মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে হবে-বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস by জিল্লুর রহমান রতন
পত্রিকার পাতা খুললে প্রায় প্রতিদিনই আত্মহত্যার খবর চোখে পড়ে। কেউ সামাজিক নিগ্রহের কারণে অপমান সইতে না পেরে, মহিলাদের ক্ষেত্রে যৌতুক, স্বামী কিংবা সঙ্গীর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের (তথাকথিত ইভটিজিংসহ) কারণে, কারও ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত হতাশা, ব্যর্থতা ও বঞ্চনার কারণে আত্মহত্যা সংঘটিত হতে দেখি। কারণ যাই থাক, আত্মহত্যা অমূল্য জীবনের অকাল অপচয়।
এর বিষাদময় ও ক্ষতিকর প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে দীর্ঘস্থায়ী হয় যা কারও কাছে কাম্য নয়। অথচ আত্মহত্যা একটি মনোসামাজিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা যেটি প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু শুধু সামাজিক সচেতনতা ও এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের অভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা তৈরি, এ বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়।
আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা এ বছর এ দিবসের ৫১তম বার্ষিকী পালন করছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য 'বহু সাংস্কৃতিক সমাজে আত্মহত্যা প্রতিরোধ'। এ বছরের প্রতিপাদ্যে দেশের অভ্যন্তরে ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর ১০ লাখ লোক আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৬ জন (প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন)। আত্মহত্যা ১৫-৪৪ বছর বয়সী ব্যক্তির মধ্যে মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারীর সংখ্যা এর প্রায় ২০ গুণ যাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে গেলে তখন আর করার কিছু থাকে না।
সব সমাজে প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে যে, যারা আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা বলে তারা শুধু বলার জন্যই বলে থাকে। যে কারণে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু অনেক সময় অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে ব্যক্তি তার সমস্যার প্রতি নিকটজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা হিসেবেও আত্মহত্যা করার প্রচেষ্টা নিতে পারে, যখন আসলে তার স্বেচ্ছামৃত্যুর কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সে বেঁচে থাকার সুযোগ নাও পেতে পারে। এ বিষয়টি ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ও মানসিক চাপ মোকাবেলার দক্ষতার অভাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তারপর যখন শেষ আশ্রয়স্থল পরিবার ও ঘনিষ্ঠজন থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তখন ব্যক্তির কাছে এ অসহ্য অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ হয়ে ওঠে আত্মহত্যা। যেমন, গ্রাম্য সালিশে অপমান সইতে না পেরে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, প্রেমে বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, তুচ্ছ বিষয়ে অভিমান, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া প্রভৃতি কারণে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা বা আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। এ সময়ে যদি সংকটাপন্ন ব্যক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এনে তাকে সহযোগিতা করা যায় তাহলে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদিও শহরাঞ্চলে এ বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা থাকায় অনেকে মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন কিন্তু গ্রামে সে সুযোগ কোথায়?
উপজেলা পর্যায়ে চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু জানি তা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারী রোগীর শুধু বিষপানের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার মানসিক রোগের অবস্থা নির্ণয় ও সে অনুযায়ী চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। তবে রোগী সুস্থ হওয়ার পর নিকটস্থ সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগ হতে এ সেবা পেতে পারে। প্রচলিত আইনে প্রতিটি আত্মহত্যা প্রচেষ্টা ও আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশ কেইস হিসেবে হাসপাতালে লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে। অনেক সময় পুলিশি এ ঝামেলা এড়ানোর জন্য রোগীর আত্মীয়স্বজন চিকিৎসা শেষ না করেই রোগীসহ পালিয়ে যায়। যে কারণে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে যায়। যার ফলে পরবর্তী সময়ে সে আবার আত্মহত্যা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং এক সময় তার জীবনপ্রদীপও নিভে যায়। অথচ পরিবার ও সমাজ এ বিষয়ে সচেতন হলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনের সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারী অন্যান্য রোগীর মতোই চিকিৎসাসেবার সুযোগ পায়।
আত্মহত্যার কারণ ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে শহর-গ্রামাঞ্চল, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে সব সমাজে আত্মহত্যার পেছনে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা, ভ্রান্তবিশ্বাস ও কুসংস্কার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে থাকে। পাশ্চাত্য দেশে পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও আমাদের দেশের চিত্র এর বিপরীত। গ্রামে কীটনাশক সহজলভ্য হওয়ায় বেশিরভাগ আত্মহত্যা সংঘটিত হয় বিষাক্ত কীটনাশক পানে। শ্রীলংকায় কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও এর বিষাক্ততার মাত্রা মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে এনে বিগত দশকে আত্মহত্যার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের দেশেও কাজে লাগানো সম্ভব।
বেশ কিছুদিন আগে আত্মহত্যা বিষয়ক একটি গবেষণা কাজে চুয়াডাঙ্গার একটি গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পারি, বিভিন্ন সময়ে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্য কীটনাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে অতি তুচ্ছ মান-অভিমান ও ঝগড়া-বিবাদের কারণে। প্রতিবারই এক সুহৃদ দোকানদার যুবক তাদের নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় এবং তারা প্রাণে বেঁচে যায়। এ ধরনের এলাকায় আত্মহত্যা প্রচেষ্টা একটি অস্বাভাবিক সামাজিক আচরণে পরিণত হয়েছে, যেখানে দেখে শেখা বা সামাজিক শিক্ষণ বিষয়টিকে অব্যাহত রাখছে। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অতি জরুরি। শহরাঞ্চলে ইদানীং দেখা যাচ্ছে, মা তার শিশু-সন্তানসহ অগি্নদগ্ধ হয়ে কিংবা বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে দাম্পত্য কলহ কিংবা স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের কারণে। সম্প্রতি শহরে ও গ্রামে কিশোরীদের মাঝে আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বখাটে সন্ত্রাসী কর্তৃক যৌন সহিংসতা ও নিপীড়ন। এ ধরনের আত্মহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা ও বৈষম্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যেখানে পরিবার ও সমাজের একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা রয়েছে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দেশে কোনো জাতীয় কর্মকৌশল না থাকায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিদ্যমান জাতীয় কর্মকৌশলেই বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের শতকরা ৯০ ভাগের যে কোনো ধরনের মানসিক রোগের সমস্যা থাকে। এর মধ্যে বিষণ্নতা, স্কিটজোফ্রিনিয়া, অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তি, অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের প্রকোপ কয়েকগুণ বেশি লক্ষ্য করা যায়। দ্রুত এ ধরনের মানসিক রোগ নির্ণয় করে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাসেবা দিতে পারলে আত্মহত্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের শতকরা ৪.৬ ভাগ বিষণ্নতায় ভুগছে (ঘওগঐ ্ ডঐঙ ২০০৫)। আর কে না জানে মহিলারা বিষণ্নতায় বেশি ভোগেন। এ ছাড়া মৃগীরোগ এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এ ধরনের রোগীদেরও মানসিক রোগ চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা প্রয়োজন। এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসক ও মনোবিদের সহায়তা প্রয়োজন।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে মিডিয়ার একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকা অপরিহার্য। এক গবেষণায় জানা যায়, টিভিতে আত্মহত্যার সংবাদ ও ছবি প্রদর্শনের পর বেশ কয়েকদিন আত্মহত্যার হার বেশি থাকে। অনেক সময় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছবিসহ নাটকীয় ভঙ্গিতে আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যা একটি গর্হিত কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের একটি নীতিমালা প্রস্তুত করেছে, যেটি অনুসরণ করে কয়েকটি দেশে (যেমন হংকং) আত্মহত্যার হার উল্লেখজনক পর্যায়ে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের দেশের মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিদের এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা যেখানে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে সবার অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত করতে পারলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সহজ হবে। এ জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণের যে নীতিমালা প্রক্রিয়াধীন তার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সর্বস্তরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাহলেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করে অমূল্য জীবনের অকাল বিনাশ রোধ করা সম্ভব।
ডা. জিল্লুর রহমান রতন :সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
mzrkhan@gmail.com
আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা এ বছর এ দিবসের ৫১তম বার্ষিকী পালন করছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য 'বহু সাংস্কৃতিক সমাজে আত্মহত্যা প্রতিরোধ'। এ বছরের প্রতিপাদ্যে দেশের অভ্যন্তরে ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর ১০ লাখ লোক আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৬ জন (প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন)। আত্মহত্যা ১৫-৪৪ বছর বয়সী ব্যক্তির মধ্যে মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারীর সংখ্যা এর প্রায় ২০ গুণ যাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে গেলে তখন আর করার কিছু থাকে না।
সব সমাজে প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে যে, যারা আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা বলে তারা শুধু বলার জন্যই বলে থাকে। যে কারণে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু অনেক সময় অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে ব্যক্তি তার সমস্যার প্রতি নিকটজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা হিসেবেও আত্মহত্যা করার প্রচেষ্টা নিতে পারে, যখন আসলে তার স্বেচ্ছামৃত্যুর কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সে বেঁচে থাকার সুযোগ নাও পেতে পারে। এ বিষয়টি ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ও মানসিক চাপ মোকাবেলার দক্ষতার অভাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তারপর যখন শেষ আশ্রয়স্থল পরিবার ও ঘনিষ্ঠজন থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তখন ব্যক্তির কাছে এ অসহ্য অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ হয়ে ওঠে আত্মহত্যা। যেমন, গ্রাম্য সালিশে অপমান সইতে না পেরে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, প্রেমে বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, তুচ্ছ বিষয়ে অভিমান, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া প্রভৃতি কারণে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা বা আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। এ সময়ে যদি সংকটাপন্ন ব্যক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এনে তাকে সহযোগিতা করা যায় তাহলে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদিও শহরাঞ্চলে এ বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা থাকায় অনেকে মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন কিন্তু গ্রামে সে সুযোগ কোথায়?
উপজেলা পর্যায়ে চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু জানি তা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারী রোগীর শুধু বিষপানের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার মানসিক রোগের অবস্থা নির্ণয় ও সে অনুযায়ী চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। তবে রোগী সুস্থ হওয়ার পর নিকটস্থ সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগ হতে এ সেবা পেতে পারে। প্রচলিত আইনে প্রতিটি আত্মহত্যা প্রচেষ্টা ও আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশ কেইস হিসেবে হাসপাতালে লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে। অনেক সময় পুলিশি এ ঝামেলা এড়ানোর জন্য রোগীর আত্মীয়স্বজন চিকিৎসা শেষ না করেই রোগীসহ পালিয়ে যায়। যে কারণে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে যায়। যার ফলে পরবর্তী সময়ে সে আবার আত্মহত্যা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং এক সময় তার জীবনপ্রদীপও নিভে যায়। অথচ পরিবার ও সমাজ এ বিষয়ে সচেতন হলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনের সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকারী অন্যান্য রোগীর মতোই চিকিৎসাসেবার সুযোগ পায়।
আত্মহত্যার কারণ ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে শহর-গ্রামাঞ্চল, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে সব সমাজে আত্মহত্যার পেছনে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা, ভ্রান্তবিশ্বাস ও কুসংস্কার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে থাকে। পাশ্চাত্য দেশে পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও আমাদের দেশের চিত্র এর বিপরীত। গ্রামে কীটনাশক সহজলভ্য হওয়ায় বেশিরভাগ আত্মহত্যা সংঘটিত হয় বিষাক্ত কীটনাশক পানে। শ্রীলংকায় কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও এর বিষাক্ততার মাত্রা মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে এনে বিগত দশকে আত্মহত্যার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের দেশেও কাজে লাগানো সম্ভব।
বেশ কিছুদিন আগে আত্মহত্যা বিষয়ক একটি গবেষণা কাজে চুয়াডাঙ্গার একটি গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পারি, বিভিন্ন সময়ে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্য কীটনাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে অতি তুচ্ছ মান-অভিমান ও ঝগড়া-বিবাদের কারণে। প্রতিবারই এক সুহৃদ দোকানদার যুবক তাদের নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় এবং তারা প্রাণে বেঁচে যায়। এ ধরনের এলাকায় আত্মহত্যা প্রচেষ্টা একটি অস্বাভাবিক সামাজিক আচরণে পরিণত হয়েছে, যেখানে দেখে শেখা বা সামাজিক শিক্ষণ বিষয়টিকে অব্যাহত রাখছে। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অতি জরুরি। শহরাঞ্চলে ইদানীং দেখা যাচ্ছে, মা তার শিশু-সন্তানসহ অগি্নদগ্ধ হয়ে কিংবা বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে দাম্পত্য কলহ কিংবা স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের কারণে। সম্প্রতি শহরে ও গ্রামে কিশোরীদের মাঝে আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বখাটে সন্ত্রাসী কর্তৃক যৌন সহিংসতা ও নিপীড়ন। এ ধরনের আত্মহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা ও বৈষম্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যেখানে পরিবার ও সমাজের একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা রয়েছে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দেশে কোনো জাতীয় কর্মকৌশল না থাকায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিদ্যমান জাতীয় কর্মকৌশলেই বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের শতকরা ৯০ ভাগের যে কোনো ধরনের মানসিক রোগের সমস্যা থাকে। এর মধ্যে বিষণ্নতা, স্কিটজোফ্রিনিয়া, অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তি, অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের প্রকোপ কয়েকগুণ বেশি লক্ষ্য করা যায়। দ্রুত এ ধরনের মানসিক রোগ নির্ণয় করে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাসেবা দিতে পারলে আত্মহত্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের শতকরা ৪.৬ ভাগ বিষণ্নতায় ভুগছে (ঘওগঐ ্ ডঐঙ ২০০৫)। আর কে না জানে মহিলারা বিষণ্নতায় বেশি ভোগেন। এ ছাড়া মৃগীরোগ এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এ ধরনের রোগীদেরও মানসিক রোগ চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা প্রয়োজন। এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসক ও মনোবিদের সহায়তা প্রয়োজন।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে মিডিয়ার একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকা অপরিহার্য। এক গবেষণায় জানা যায়, টিভিতে আত্মহত্যার সংবাদ ও ছবি প্রদর্শনের পর বেশ কয়েকদিন আত্মহত্যার হার বেশি থাকে। অনেক সময় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছবিসহ নাটকীয় ভঙ্গিতে আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যা একটি গর্হিত কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের একটি নীতিমালা প্রস্তুত করেছে, যেটি অনুসরণ করে কয়েকটি দেশে (যেমন হংকং) আত্মহত্যার হার উল্লেখজনক পর্যায়ে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের দেশের মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিদের এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা যেখানে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে সবার অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত করতে পারলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সহজ হবে। এ জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণের যে নীতিমালা প্রক্রিয়াধীন তার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সর্বস্তরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাহলেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করে অমূল্য জীবনের অকাল বিনাশ রোধ করা সম্ভব।
ডা. জিল্লুর রহমান রতন :সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
mzrkhan@gmail.com
No comments