ভারত-মমতাভীতিতে তটস্থ পশ্চিমবঙ্গ by পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মমতা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। তার এখন এগোলেও বিপদ। পেছনেও বিপদ। যেমন হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে তার এখনকার সম্পর্ক নিয়ে। সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৩৪ বছর পর কংগ্রেস আবার গ্রামাঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সর্বত্র সিপিএম ক্যাডাররা পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত যারা তাকে ক্ষমতায় এনেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেই লেখক-শিল্পী-নাট্যাভিনেতাদের মুখপাত্র মহাশ্বেতা দেবী মমতাকে 'ফ্যাসিস্ট' আখ্যা দিলেন।
আর মমতার সহযাত্রী তার কোয়ালিশন শরিক কংগ্রেস মমতার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিল। কলকাতায় সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসের এত বড় মিছিল আর হয়নি।
এ দুটি প্রতিবাদই কিন্তু আলাদা আলাদা কারণে। এর সঙ্গে রাজ্যের আমজনতার ক্রোধ বা ক্ষোভের কোনো সম্পর্ক নেই। একথা মনে করার কারণ নেই, পশ্চিমবঙ্গে মমতার সরকারের পতন ঘটবে। বরং মমতার খালি আসনে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে যে উপনির্বাচন হয়েছে সেখানে তৃণমূল প্রার্থী রেকর্ড ভোটে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না মমতা। জনতার নেত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে তিনি জনপ্রিয় চিত্রতারকাদের মতো খাতির পেয়ে আসছেন। তিনি যেখানে যান মুহূর্তের মধ্যে সেখানে তাকে দেখার জন্য শত শত লোক জড়ো হয়ে যায়। তৃণমূলের সব মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র যখনই কোথাও কিছু ভাষণ দিতে যান তখনই নেত্রী মমতার নাম নিতে ভোলেন না। দলের মধ্যে তার ইঙ্গিতই আদেশ। সরকারি কর্মচারীরা তার ভয়ে তটস্থ এবং সত্যি কথা বলতে কি, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কর্মচারীরা মমতাভীতিতে এই প্রথম একটু নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে বাম বুদ্ধিজীবীদেরও 'হৃদয় পরিবর্তন' ঘটাতে শুরু করেছেন। এই যে তিনি কিছুদিন আগে কলকাতায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব করলেন, সেখানে কট্টর তৃণমূলবিরোধী সিপিএম ঘনিষ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সমাপ্তি দিবসে এসে রাজকীয় সম্মান লাভ করলেন। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিনেতা সৌমিত্র মমতার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বেড়েছিল। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসবে তারা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এমন অনেক বুদ্ধিজীবীকে তৃণমূল ক্ষমতায় এসে আর পাত্তাই দেয়নি। আর মহাশ্বেতা দেবী? তিনিই ছিলেন মমতার অন্যতম মেন্টর। ক্ষমতায় এসেই মমতা তাকে বাংলা সাহিত্য মাকাদামির চেয়ারম্যান করেছেন। তাকে সম্মানীয় উপাধি দিয়েছেন। অসুস্থ মহাশ্বেতা দেবীকে তার বাড়িতে দেখতে গিয়েছেন। সেই মহাশ্বেতা এখন মমতার প্রতি এমন চটেছেন যে, তাকে প্রেস কনফারেন্সে 'ফ্যাসিস্ট' আখ্যা দিলেন অম্লান বদনে।
কেন? সবাই জানে মহাশ্বেতা দেবী পুরুলিয়া মেদিনীপুরের উপজাতিদের নিয়ে অনেক দিন ধরে লেখালেখি করেন। তাদের জন্য তিনি একটি এনজিও তৈরি করেছেন। মহাশ্বেতা বরাবরই নকশাল আন্দোলন ও বর্তমানে মেদিনীপুর পুরুলিয়ার উপজাতিদের মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। নকশাল ও মাওবাদীদের পেছনে কলকাতার কিছু বুদ্ধিজীবীর সমর্থন আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক বরাবরই মাওবাদীদের পেছনে আছেন। কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গঠিত বন্দিমুক্তি সমিতি বরাবরই নকশাল ও মাওপন্থিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এদের অনেকেই আগে সিপিএমে ছিলেন। পরে বীতস্পৃহ হয়ে মাওবাদী সমর্থক হয়ে যান।
মমতার সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলনে মাও সমর্থক বুদ্ধিজীবী, মাওবাদীদের প্রকাশ্য কয়েকটি সংগঠন সক্রিয়ভাবে মমতার পাশে দাঁড়ান। তাদের তখন উদ্দেশ্য ছিল সিপিএমকে হটানো। কারণ সিপিএম ৩৪ বছর ধরে অর্থবলে ও লোকবলে এত শক্তিশালী যে, তাদের না হটালে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা কিছুতেই পা রাখার জায়গা পাবে না_ এ ধারণা তাদের ছিল। মাওবাদীরাও সে সময় জঙ্গলমহলে যথেষ্ট শক্তিশালী। সিপিএম প্রথমটায় ভেবেছিল তাদের হাতে প্রচুর ক্যাডার আছে। সশস্ত্র করে তাদের দিয়েই মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারবে; কিন্তু মাওবাদীরাও ততদিনে প্রচুর আধুনিক অস্ত্র জোগাড় করে ফেলেছে। জঙ্গলমহলের গরিব উপজাতিদের মধ্যে ব্যাপক অনুন্নয়ন ও শোষণের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড় থেকে মাওবাদী নেতারা এসে জঙ্গলমহলকে প্রায় 'স্বাধীন' করে ফেলে। জ্যোতি বসুর সময় সিপিএমের নীতি ছিল পুলিশ দিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে মাওবাদীদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এ নীতি অনুসারে সিপিএম মেদিনীপুরে সিপিএম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গঠন করে। এ ক্যাডাররা সিপিএমবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও সন্দেহভাজন মাওবাদীদের খুন করতে থাকে। তৃণমূলের অনেক কর্মী নিখোঁজ হয়ে যায়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর মাটি খুঁড়ে নিখোঁজ বেশকিছু তৃণমূল কর্মীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যা মিডিয়ার ভাষায় 'কঙ্কালকাণ্ড' নামে পরিচিত। এ কঙ্কালকাণ্ডের হোতা হিসেবে সাবেক সিপিএম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ আজ পাঁচ মাস ধরে জেলহাজত খাটছেন। সিপিএম আমলে তৃণমূল কর্মী ও মাওবাদীরা একযোগে তাদের সাধারণ শত্রু সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন।
জ্যোতি বাবুর পর সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনেক গড়িমসি করে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান চালাতে রাজি হন। তৈরি হয় কেন্দ্রীয় পুলিশ ও রাজ্য পুলিশ নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। এ যৌথ বাহিনীর অভিযানের বিরোধিতা করেন মহাশ্বেতা দেবীর নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরা, যেমন অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, শাওলি মিত্র, বিভাস ভট্টাচার্য, গায়ক কবির সুমন প্রমুখ। এদের মধ্যে কবির সুমন আরও প্রকাশ্যে মাওবাদীদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
কবির সুমন যেহেতু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মমতার পাশে ছিলেন, মমতা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এমপি করে দেন। তৃণমূলের এমপি হয়েও কিন্তু সুমন মাওবাদী পথ ছাড়েননি। তিনি মাওবাদী সমর্থক সংগঠন জনগণের কমিটির নেতা ছত্রধরকে মাওবাদীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগে সিপিএম আমলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রধরের সমর্থনে সুমন গানের ক্যাসেট বের করেন। সুমন তৃণমূল এমপি হওয়ার পর কিছু স্থানীয় তৃণমূল নেতার দুর্নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করে তৃণমূল হাইকমান্ডের বিরাগভাজন হন। তা সত্ত্বেও তিনি তার মাওবাদ সমর্থন ছাড়েননি। মমতা এখন বলছেন, কবির সুমনকে এমপি করে ভুল করেছি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন যৌথ বাহিনী গঠন করে জঙ্গলমহলকে মাওবাদীমুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন, তখন মহাশ্বেতা দেবী মেদিনী ঘুরে এসে মিটিং করে বলেছিলেন, 'মাওবাদী বলে কিছু নেই।' মমতা তখন রেলমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। মমতা সে সময় মাওবাদীদের সমর্থন পাচ্ছেন। নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের উপস্থিতির কথা সিপিএম সে সময় বলেছিল। মাওবাদী নেতা কিষেনজি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, মাওবাদীরা চায় মমতা মুখ্যমন্ত্রী হন। এই কিষেনজিই মারা গেছেন মমতার আমলে। সিপিএম আমলে এ ঘটনা ঘটলে নিশ্চিত যে মমতা বলতেন, হার্মাদদের হামলায় তিনি খুন হয়েছেন।
সেই মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দেখলেন মাওবাদীদের ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। তারা নিজেদের অ্যাজেন্ডা অনুসারে চলে। তারা ভারতবর্ষে একটি সমান্তরাল সরকার তৈরি করতে চায়। মাওবাদীরা চেয়েছিল মমতা ক্ষমতায় এসে বন্দি মাওবাদীদের মুক্তি দেবেন। যৌথ বাহিনী প্রত্যাহৃত হবে। মাওবাদীরা যেমন তাদের মুক্তাঙ্গনে শাসন ক্ষমতা বিস্তৃত করেছিল তা অব্যাহত রাখতে পারবে। তবু মাওবাদীরা যদি শুধু সিপিএম খুন করত তাহলে মমতা এত উত্তেজিত হতেন না। মাওবাদীরা তৃণমূল কর্মীদেরও একে একে খুন করতে শুরু করে, তখন মমতা মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যাদের নিয়োগ করা হয় তারা নিজেরাই মাওবাদী সমর্থক বলে অভিযোগ ওঠে। মমতা তখন জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করেন। প্রচুর ছেলেমেয়েকে চাকরির অফার দেওয়া হয়। একদিকে পুলিশি অভিযান, অন্যদিকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ও মাওবাদীদের মূলস্রোতে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি_ মমতার এই নীতির সুফল ফলতে শুরু করে। ইতিমধ্যে কিছু মাওবাদী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। কিছু নেতা গ্রেফতার হয়েছেন ও কিছু মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছে। অন্যদিকে ধৃত মাওবাদীদের মমতা এখনও মুক্তি দেননি। অথচ মহাশ্বেতা দেবীরা বরাবরই যৌথ বাহিনীর বিরোধিতা করে আসছেন। মাওবাদীদের মুক্তির দাবি করে আসছেন। শেষ পর্যন্ত তারা কলকাতা মেট্রো চ্যানেলের সামনে এক সভা করতে চান। পুলিশ ওই সভা করার অনুমতি দেয়নি বলে মহাশ্বেতা দেবী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তিনি বলেছেন, 'জেনে-শুনে কি আমরা এক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় বসিয়েছি?' মমতা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। তার এখন এগোলেও বিপদ। পেছনেও বিপদ। যেমন হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে তার এখনকার সম্পর্ক নিয়ে। সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৩৪ বছর পর কংগ্রেস আবার গ্রামাঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সর্বত্র সিপিএম ক্যাডাররা পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত। তারা প্রায় বসে গেছে। তৃণমূলীদের হাতে তারা সর্বত্র মার খাচ্ছে। এ সুযোগে সিপিএমের জায়গায় কংগ্রেস আবার উঠে দাঁড়াতে চাইলে তৃণমূলীরা কংগ্রেসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এরই প্রতিবাদে কংগ্রেস কর্মীরা কলকাতায় বিরাট বিক্ষোভের আয়োজন করে। মমতা এতে খুব চটেছেন। এর উত্তরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বলেছেন, কংগ্রেস একটি এনজিও নয়, রাজনৈতিক দল_ তার মিছিল করার হক আছে। সিপিএম, কংগ্রেস, মাওবাদী_ এ তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদাভাবে লড়তে হচ্ছে মমতাকে। এ লড়াই তার বাঁচার লড়াই।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
এ দুটি প্রতিবাদই কিন্তু আলাদা আলাদা কারণে। এর সঙ্গে রাজ্যের আমজনতার ক্রোধ বা ক্ষোভের কোনো সম্পর্ক নেই। একথা মনে করার কারণ নেই, পশ্চিমবঙ্গে মমতার সরকারের পতন ঘটবে। বরং মমতার খালি আসনে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে যে উপনির্বাচন হয়েছে সেখানে তৃণমূল প্রার্থী রেকর্ড ভোটে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না মমতা। জনতার নেত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে তিনি জনপ্রিয় চিত্রতারকাদের মতো খাতির পেয়ে আসছেন। তিনি যেখানে যান মুহূর্তের মধ্যে সেখানে তাকে দেখার জন্য শত শত লোক জড়ো হয়ে যায়। তৃণমূলের সব মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র যখনই কোথাও কিছু ভাষণ দিতে যান তখনই নেত্রী মমতার নাম নিতে ভোলেন না। দলের মধ্যে তার ইঙ্গিতই আদেশ। সরকারি কর্মচারীরা তার ভয়ে তটস্থ এবং সত্যি কথা বলতে কি, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কর্মচারীরা মমতাভীতিতে এই প্রথম একটু নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে বাম বুদ্ধিজীবীদেরও 'হৃদয় পরিবর্তন' ঘটাতে শুরু করেছেন। এই যে তিনি কিছুদিন আগে কলকাতায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব করলেন, সেখানে কট্টর তৃণমূলবিরোধী সিপিএম ঘনিষ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সমাপ্তি দিবসে এসে রাজকীয় সম্মান লাভ করলেন। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিনেতা সৌমিত্র মমতার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বেড়েছিল। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসবে তারা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এমন অনেক বুদ্ধিজীবীকে তৃণমূল ক্ষমতায় এসে আর পাত্তাই দেয়নি। আর মহাশ্বেতা দেবী? তিনিই ছিলেন মমতার অন্যতম মেন্টর। ক্ষমতায় এসেই মমতা তাকে বাংলা সাহিত্য মাকাদামির চেয়ারম্যান করেছেন। তাকে সম্মানীয় উপাধি দিয়েছেন। অসুস্থ মহাশ্বেতা দেবীকে তার বাড়িতে দেখতে গিয়েছেন। সেই মহাশ্বেতা এখন মমতার প্রতি এমন চটেছেন যে, তাকে প্রেস কনফারেন্সে 'ফ্যাসিস্ট' আখ্যা দিলেন অম্লান বদনে।
কেন? সবাই জানে মহাশ্বেতা দেবী পুরুলিয়া মেদিনীপুরের উপজাতিদের নিয়ে অনেক দিন ধরে লেখালেখি করেন। তাদের জন্য তিনি একটি এনজিও তৈরি করেছেন। মহাশ্বেতা বরাবরই নকশাল আন্দোলন ও বর্তমানে মেদিনীপুর পুরুলিয়ার উপজাতিদের মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। নকশাল ও মাওবাদীদের পেছনে কলকাতার কিছু বুদ্ধিজীবীর সমর্থন আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক বরাবরই মাওবাদীদের পেছনে আছেন। কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গঠিত বন্দিমুক্তি সমিতি বরাবরই নকশাল ও মাওপন্থিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এদের অনেকেই আগে সিপিএমে ছিলেন। পরে বীতস্পৃহ হয়ে মাওবাদী সমর্থক হয়ে যান।
মমতার সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলনে মাও সমর্থক বুদ্ধিজীবী, মাওবাদীদের প্রকাশ্য কয়েকটি সংগঠন সক্রিয়ভাবে মমতার পাশে দাঁড়ান। তাদের তখন উদ্দেশ্য ছিল সিপিএমকে হটানো। কারণ সিপিএম ৩৪ বছর ধরে অর্থবলে ও লোকবলে এত শক্তিশালী যে, তাদের না হটালে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা কিছুতেই পা রাখার জায়গা পাবে না_ এ ধারণা তাদের ছিল। মাওবাদীরাও সে সময় জঙ্গলমহলে যথেষ্ট শক্তিশালী। সিপিএম প্রথমটায় ভেবেছিল তাদের হাতে প্রচুর ক্যাডার আছে। সশস্ত্র করে তাদের দিয়েই মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারবে; কিন্তু মাওবাদীরাও ততদিনে প্রচুর আধুনিক অস্ত্র জোগাড় করে ফেলেছে। জঙ্গলমহলের গরিব উপজাতিদের মধ্যে ব্যাপক অনুন্নয়ন ও শোষণের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড় থেকে মাওবাদী নেতারা এসে জঙ্গলমহলকে প্রায় 'স্বাধীন' করে ফেলে। জ্যোতি বসুর সময় সিপিএমের নীতি ছিল পুলিশ দিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে মাওবাদীদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এ নীতি অনুসারে সিপিএম মেদিনীপুরে সিপিএম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গঠন করে। এ ক্যাডাররা সিপিএমবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও সন্দেহভাজন মাওবাদীদের খুন করতে থাকে। তৃণমূলের অনেক কর্মী নিখোঁজ হয়ে যায়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর মাটি খুঁড়ে নিখোঁজ বেশকিছু তৃণমূল কর্মীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যা মিডিয়ার ভাষায় 'কঙ্কালকাণ্ড' নামে পরিচিত। এ কঙ্কালকাণ্ডের হোতা হিসেবে সাবেক সিপিএম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ আজ পাঁচ মাস ধরে জেলহাজত খাটছেন। সিপিএম আমলে তৃণমূল কর্মী ও মাওবাদীরা একযোগে তাদের সাধারণ শত্রু সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন।
জ্যোতি বাবুর পর সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনেক গড়িমসি করে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান চালাতে রাজি হন। তৈরি হয় কেন্দ্রীয় পুলিশ ও রাজ্য পুলিশ নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। এ যৌথ বাহিনীর অভিযানের বিরোধিতা করেন মহাশ্বেতা দেবীর নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরা, যেমন অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, শাওলি মিত্র, বিভাস ভট্টাচার্য, গায়ক কবির সুমন প্রমুখ। এদের মধ্যে কবির সুমন আরও প্রকাশ্যে মাওবাদীদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
কবির সুমন যেহেতু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মমতার পাশে ছিলেন, মমতা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এমপি করে দেন। তৃণমূলের এমপি হয়েও কিন্তু সুমন মাওবাদী পথ ছাড়েননি। তিনি মাওবাদী সমর্থক সংগঠন জনগণের কমিটির নেতা ছত্রধরকে মাওবাদীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগে সিপিএম আমলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রধরের সমর্থনে সুমন গানের ক্যাসেট বের করেন। সুমন তৃণমূল এমপি হওয়ার পর কিছু স্থানীয় তৃণমূল নেতার দুর্নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করে তৃণমূল হাইকমান্ডের বিরাগভাজন হন। তা সত্ত্বেও তিনি তার মাওবাদ সমর্থন ছাড়েননি। মমতা এখন বলছেন, কবির সুমনকে এমপি করে ভুল করেছি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন যৌথ বাহিনী গঠন করে জঙ্গলমহলকে মাওবাদীমুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন, তখন মহাশ্বেতা দেবী মেদিনী ঘুরে এসে মিটিং করে বলেছিলেন, 'মাওবাদী বলে কিছু নেই।' মমতা তখন রেলমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। মমতা সে সময় মাওবাদীদের সমর্থন পাচ্ছেন। নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের উপস্থিতির কথা সিপিএম সে সময় বলেছিল। মাওবাদী নেতা কিষেনজি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, মাওবাদীরা চায় মমতা মুখ্যমন্ত্রী হন। এই কিষেনজিই মারা গেছেন মমতার আমলে। সিপিএম আমলে এ ঘটনা ঘটলে নিশ্চিত যে মমতা বলতেন, হার্মাদদের হামলায় তিনি খুন হয়েছেন।
সেই মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দেখলেন মাওবাদীদের ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। তারা নিজেদের অ্যাজেন্ডা অনুসারে চলে। তারা ভারতবর্ষে একটি সমান্তরাল সরকার তৈরি করতে চায়। মাওবাদীরা চেয়েছিল মমতা ক্ষমতায় এসে বন্দি মাওবাদীদের মুক্তি দেবেন। যৌথ বাহিনী প্রত্যাহৃত হবে। মাওবাদীরা যেমন তাদের মুক্তাঙ্গনে শাসন ক্ষমতা বিস্তৃত করেছিল তা অব্যাহত রাখতে পারবে। তবু মাওবাদীরা যদি শুধু সিপিএম খুন করত তাহলে মমতা এত উত্তেজিত হতেন না। মাওবাদীরা তৃণমূল কর্মীদেরও একে একে খুন করতে শুরু করে, তখন মমতা মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যাদের নিয়োগ করা হয় তারা নিজেরাই মাওবাদী সমর্থক বলে অভিযোগ ওঠে। মমতা তখন জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করেন। প্রচুর ছেলেমেয়েকে চাকরির অফার দেওয়া হয়। একদিকে পুলিশি অভিযান, অন্যদিকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ও মাওবাদীদের মূলস্রোতে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি_ মমতার এই নীতির সুফল ফলতে শুরু করে। ইতিমধ্যে কিছু মাওবাদী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। কিছু নেতা গ্রেফতার হয়েছেন ও কিছু মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছে। অন্যদিকে ধৃত মাওবাদীদের মমতা এখনও মুক্তি দেননি। অথচ মহাশ্বেতা দেবীরা বরাবরই যৌথ বাহিনীর বিরোধিতা করে আসছেন। মাওবাদীদের মুক্তির দাবি করে আসছেন। শেষ পর্যন্ত তারা কলকাতা মেট্রো চ্যানেলের সামনে এক সভা করতে চান। পুলিশ ওই সভা করার অনুমতি দেয়নি বলে মহাশ্বেতা দেবী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তিনি বলেছেন, 'জেনে-শুনে কি আমরা এক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় বসিয়েছি?' মমতা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। তার এখন এগোলেও বিপদ। পেছনেও বিপদ। যেমন হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে তার এখনকার সম্পর্ক নিয়ে। সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৩৪ বছর পর কংগ্রেস আবার গ্রামাঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সর্বত্র সিপিএম ক্যাডাররা পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত। তারা প্রায় বসে গেছে। তৃণমূলীদের হাতে তারা সর্বত্র মার খাচ্ছে। এ সুযোগে সিপিএমের জায়গায় কংগ্রেস আবার উঠে দাঁড়াতে চাইলে তৃণমূলীরা কংগ্রেসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এরই প্রতিবাদে কংগ্রেস কর্মীরা কলকাতায় বিরাট বিক্ষোভের আয়োজন করে। মমতা এতে খুব চটেছেন। এর উত্তরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বলেছেন, কংগ্রেস একটি এনজিও নয়, রাজনৈতিক দল_ তার মিছিল করার হক আছে। সিপিএম, কংগ্রেস, মাওবাদী_ এ তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদাভাবে লড়তে হচ্ছে মমতাকে। এ লড়াই তার বাঁচার লড়াই।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
No comments