মন্তব্য প্রতিবেদন-খুলে গেল স্বপ্নের দরজা by ইমদাদুল হক মিলন
দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা থেকে পাটগ্রামে বাজার করতে গেছেন একজন ছাপোষা মানুষ। সকাল সকাল হেঁটে রওনা দিয়েছেন তিনি, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ৬টা বেজে গেছে। তিনবিঘা করিডর ততক্ষণে বন্ধ। মানুষটি নিরুপায় হয়ে গেছেন। তাঁর ফেরার পথ নেই। সারা রাত পাটগ্রামের কোনো গাছতলায় বসে থেকেছেন কিংবা আশ্রয় নিয়েছেন কোনো পরিচিতজনের দরিদ্র কুটিরে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে পাটগ্রাম থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় আসা কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে।
তখন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খুলে দেওয়া হতো করিডর। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলের মানুষজন ওই সময়ের মধ্যে পাটগ্রামে যাতায়াত করতেন, পাটগ্রামের মানুষজন যাতায়াত করতেন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়। তারও আগে করিডর এক ঘণ্টা খোলা, এক ঘণ্টা বন্ধ। তাও শুধু দিনের বেলা। অদ্ভুত পরিস্থিতি।
স্থানীয় এক যুবক আমাকে বললেন, এমন অবস্থাও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের জীবনে ঘটেছে, সন্ধ্যার পর প্রসব বেদনা উঠেছে কারো, হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। নেওয়া যায়নি। অসুস্থ হয়েছেন কেউ, করিডর অতিক্রম করে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। মানুষ মারা গেছেন, তাঁর কাফনের কাপড় আনতে যাওয়া যায়নি, করিডর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। কলাপাতায় জড়িয়ে মানুষ দাফন করা হয়েছে।
এ রকম কত দুঃখ-বেদনার কথা ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে। ৬৪ বছর ধরে চলে আসছিল এ অবস্থা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য কখনো করিডর খুলে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য ৮৫ মিটার প্রস্থ তিনবিঘা করিডরের বিনিময়ে ৭.৩৯ কিলোমিটারের দক্ষিণ বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতকে ছেড়ে দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারত বেরুবাড়ী পেল ঠিকই, তিনবিঘা করিডর পেল না বাংলাদেশ।
আগের মতোই চলতে লাগল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর জীবন। '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত না হলে নিশ্চয় সেই সময়েই মিটে যেত এ সমস্যা। তারপর ৩৬ বছর কেটে গেছে। রাজনীতির কত রকম উত্থান-পতন দেখেছি আমরা। কত সরকার এল গেল। তিনবিঘা করিডরের সমস্যা কেউ সমাধান করল না। '৯৫ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে। তখন তিনি একবার দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় গিয়েছিলেন। ওই অঞ্চলের মানুষকে কথা দিয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এলে তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি।
এবার তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করলেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ অক্টোবর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় এলেন। ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দিলেন তিনবিঘা করিডর। কিছুদিন আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির কথা থাকলেও সেই চুক্তি হয়নি। তবে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সমস্যা তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়ার কাজটি হয়েছে। মিটে গেছে ৬৪ বছর ধরে ঝুলে থাকা একটি সমস্যা। এই উদ্যোগ ও অর্জনের কৃতিত্ব আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর।
দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন অন্যভাবে। তাঁরা বলেছেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমাদের। আমরা তাঁকে শুধু আমাদের ভালোবাসাটুকু দিতে চাই, আমাদের কৃতজ্ঞতাটা জানাতে চাই। কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার ১৪ হাজার ৬৬৮ জন মানুষের একজনও আমরা ঘরে থাকব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসব। তাঁর সামনে এসে দাঁড়াব। এই আমাদের কৃতজ্ঞতা, এই আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ।'
হলোও তাই।
১৯ অক্টোবর বুধবার, সকাল ১১টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার থেকে নামলেন দহগ্রাম ইউনিয়ন কাউন্সিল চত্বরে। চারদিক উজ্জ্বল করা রোদ। সেই রোদের ঔজ্জ্বল্য আরো বেড়ে গেছে ওই অঞ্চলের মানুষের মুখের আলোয়। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর। তাদের পোশাক-আশাকের রঙে ঝলমল করছে দহগ্রাম ইউনিয়ন। পোস্টার আর ব্যানারে ছেয়ে গেছে পুরো অঞ্চল। তিনি উদ্বোধন করলেন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন কার্যক্রম, ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও নবনির্মিত দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। দহগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তারপর ছিটমহলবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় হওয়ার কথা। সেই মতবিনিময় সভা হয়ে উঠল বিশাল এক জনসভা।
তারপর তিনবিঘা করিডরের দিকে রওনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেদিন মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই ছিলেন, ছিলেন উপদেষ্টাদের কেউ কেউ। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা আগেই পেঁৗছে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার এবং কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আমি।
আমার জন্য এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা এবং তিনবিঘা করিডরের কথা কাগজে পড়েছি। এবার স্বচক্ষে জায়গাটি দেখা হলো। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। করিডরের তিনবিঘা জায়গা শক্ত তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সড়ক। ওপারে পাটগ্রাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ভারতের দুজন মন্ত্রী, বিএসএফের প্রধান, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার ও অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তিনবিঘার মাঝামাঝি একটি টিলা কেটে তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। দক্ষিণ দিকের টিলার ওপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানো হলো। উত্তর দিকের টিলায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় মিডিয়াকর্মীরা অবিরাম ছবি তুলছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকায় চমৎকার করে সাজানো হয়েছে তিনবিঘা করিডর। ভারতীয় কিছু স্কুল ছাত্রছাত্রী সাদা পোশাক পরে দুই দেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে, হাসিমুখে সংবর্ধনা জানাচ্ছিল আমাদের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এত কাছ থেকে দেখা তাদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
বিকেলের মুখে মুখে পাটগ্রাম কলেজ মাঠে জনসভা। মাঠটি মাঝারি মাপের। কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। যত না মানুষ মাঠে, তার কয়েক গুণ বেশি বাইরে, চারদিকে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ওই অঞ্চলের মানুষের প্রতিটি দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ শুনল তাঁর কথা।
শেষ বিকেলে পাটগ্রাম থেকেই হেলিকপ্টার চড়েছি আমরা। এ ধরনের ভ্রমণ আমার জন্য প্রথম। সারওয়ার ভাই আগেও বহুবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। তিনি অনেকটাই অভ্যস্ত। অভ্যস্ত না হলে নানা ধরনের অসুবিধা হওয়ার কথা। আমার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি। কারণ আমাকে সারাক্ষণই ছায়ার মতো আগলে রাখছিলেন মাহবুবুল হক শাকিল। তিনি আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) প্রধান নির্বাহী। শাকিলকে সারাক্ষণই দেখলাম অতি দক্ষতায় সব দিক সামলাতে, সবার খোঁজখবর ও তদারকি করতে। এ রকম দুই-একজন কর্মঠ মানুষ থাকলে যেকোনো বড় অনুষ্ঠানই স্বার্থক হয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদও আমাদের ভালোই খোঁজখবর রেখেছেন। লেখক-সাংবাদিকদের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দুর্বলতা আছে। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রীয় কাজে নিউ ইয়র্কে গিয়ে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর বাসায়। চিকিৎসার জন্য হুমায়ূন আহমেদ এখন নিউ ইয়র্কে। লেখককে তিনি ১০ হাজার ডলারও দিয়েছেন আর জানিয়েছেন তাঁর সহানুভূতির কথা। বেশ কয়েক বছর আগে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মারা গেলেন। শেখ হাসিনা তখনো প্রধানমন্ত্রী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুর কথা শুনে তিনি সব কাজ ফেলে ছুটে গেলেন তাঁর বাড়িতে। গত বছর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী দিনে ভারতের বিখ্যাত লেখক মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিজের পাশে বসালেন। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা থেকে ফেরার সময় সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে সেনাবাহিনীর বিমানে আমরা সবাই চড়েছি। সবার শেষে প্লেনে চড়লেন তিনি। চড়েই জিজ্ঞেস করলেন, 'সারওয়ার ভাই উঠেছেন? মিলন, মিলন উঠেছে।'
তিনবিঘা করিডর সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অনুভূতি জানতে চেয়েছিলাম। হাসিমুখে বললেন, 'আমি একটা কাজ শেষ করতে পেরেছি, এই আমার আনন্দ। আর আমি যেখানেই যাই, গিয়ে প্রথমে সেখানকার চালের দামটা জানার চেষ্টা করি। এ এলাকায় এখন ২০ থেকে ২৪ টাকা কেজি চাল। মঙ্গা এলাকায় মঙ্গা নেই, এও আমার এক প্রশান্তি।'
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের মানুষের জন্য আপনার ভালোবাসা আর মমত্ববোধ বারবারই আমাদের মনে করিয়ে দেয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। আমরা আপনার কাছে সেই নেতৃত্বই চাই, যে নেতৃত্ব বাংলাদেশকে স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। পরম করুণাময় আপনাকে সেই শক্তি দান করুন।
স্থানীয় এক যুবক আমাকে বললেন, এমন অবস্থাও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের জীবনে ঘটেছে, সন্ধ্যার পর প্রসব বেদনা উঠেছে কারো, হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। নেওয়া যায়নি। অসুস্থ হয়েছেন কেউ, করিডর অতিক্রম করে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। মানুষ মারা গেছেন, তাঁর কাফনের কাপড় আনতে যাওয়া যায়নি, করিডর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। কলাপাতায় জড়িয়ে মানুষ দাফন করা হয়েছে।
এ রকম কত দুঃখ-বেদনার কথা ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে। ৬৪ বছর ধরে চলে আসছিল এ অবস্থা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য কখনো করিডর খুলে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য ৮৫ মিটার প্রস্থ তিনবিঘা করিডরের বিনিময়ে ৭.৩৯ কিলোমিটারের দক্ষিণ বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতকে ছেড়ে দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারত বেরুবাড়ী পেল ঠিকই, তিনবিঘা করিডর পেল না বাংলাদেশ।
আগের মতোই চলতে লাগল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর জীবন। '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত না হলে নিশ্চয় সেই সময়েই মিটে যেত এ সমস্যা। তারপর ৩৬ বছর কেটে গেছে। রাজনীতির কত রকম উত্থান-পতন দেখেছি আমরা। কত সরকার এল গেল। তিনবিঘা করিডরের সমস্যা কেউ সমাধান করল না। '৯৫ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে। তখন তিনি একবার দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় গিয়েছিলেন। ওই অঞ্চলের মানুষকে কথা দিয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এলে তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি।
এবার তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করলেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ অক্টোবর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় এলেন। ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দিলেন তিনবিঘা করিডর। কিছুদিন আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির কথা থাকলেও সেই চুক্তি হয়নি। তবে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সমস্যা তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়ার কাজটি হয়েছে। মিটে গেছে ৬৪ বছর ধরে ঝুলে থাকা একটি সমস্যা। এই উদ্যোগ ও অর্জনের কৃতিত্ব আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর।
দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন অন্যভাবে। তাঁরা বলেছেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমাদের। আমরা তাঁকে শুধু আমাদের ভালোবাসাটুকু দিতে চাই, আমাদের কৃতজ্ঞতাটা জানাতে চাই। কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার ১৪ হাজার ৬৬৮ জন মানুষের একজনও আমরা ঘরে থাকব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসব। তাঁর সামনে এসে দাঁড়াব। এই আমাদের কৃতজ্ঞতা, এই আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ।'
হলোও তাই।
১৯ অক্টোবর বুধবার, সকাল ১১টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার থেকে নামলেন দহগ্রাম ইউনিয়ন কাউন্সিল চত্বরে। চারদিক উজ্জ্বল করা রোদ। সেই রোদের ঔজ্জ্বল্য আরো বেড়ে গেছে ওই অঞ্চলের মানুষের মুখের আলোয়। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর। তাদের পোশাক-আশাকের রঙে ঝলমল করছে দহগ্রাম ইউনিয়ন। পোস্টার আর ব্যানারে ছেয়ে গেছে পুরো অঞ্চল। তিনি উদ্বোধন করলেন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন কার্যক্রম, ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও নবনির্মিত দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। দহগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তারপর ছিটমহলবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় হওয়ার কথা। সেই মতবিনিময় সভা হয়ে উঠল বিশাল এক জনসভা।
তারপর তিনবিঘা করিডরের দিকে রওনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেদিন মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই ছিলেন, ছিলেন উপদেষ্টাদের কেউ কেউ। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা আগেই পেঁৗছে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার এবং কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আমি।
আমার জন্য এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা এবং তিনবিঘা করিডরের কথা কাগজে পড়েছি। এবার স্বচক্ষে জায়গাটি দেখা হলো। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। করিডরের তিনবিঘা জায়গা শক্ত তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সড়ক। ওপারে পাটগ্রাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ভারতের দুজন মন্ত্রী, বিএসএফের প্রধান, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার ও অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তিনবিঘার মাঝামাঝি একটি টিলা কেটে তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। দক্ষিণ দিকের টিলার ওপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানো হলো। উত্তর দিকের টিলায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় মিডিয়াকর্মীরা অবিরাম ছবি তুলছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকায় চমৎকার করে সাজানো হয়েছে তিনবিঘা করিডর। ভারতীয় কিছু স্কুল ছাত্রছাত্রী সাদা পোশাক পরে দুই দেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে, হাসিমুখে সংবর্ধনা জানাচ্ছিল আমাদের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এত কাছ থেকে দেখা তাদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
বিকেলের মুখে মুখে পাটগ্রাম কলেজ মাঠে জনসভা। মাঠটি মাঝারি মাপের। কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। যত না মানুষ মাঠে, তার কয়েক গুণ বেশি বাইরে, চারদিকে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ওই অঞ্চলের মানুষের প্রতিটি দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ শুনল তাঁর কথা।
শেষ বিকেলে পাটগ্রাম থেকেই হেলিকপ্টার চড়েছি আমরা। এ ধরনের ভ্রমণ আমার জন্য প্রথম। সারওয়ার ভাই আগেও বহুবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। তিনি অনেকটাই অভ্যস্ত। অভ্যস্ত না হলে নানা ধরনের অসুবিধা হওয়ার কথা। আমার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি। কারণ আমাকে সারাক্ষণই ছায়ার মতো আগলে রাখছিলেন মাহবুবুল হক শাকিল। তিনি আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) প্রধান নির্বাহী। শাকিলকে সারাক্ষণই দেখলাম অতি দক্ষতায় সব দিক সামলাতে, সবার খোঁজখবর ও তদারকি করতে। এ রকম দুই-একজন কর্মঠ মানুষ থাকলে যেকোনো বড় অনুষ্ঠানই স্বার্থক হয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদও আমাদের ভালোই খোঁজখবর রেখেছেন। লেখক-সাংবাদিকদের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দুর্বলতা আছে। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রীয় কাজে নিউ ইয়র্কে গিয়ে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর বাসায়। চিকিৎসার জন্য হুমায়ূন আহমেদ এখন নিউ ইয়র্কে। লেখককে তিনি ১০ হাজার ডলারও দিয়েছেন আর জানিয়েছেন তাঁর সহানুভূতির কথা। বেশ কয়েক বছর আগে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মারা গেলেন। শেখ হাসিনা তখনো প্রধানমন্ত্রী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুর কথা শুনে তিনি সব কাজ ফেলে ছুটে গেলেন তাঁর বাড়িতে। গত বছর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী দিনে ভারতের বিখ্যাত লেখক মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিজের পাশে বসালেন। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা থেকে ফেরার সময় সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে সেনাবাহিনীর বিমানে আমরা সবাই চড়েছি। সবার শেষে প্লেনে চড়লেন তিনি। চড়েই জিজ্ঞেস করলেন, 'সারওয়ার ভাই উঠেছেন? মিলন, মিলন উঠেছে।'
তিনবিঘা করিডর সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অনুভূতি জানতে চেয়েছিলাম। হাসিমুখে বললেন, 'আমি একটা কাজ শেষ করতে পেরেছি, এই আমার আনন্দ। আর আমি যেখানেই যাই, গিয়ে প্রথমে সেখানকার চালের দামটা জানার চেষ্টা করি। এ এলাকায় এখন ২০ থেকে ২৪ টাকা কেজি চাল। মঙ্গা এলাকায় মঙ্গা নেই, এও আমার এক প্রশান্তি।'
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের মানুষের জন্য আপনার ভালোবাসা আর মমত্ববোধ বারবারই আমাদের মনে করিয়ে দেয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। আমরা আপনার কাছে সেই নেতৃত্বই চাই, যে নেতৃত্ব বাংলাদেশকে স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। পরম করুণাময় আপনাকে সেই শক্তি দান করুন।
No comments