বিমানবাহিনীর প্রস্তাব সংসদ ও আদালতের অবমাননা by মিজানুর রহমান খান
তেজগাঁওয়ে সীমিত বিমান চলাচলের স্টলপোর্টকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া এবং জাতীয় সংসদের আগাম সম্মতি ছাড়া তার চত্বরের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্ত অন্তত দুটি আইনের লঙ্ঘন ঘটাবে। এটা হবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবমাননারও শামিল। সংসদের জন্যও অবমাননাকর। স্পিকার আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি লুই কানের নকশা খতিয়ে দেখতে চান। এ জন্য এই নকশা সরবরাহে পূর্ত বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।
র্যাংগসের মামলায় তেজগাঁওয়ের আশপাশের উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য হাইকোর্ট বিমানবাহিনীকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন। হাইকোর্ট বলেছিলেন, বিমানবাহিনীর নির্দেশেই র্যাংগস ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল রাজউক। এরপর বিমানবাহিনীর প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করে রায়ে লেখা হয়, ‘তারা যত বড়ই হোক না কেন, রাজউক তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না।’ মেট্রোরেলের যে উচ্চতা ও রুট প্রথমে অনুমোদিত হয়েছিল, তা নিয়ে রাজউক আপত্তি করেনি।
মহাপরিকল্পনা: জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং ইউএনসিএইচএসের (ইউনাইটেড ন্যাশনস সেন্টার ফর হিউম্যান সেটেলমেন্টস) কারিগরি সহায়তায় আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলে ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান পাস হয়। ১৯৬৯ সালের মাস্টারপ্ল্যান বাতিল করে এটাই দেশের ইতিহাসের প্রথম মাস্টারপ্ল্যান। এর দ্বিতীয় ভলিউমের ৪৭ পৃষ্ঠায় পুরোনো বিমানবন্দর এবং সংসদের উত্তর দিকের (আগারগাঁও) এলাকার জন্য ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এই দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তেজগাঁওয়ে কোনো বিমানবন্দর নয়, বরং এখানে ক্ষুদ্র পরিসরের একটি স্টলপোর্ট রাখারই চিন্তা ছিল। কারণ, এতে বলা হয়েছিল, ‘পুরোনো বিমানবন্দর বর্তমানে স্টল সার্ভিসের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর সীমিত সামরিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন বিদ্যমান এলাকার কোনো অংশ অন্য কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর বিস্তারিত সমীক্ষা হওয়া উচিত।’
ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা এরপর ‘অঙ্গীকার করা/প্রয়োজনীয়/সুপারিশকৃত’ উপশিরোনামে লিখেছেন, ‘পুরোনো বিমানবন্দর ও সংসদের উত্তর দিকের জায়গা ন্যাশনাল স্কয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার কথা। তেজগাঁও বিমানবন্দরের অংশবিশেষ যখন স্টল এয়ারপোর্ট হবে এবং এর বাকি অংশের ওপর থেকে সামরিক মর্যাদা তুলে নেওয়া হবে, তখন থেকে এই এলাকা হবে উন্মুক্ত স্থান এবং অবকাশযাপনের কেন্দ্র। আর সেটা কিন্তু শহীদ জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি খন্দকার এম আনসার হোসেন, যিনি এর আগে সরকারি কমিটির তরফে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ড্যাপ বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন, তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০১০ সালের জুনে যে ১৯ ভলিউম ড্যাপ রিপোর্ট জমা দিয়েছি, তার মূল আইনি ভিত্তি ওই মাস্টারপ্ল্যান। আমরা অবশ্য তেজগাঁও ও সেনানিবাস এলাকার ড্যাপ তৈরি করিনি। এটা রাজউক নয়, সরকারের নির্দেশে এটা করার দায়িত্ব ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের।’
দুটি প্রজ্ঞাপন: ৫ এপ্রিল ১৯৯৭ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ১৯৫৩ সালের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের ৭৩ ধারার শর্তাদি পূরণ করে রাজউক ৫ মার্চ ১৯৯৭ ওই মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করে সরকারের কাছে পেশ করে। এর ওপর কোনো ক্ষতিগ্রস্ত অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির আপত্তি থাকলে তাকে ওই প্রজ্ঞাপন জারির ৬০ দিনের মধ্যে চিফ টাউন প্ল্যানার, ডিএমডিপি বরাবরে আপত্তি বা সুপারিশ দাখিল করার জন্য অনুরোধ জানায়। এরপর ৪ আগস্ট ১৯৯৭ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-২) এম এ রাজ্জাক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার ওই সময়সীমার মধ্যে প্রাপ্ত আপত্তি বা সুপারিশ বিবেচনা করে কতিপয় সংশোধনীসহ নতুন মাস্টারপ্ল্যানটি (১৯৯৫-২০১৫) অনুমোদন করেছে।
র্যাংগসের মামলায় বৈধতা: ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় ২২ তলা র্যাংগস ভবন ভাঙা হয়। এই মামলায় (রউফ চৌধুরী বনাম রাজউক) উচ্চ আদালতে মূল বিচার্য ছিল তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরের কাছাকাছি এই উঁচু ভবন নির্মাণ করা যাবে কি না।
বিচারপতি মো. আবদুর রশীদ তাঁর রায়ে ১৯৯৭ সালের সরকারি প্রজ্ঞাপন থেকে নির্দিষ্টভাবে ওই ৪৭ পৃষ্ঠার বরাতে পুরোনো বিমানবন্দরটিকে একটি ন্যাশনাল স্কয়ার হিসেবে ব্যবহার হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি আবদুর রশীদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেওয়া রায়ে র্যাংগসের ২২ তলা ভবনের নির্মাণ বৈধতা পায়। রায়ে দেখানো হয়, ১৯৯৯ সালের মার্চে বিমানবাহিনী ও রাজউকের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তাতে তারা ওই মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে আপত্তি তোলেনি। দীর্ঘ সাত বছর পর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি হয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। পাঁচ বিচারপতি মো. ফজলুল করিম, এম এম রুহুল আমিন, মো. তাফাজ্জাল ইসলাম, মো. জয়নুল আবেদীন ও মো. হাসান আমিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২ আগস্ট ২০০৭ র্যাংগসের ২২ তলা ভবনের স্থান নির্বাচন প্রশ্নে হাইকোর্টের সঙ্গে যথারীতি একমত হন। তবে তাঁরা রাজউকের আপিলের আংশিক বৈধতা দিয়ে বলেন, ছয় তলার ওপরের অংশ অবৈধ। এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের রেওয়াজ হচ্ছে, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কোনো অংশ নির্দিষ্টভাবে রহিত বা উল্টে না দিলে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণের আইনি ওজন ও মূল্য টিকে থাকে। ৬১ ডিএলআরের ২৪ পৃষ্ঠাজুড়ে (২৮ থেকে ৫৩) মুদ্রিত রাজউক বনাম রউফ চৌধুরী বর্ণিত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কোথাও ওই মাস্টারপ্ল্যানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি।
বিমানবাহিনীর বর্তমান অবস্থান স্পষ্টতই মাস্টারপ্ল্যান-বিরোধী এবং সেই কারণে মেট্রোরেল রুট পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
হাইকোর্টের আশঙ্কা: মেট্টোরেল নিয়ে বিমানবাহিনীর আপত্তি মানায় ১৯৯৭ সালে নেওয়া আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের ওই সিদ্ধান্ত ছাড়াও বর্তমান আমলে নেওয়া আরও একটি সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন ঘটছে। ২০০৪ সালের ২১ জুন সংসদ চত্বরে স্পিকারের বাড়ি নির্মাণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি মো. ইমান আলী সরকারি জমি সরকারের ইচ্ছামতো ব্যবহারে অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ লুই কানের নকশা গুরুত্বহীন প্রমাণ করতে বলেছিল, তিনি তো শুধুই একজন কনসালট্যান্ট ছিলেন। হাইকোর্ট এর তিরস্কার করেন। হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘সংসদ চত্বরকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ঘোষণা না করে সরকারের যে ঔদ্ধত্য আমরা দেখছি, তাতে আশঙ্কা করি, এই জায়গাটি আর জাতির গর্বের বিষয় থাকবে না।’ আদালত তাঁর রায়ে স্পিকারের বাড়ি নির্মাণকে অবৈধ এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ঘোষণা এবং একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণায় ইউনেস্কোর কাছে আবেদন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
নতুন প্রজ্ঞাপন: ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইমারত বিধিমালা ২০০৮-এর উপবিধি ৬১ অনুযায়ী ‘রাজউকের মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকার ঐতিহাসিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বিবেচনায় নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদনক্রমে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ভবন/স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে ৮১ নম্বর ক্রমিকে ‘জাতীয় সংসদ ভবন এবং শেরেবাংলা নগর কমপ্লেক্স’ সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে করা ওই গেজেট মতেই সংসদ চত্বরে নতুন কাঠামো করা যায় না। এর ফলে জাতীয় সংসদের খেজুরবাগান ক্ষতিগ্রস্ত করে বিমানবাহিনীর আপত্তির মুখে মেট্রোরেলের যে বিকল্প রুট তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন আইনি বাধার মুখে পড়তে পারে।
স্পিকার আবদুল হামিদ ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছেন যে, সংসদ সচিবালয়কে অন্ধকারে রেখেই সরকার সংসদের জমিতে মেট্রোরেল নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে।
মহাপরিকল্পনা: জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং ইউএনসিএইচএসের (ইউনাইটেড ন্যাশনস সেন্টার ফর হিউম্যান সেটেলমেন্টস) কারিগরি সহায়তায় আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের আমলে ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান পাস হয়। ১৯৬৯ সালের মাস্টারপ্ল্যান বাতিল করে এটাই দেশের ইতিহাসের প্রথম মাস্টারপ্ল্যান। এর দ্বিতীয় ভলিউমের ৪৭ পৃষ্ঠায় পুরোনো বিমানবন্দর এবং সংসদের উত্তর দিকের (আগারগাঁও) এলাকার জন্য ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এই দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তেজগাঁওয়ে কোনো বিমানবন্দর নয়, বরং এখানে ক্ষুদ্র পরিসরের একটি স্টলপোর্ট রাখারই চিন্তা ছিল। কারণ, এতে বলা হয়েছিল, ‘পুরোনো বিমানবন্দর বর্তমানে স্টল সার্ভিসের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর সীমিত সামরিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন বিদ্যমান এলাকার কোনো অংশ অন্য কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর বিস্তারিত সমীক্ষা হওয়া উচিত।’
ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা এরপর ‘অঙ্গীকার করা/প্রয়োজনীয়/সুপারিশকৃত’ উপশিরোনামে লিখেছেন, ‘পুরোনো বিমানবন্দর ও সংসদের উত্তর দিকের জায়গা ন্যাশনাল স্কয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার কথা। তেজগাঁও বিমানবন্দরের অংশবিশেষ যখন স্টল এয়ারপোর্ট হবে এবং এর বাকি অংশের ওপর থেকে সামরিক মর্যাদা তুলে নেওয়া হবে, তখন থেকে এই এলাকা হবে উন্মুক্ত স্থান এবং অবকাশযাপনের কেন্দ্র। আর সেটা কিন্তু শহীদ জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি খন্দকার এম আনসার হোসেন, যিনি এর আগে সরকারি কমিটির তরফে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ড্যাপ বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন, তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০১০ সালের জুনে যে ১৯ ভলিউম ড্যাপ রিপোর্ট জমা দিয়েছি, তার মূল আইনি ভিত্তি ওই মাস্টারপ্ল্যান। আমরা অবশ্য তেজগাঁও ও সেনানিবাস এলাকার ড্যাপ তৈরি করিনি। এটা রাজউক নয়, সরকারের নির্দেশে এটা করার দায়িত্ব ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের।’
দুটি প্রজ্ঞাপন: ৫ এপ্রিল ১৯৯৭ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ১৯৫৩ সালের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের ৭৩ ধারার শর্তাদি পূরণ করে রাজউক ৫ মার্চ ১৯৯৭ ওই মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করে সরকারের কাছে পেশ করে। এর ওপর কোনো ক্ষতিগ্রস্ত অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির আপত্তি থাকলে তাকে ওই প্রজ্ঞাপন জারির ৬০ দিনের মধ্যে চিফ টাউন প্ল্যানার, ডিএমডিপি বরাবরে আপত্তি বা সুপারিশ দাখিল করার জন্য অনুরোধ জানায়। এরপর ৪ আগস্ট ১৯৯৭ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-২) এম এ রাজ্জাক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার ওই সময়সীমার মধ্যে প্রাপ্ত আপত্তি বা সুপারিশ বিবেচনা করে কতিপয় সংশোধনীসহ নতুন মাস্টারপ্ল্যানটি (১৯৯৫-২০১৫) অনুমোদন করেছে।
র্যাংগসের মামলায় বৈধতা: ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় ২২ তলা র্যাংগস ভবন ভাঙা হয়। এই মামলায় (রউফ চৌধুরী বনাম রাজউক) উচ্চ আদালতে মূল বিচার্য ছিল তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরের কাছাকাছি এই উঁচু ভবন নির্মাণ করা যাবে কি না।
বিচারপতি মো. আবদুর রশীদ তাঁর রায়ে ১৯৯৭ সালের সরকারি প্রজ্ঞাপন থেকে নির্দিষ্টভাবে ওই ৪৭ পৃষ্ঠার বরাতে পুরোনো বিমানবন্দরটিকে একটি ন্যাশনাল স্কয়ার হিসেবে ব্যবহার হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি আবদুর রশীদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেওয়া রায়ে র্যাংগসের ২২ তলা ভবনের নির্মাণ বৈধতা পায়। রায়ে দেখানো হয়, ১৯৯৯ সালের মার্চে বিমানবাহিনী ও রাজউকের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তাতে তারা ওই মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে আপত্তি তোলেনি। দীর্ঘ সাত বছর পর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি হয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। পাঁচ বিচারপতি মো. ফজলুল করিম, এম এম রুহুল আমিন, মো. তাফাজ্জাল ইসলাম, মো. জয়নুল আবেদীন ও মো. হাসান আমিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২ আগস্ট ২০০৭ র্যাংগসের ২২ তলা ভবনের স্থান নির্বাচন প্রশ্নে হাইকোর্টের সঙ্গে যথারীতি একমত হন। তবে তাঁরা রাজউকের আপিলের আংশিক বৈধতা দিয়ে বলেন, ছয় তলার ওপরের অংশ অবৈধ। এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের রেওয়াজ হচ্ছে, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কোনো অংশ নির্দিষ্টভাবে রহিত বা উল্টে না দিলে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণের আইনি ওজন ও মূল্য টিকে থাকে। ৬১ ডিএলআরের ২৪ পৃষ্ঠাজুড়ে (২৮ থেকে ৫৩) মুদ্রিত রাজউক বনাম রউফ চৌধুরী বর্ণিত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কোথাও ওই মাস্টারপ্ল্যানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি।
বিমানবাহিনীর বর্তমান অবস্থান স্পষ্টতই মাস্টারপ্ল্যান-বিরোধী এবং সেই কারণে মেট্রোরেল রুট পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
হাইকোর্টের আশঙ্কা: মেট্টোরেল নিয়ে বিমানবাহিনীর আপত্তি মানায় ১৯৯৭ সালে নেওয়া আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের ওই সিদ্ধান্ত ছাড়াও বর্তমান আমলে নেওয়া আরও একটি সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন ঘটছে। ২০০৪ সালের ২১ জুন সংসদ চত্বরে স্পিকারের বাড়ি নির্মাণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি মো. ইমান আলী সরকারি জমি সরকারের ইচ্ছামতো ব্যবহারে অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ লুই কানের নকশা গুরুত্বহীন প্রমাণ করতে বলেছিল, তিনি তো শুধুই একজন কনসালট্যান্ট ছিলেন। হাইকোর্ট এর তিরস্কার করেন। হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘সংসদ চত্বরকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ঘোষণা না করে সরকারের যে ঔদ্ধত্য আমরা দেখছি, তাতে আশঙ্কা করি, এই জায়গাটি আর জাতির গর্বের বিষয় থাকবে না।’ আদালত তাঁর রায়ে স্পিকারের বাড়ি নির্মাণকে অবৈধ এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিকে ন্যাশনাল হেরিটেজ ঘোষণা এবং একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণায় ইউনেস্কোর কাছে আবেদন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
নতুন প্রজ্ঞাপন: ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইমারত বিধিমালা ২০০৮-এর উপবিধি ৬১ অনুযায়ী ‘রাজউকের মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকার ঐতিহাসিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বিবেচনায় নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদনক্রমে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ভবন/স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে ৮১ নম্বর ক্রমিকে ‘জাতীয় সংসদ ভবন এবং শেরেবাংলা নগর কমপ্লেক্স’ সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে করা ওই গেজেট মতেই সংসদ চত্বরে নতুন কাঠামো করা যায় না। এর ফলে জাতীয় সংসদের খেজুরবাগান ক্ষতিগ্রস্ত করে বিমানবাহিনীর আপত্তির মুখে মেট্রোরেলের যে বিকল্প রুট তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন আইনি বাধার মুখে পড়তে পারে।
স্পিকার আবদুল হামিদ ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছেন যে, সংসদ সচিবালয়কে অন্ধকারে রেখেই সরকার সংসদের জমিতে মেট্রোরেল নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে।
No comments