নাইবা হলো পারে যাওয়া-রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সংস্কার জরুরি by মামুন রশীদ

ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত বিনিয়োগ, অদক্ষ-অযোগ্য ও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেওয়ার কারণেই মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো লোকসান-ঝুঁঁকির দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। এসব ব্যাংক একদিকে দক্ষ ও গতিশীল বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিজনেস শেয়ার বা বাজার হিস্যা হারাচ্ছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান শ্রেণীকৃত ঋণের দায় বহন করে চলেছে


রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে নিয়ে প্রায়শই কথা ওঠে, পত্রিকায় খবর বেরোয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত হওয়া এসব ব্যাংকের পরিচালকরা বিগত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া গাইডলাইন বা নির্দেশনা না মেনে চলায় প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। কারণ, তারা সঠিকভাবে ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়ন করার চেয়ে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলোকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ বিতরণে বাধ্য করেছেন বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনা এবং তারল্য কমে যাওয়ার বিষয় নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনকি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে দেন না বলে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এতে এসব ব্যাংকে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, আমানত কমেছে, মুনাফা কমেছে, সেবার মানে অবনতি ঘটেছে এবং ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নিম্নমুখী হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমার ১৯৯২ সালের দিককার কথা মনে পড়ছে। তখন আমি একটি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংকের কমার্শিয়াল ব্যাংকিংয়ের প্রধান ছিলাম। ওই সময়ে আমি আকিজ গ্রুপের কর্ণধার শেখ আকিজ উদ্দিনকে (মরহুম) তার ব্যবসায়ের একটি অংশ আমার (অস্ট্রেলিয়ান) ব্যাংকে স্থানান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। জবাবে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে অনেক ভালো সেবা পাচ্ছেন, তাই তিনি একটি বিদেশি ব্যাংকে ব্যবসা স্থানান্তরে আগ্রহী নন। একইভাবে মন্নুু সিরামিকসের হারুনুর রশীদ মন্নুও সোনালী ব্যাংককে আধুনিক ব্যাংকিংয়ের কলাকৌশল শিখিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। যদিও আমাকে শেখ আকিজ উদ্দিন বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে ভালো সেবা পান বলে বিদেশি ব্যাংকের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই, ঘটনাক্রমে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যাংকিং সেবা পাওয়া কিংবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য যুগপৎ স্থানীয় ও বিদেশি উভয় ধরনের বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। একইভাবে এখন স্কয়ার গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপ ও কনকর্ড গ্রুপের মতো শিল্পগোষ্ঠী একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছেন।
বিগত তিন দশক ধরে 'বাজার-চালিত' দর্শনে দেশের সার্বিক অর্থনীতি পরিচালিত হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাত ক্রমাগতভাবে তাদের মার্কেট শেয়ার বা বাজার হিস্যা খুইয়ে আসছে। অন্যদিকে দক্ষ ও চৌকস জনবল নিয়োগ, হস্তক্ষেপ ও প্রভাবমুক্ত ব্যবস্থাপনা, নিত্যনতুন উদ্ভাবনী পণ্য প্রচলন এবং মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের সুবাদে বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাজার হিস্যা দিন দিন বাড়ছে এবং তারাই এখন চালকের আসনে থেকে দেশের ব্যাংক খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত বিনিয়োগ, অদক্ষ-অযোগ্য ও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেওয়ার কারণেই মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো লোকসান-ঝুঁঁকির দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। এসব ব্যাংক একদিকে দক্ষ ও গতিশীল বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিজনেস শেয়ার বা বাজার হিস্যা হারাচ্ছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান শ্রেণীকৃত ঋণের দায় বহন করে চলেছে।
বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন অংশীদাররা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোকে দক্ষ ও সক্ষম করে তোলা এবং বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে নানাভাবে সহায়তা এবং উৎসাহিত করে আসছে। তারা রূপালী ব্যাংকের বেসরকারিকরণসহ অন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে করপোরেট ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের জন্য চাপ দিয়েছে। রূপালী ব্যাংককে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য দরপত্র ডাকা হলেও তা বেসরকারিকরণ কমিশনের অদক্ষতা-অযোগ্যতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এরই মধ্যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্য তিনটি ব্যাংকে অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় করপোরেট ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও অনেক অগ্রগতির অবকাশ রয়ে গেছে।
সরকারের ব্যাংক খাতের আধুনিকায়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বাড়তি জনবল ও পরিচালন ব্যয় কমানো। এই স্কিম বা কর্মসূচি রূপালী ব্যাংকে আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতা ব্যাংকও প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার কথা শুনেছি, যদিও এ ব্যাপারে সর্বশেষ অগ্রগতিটা অবশ্য এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। তবে শোনা যায়, ব্যাংকটি থেকে এরই মধ্যে অনেকে অবসর নিয়েছেন এবং অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন জনবল নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি এমনও শুনছি যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জন্য উচ্চতর বেতন-স্কেল ঘোষণার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে, যাতে তাদের দক্ষ জনবলের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যাওয়াটা রোধ হয় এবং অন্যরাও তাদের কার্যক্রমে উৎকর্ষতা বাড়াতে উৎসাহিত হন।
বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার আর্থিক বাজারে যে অস্থিরতা চলছে এবং যার প্রভাব অন্য দেশের অর্থনীতিতেও পড়ছে তা থেকে দূরে থাকার জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিপুল অঙ্কের ব্যবসা করছে। তাদের আপাতত গুটিয়ে যাওয়া বা মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সে জন্য সরকারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে তাদের কার্যক্রমে উৎকর্ষতা আসে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। এমনকি বাজার ব্যবস্থার কোনো সংকটে তারা যেন সঠিক ভূমিকা রাখতে পারে।
আমরা জানি, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও এক সময় বাংলাদেশের মতো জনবলের অদক্ষতা, মূলধনের ঘাটতি ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবলের বোঝা বেশ লক্ষণীয় ছিল। তখন তারা (চীন) এ সমস্যা অনুধাবন করে সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত সমাধানের পদক্ষেপ নেয়। শুধু তাই নয়, তারা স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টর বা কৌশলী বিনিয়োগকারীদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগের আহ্বান জানায়। পাশাপাশি মূলধন পুনর্গঠনসহ ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসে। বদৌলতে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে গতিশীলতা আসে, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের অর্থ আকর্ষণীয় ও কার্যকর বিনিয়োগে কাজে লাগে এবং জনগণের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির দর্শন জোরদার হয়। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে উদ্যমী লোক নিয়োগ করা হয়, যারা গুণমানসম্পন্ন চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত। বলা বাহুল্য, কোনো প্রতিষ্ঠানকে জাগিয়ে তুলতে কিংবা পুনর্গঠন করতে এ ধরনের পদক্ষেপই নেওয়া উচিত, যা ইতিবাচক পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে। আমি বিশ্বাস করি, ইতিবাচক পরিবর্তন যে সুফল বয়ে আনে তা নিয়ে প্রিয় পাঠকরা দ্বিমত করবেন না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে যে সংকট চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্যও ইতিবাচক পরিবর্তনের পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।
একদিন আমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে আলাপকালে ব্যাংকটির চারটি প্রধান চ্যালেঞ্জ জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুকরণ, দক্ষ মানবসম্পদ, নন-পারফরমিং লোন বা অনাদায়ী ঋণ ও তারল্যের কথা উল্লেখ করেন। সে সঙ্গে আমি যোগ করব_ সঠিকভাবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি চালু এবং গ্রাহকদের ভালো সেবা প্রদানে জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা। উন্নত গ্রাহকসেবা প্রদান এবং সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাংকে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকাটা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত জোরদার করতে দক্ষতার সঙ্গে তহবিল ব্যবস্থাপনা, কঠোরভাবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ও অনাদায়ী ঋণের চাপ কমানো, অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ, নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়ানো এবং অর্থনীতির সম্ভাবনাময় ও প্রবৃদ্ধিমুখী খাতগুলোতে বিনিয়োগ জোরদারকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সম্প্রসারণ ও মুনাফা অর্জনের ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে আসবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও
অর্থনীতি বিশেল্গষক
mamun1960@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.