বউঝিরাই।
ধান কাটার পর ফাঁকা মাঠে বিকেলবেলায় জমে উঠত ফুটবল খেলা। শুকনো কচুরিপানা দলা পাকিয়ে বল বানানো হতো। সেটা বেশ ফুটবলের মতোই মাটিতে লাফাতে পারত।
আরেকটু এগিয়ে গেলেই রোগা নদী। কুয়াশা থমকে আছে তার ওপরে। জলও যেন নড়ছে না। নদীর জলে পাতাশূন্য ডালপালার ওপরে স্থির হয়ে বসে আছে একটা মাছরাঙা।
আবার ফিরে আসি রংপুরে। নিজেদের বাগানে ফুলকপি, বাঁধাকপির চারা রোপা হয়েছে। কলাগাছের বাকল দিয়ে প্রতিটা গাছের জন্য আলাদা ছায়ার ব্যবস্থা। বিকেলবেলা টিউবওয়েল থেকে বালতিতে করে পানি টেনে এনে ঝাঁঝরি দিয়ে প্রত্যেকটা গাছের গোড়ায় দেওয়া। সকালবেলা সেই গাছের পাতায় শিশির টলমল করছে। তার গায়ে পড়েছে সকালবেলার চনমনে রোদ। কী রকম ঝিকমিকিয়ে যে উঠছে! মায়ের হাতে উলের বল, দুটো কাঁটা কী কৌশলে বুনে যাচ্ছে লাল সোয়েটার! সুযোগ পেলেই হাত থেকে নেমে সেই বল লাফাতে লাফাতে চলে যাচ্ছে অগম্য কোনো কোনায়।
সবকিছু বদলে যায়। কিছুই আর ফিরে আসে না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এই অঘ্রানের রাতেও বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে মাথার ওপরে, এই ঢাকায়। তবু পথ চলতে গিয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকা শীর্ণ শিউলিগুলো একবার থেমে হাতে তুলে নিই। বাতাসে অঘ্রানের ঘ্রাণ, টের পাই।
সকালের রোদে হাঁটতে ভালো লাগে।
বিকেলে রোদের রংকে ঠিক আমারই শৈশবের মতো হলুদ দেখে ভাবি, নাকি কিছুই বদলায়নি, শুধু চুলগুলো পেকে যাওয়া ছাড়া।
অন্য কোনো মাসে যেন নয়, অঘ্রান এলেই কেন যেন এলোমেলো হয়ে যাই।
মনে হয়, জীবনানন্দ দাশের মতো করে বিড়বিড় করে বলি—
‘বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে,
হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে পড়ে গেছি ঝরে।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments