ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে ইসলাম মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির সেরা জীব বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হচ্ছে মানবজাতি। প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষই এক ও অভিন্ন। তবে অবস্থানগতভাবে কিছুটা পার্থক্য ও বৈষম্য রয়েছে। কিছু উঁচু বংশের, কেউ নিচু বংশের, আবার কেউ ধনী, কেউ দরিদ্র, কেউ চাকর, কেউ মনিব। তবে বংশ-গোত্র, জাতি-বর্ণ ও অবস্থানগত তারতম্য আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বা এর কোনোটিই তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। মানবসমাজে ধনী-দরিদ্রের এ ধরনের শ্রেণীভেদ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী; কিন্তু আল্লাহ, তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’ (সূরা আল-ফাতির, আয়াত-১৫)
ইসলাম দুস্থ মানবতা, নিঃস্ব্ব-গরিব কাঙালের স্বার্থ সংরক্ষণের ন্যায়সংগত অধিকার বা হকগুলো ফরজ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। দান-খয়রাত, সাদকা, জাকাত, উশর, করজে হাসানা, সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা ইত্যাদি ছাড়া দেশের প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী গরিব-দুস্থ, নিঃস্ব-অসহায় কাঙালেরা ধনাঢ্য, বিত্তবান ও অর্থশালীদের অর্থসম্পদ থেকে যে ধরনের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করতে পারে, তা ইসলামের সম্পদ বণ্টন নীতিমালায় সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে তা যথাযথভাবে আদায়ের জোরালো তাগিদও প্রদান করা হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতিতে সর্বপ্রকার ধনসম্পদ বণ্টনের মূলনীতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘ধনসম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭)
ইসলামে মানবসমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ধনদৌলত, অর্থসম্পদের উদারতা ও আদল-ইনসাফের দ্বারা গরিবের ন্যায্য প্রাপ্য, হতদরিদ্রের হক বা অধিকার ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত করেছে। ধনীদের অর্থসম্পদের ওপর যে দরিদ্রের হক রয়েছে, পবিত্র কোরআনে তা বারবারই উচ্চারিত হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনী লোকদের) সম্পদে অবশ্যই প্রার্থী (দরিদ্র) ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা আল-যারিআত, আয়াত: ১৯)
অন্যদিকে দরিদ্রের স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্যও ধনীদের প্রতি তাদের অধিকারকে নির্দিষ্ট করেছে। ইসলামের অর্থনীতিতে জাকাত-ফিতরা, সাদাকা এবং দান-খয়রাত কেবল গরিবদের বেলায় প্রাপ্য, দরিদ্রদের এগুলো হলো মৌলিক অধিকার। ইসলামে জাকাতব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবসেবা তথা হতদরিদ্র মুসলমানদের আর্থসামাজিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সাদাকাত বা জাকাত দরিদ্র, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী কর্মচারী, ইসলামের প্রতি যাদের মন আকৃষ্ট করার প্রয়োজন, বন্দী, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায় নিয়োজিত এবং বিপদগ্রস্ত পথিকের জন্য (ব্যয়িত হবে); এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান, আর তিনি মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৬০)
জাকাতের মাধ্যমে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। ধনীরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ বছরান্তে জাকাত প্রদান করে মানবসেবায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ইসলামি বণ্টনব্যবস্থায় ধনীরা তাদের ধনসম্পদের কিছু অংশ দরিদ্রদের জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হয়।
পবিত্র কোরআনে ৩২টি আয়াতে সরাসরি জাকাতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি আয়াতে সালাতের সঙ্গে জাকাত আদায়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৯০টি আয়াতে কারিমায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জাকাত, সাদকা, ফিতরা আর ধনসম্পদ এবং তা ব্যয়ের বিষয়ে আলোচনা এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক হকদারকে তার ন্যায্য অধিকার দিয়ে দাও।’ (বুখারি) নবী করিম (সা.) ফরমান, ‘আমির ও ধনী লোকের ৪০ বছর আগে দরিদ্র বা গরিব লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করবেন, “তোমরা দেখো তো, আমার প্রিয় বান্দাকুল কোথায়?” ফেরেশতারা নিবেদন করবেন, “হে রাব্বুল আলামিন! কারা আপনার প্রিয় বান্দা?” আল্লাহর থেকে উত্তর আসবে, “তারা হবে মুসলমান গরিব-দরিদ্র লোক, আমার দানে ও নিয়ামতে তারা পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট ছিল তাদের জান্নাতে নিয়ে যাও”।’
দরিদ্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দান-খয়রাত এবং বিবিধ রকম সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য ও দায়িত্ব।’ সাহাবায়ে কিরাম নবীজির মুখ-নিঃসৃত বাণী শুনে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! যার সামর্থ্য নেই, সেই ব্যক্তি কীভাবে তার কর্তব্য পালন করবে?’ তদুত্তরে তিনি বললেন, ‘শক্তি দিয়ে পরিশ্রম করবে এবং সেই পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দ্বারা নিজে উপকৃত হবে এবং গরিব-দুঃখীজনকে অকাতরে দান-খয়রাত করবে।’ সাহাবিগণ আরজ করলেন, ‘যদি এমন কেউ সুযোগ না পায়?’ নবীজি বললেন, ‘যতই তোমাদের কষ্ট হোক, দুঃখ-দুর্দশায় পতিত অভাবগ্রস্ত গরিব-মিসকিনদের সর্বপ্রকার আপদ-বিপদে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। অসহায়-উপায়হীন মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবে।’
মানবজাতি প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার অগণিত নিয়ামত উপভোগ করছে, তাই মহান আল্লাহর বান্দা হিসেবে গরিব-অসহায় আর্তমানবতার সেবা, সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও উপকার সাধন করা মুসলমানদের অবশ্যকর্তব্য। দান-খয়রাতের উপযুক্ত পাত্র হলো সমাজের হতদরিদ্র ব্যক্তিরা এবং যে বা যারা আল্লাহ পাকের দ্বীন ইসলামের খেদমতে থেকে সৎপথে জীবন নির্বাহ করছে, তারাই প্রকৃত ঈমানদার।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
ইসলাম দুস্থ মানবতা, নিঃস্ব্ব-গরিব কাঙালের স্বার্থ সংরক্ষণের ন্যায়সংগত অধিকার বা হকগুলো ফরজ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। দান-খয়রাত, সাদকা, জাকাত, উশর, করজে হাসানা, সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা ইত্যাদি ছাড়া দেশের প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী গরিব-দুস্থ, নিঃস্ব-অসহায় কাঙালেরা ধনাঢ্য, বিত্তবান ও অর্থশালীদের অর্থসম্পদ থেকে যে ধরনের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করতে পারে, তা ইসলামের সম্পদ বণ্টন নীতিমালায় সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে তা যথাযথভাবে আদায়ের জোরালো তাগিদও প্রদান করা হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতিতে সর্বপ্রকার ধনসম্পদ বণ্টনের মূলনীতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘ধনসম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭)
ইসলামে মানবসমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ধনদৌলত, অর্থসম্পদের উদারতা ও আদল-ইনসাফের দ্বারা গরিবের ন্যায্য প্রাপ্য, হতদরিদ্রের হক বা অধিকার ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত করেছে। ধনীদের অর্থসম্পদের ওপর যে দরিদ্রের হক রয়েছে, পবিত্র কোরআনে তা বারবারই উচ্চারিত হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনী লোকদের) সম্পদে অবশ্যই প্রার্থী (দরিদ্র) ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা আল-যারিআত, আয়াত: ১৯)
অন্যদিকে দরিদ্রের স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্যও ধনীদের প্রতি তাদের অধিকারকে নির্দিষ্ট করেছে। ইসলামের অর্থনীতিতে জাকাত-ফিতরা, সাদাকা এবং দান-খয়রাত কেবল গরিবদের বেলায় প্রাপ্য, দরিদ্রদের এগুলো হলো মৌলিক অধিকার। ইসলামে জাকাতব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবসেবা তথা হতদরিদ্র মুসলমানদের আর্থসামাজিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সাদাকাত বা জাকাত দরিদ্র, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী কর্মচারী, ইসলামের প্রতি যাদের মন আকৃষ্ট করার প্রয়োজন, বন্দী, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায় নিয়োজিত এবং বিপদগ্রস্ত পথিকের জন্য (ব্যয়িত হবে); এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান, আর তিনি মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৬০)
জাকাতের মাধ্যমে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। ধনীরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ বছরান্তে জাকাত প্রদান করে মানবসেবায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ইসলামি বণ্টনব্যবস্থায় ধনীরা তাদের ধনসম্পদের কিছু অংশ দরিদ্রদের জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হয়।
পবিত্র কোরআনে ৩২টি আয়াতে সরাসরি জাকাতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি আয়াতে সালাতের সঙ্গে জাকাত আদায়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৯০টি আয়াতে কারিমায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জাকাত, সাদকা, ফিতরা আর ধনসম্পদ এবং তা ব্যয়ের বিষয়ে আলোচনা এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক হকদারকে তার ন্যায্য অধিকার দিয়ে দাও।’ (বুখারি) নবী করিম (সা.) ফরমান, ‘আমির ও ধনী লোকের ৪০ বছর আগে দরিদ্র বা গরিব লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করবেন, “তোমরা দেখো তো, আমার প্রিয় বান্দাকুল কোথায়?” ফেরেশতারা নিবেদন করবেন, “হে রাব্বুল আলামিন! কারা আপনার প্রিয় বান্দা?” আল্লাহর থেকে উত্তর আসবে, “তারা হবে মুসলমান গরিব-দরিদ্র লোক, আমার দানে ও নিয়ামতে তারা পরিতৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট ছিল তাদের জান্নাতে নিয়ে যাও”।’
দরিদ্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দান-খয়রাত এবং বিবিধ রকম সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য ও দায়িত্ব।’ সাহাবায়ে কিরাম নবীজির মুখ-নিঃসৃত বাণী শুনে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! যার সামর্থ্য নেই, সেই ব্যক্তি কীভাবে তার কর্তব্য পালন করবে?’ তদুত্তরে তিনি বললেন, ‘শক্তি দিয়ে পরিশ্রম করবে এবং সেই পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দ্বারা নিজে উপকৃত হবে এবং গরিব-দুঃখীজনকে অকাতরে দান-খয়রাত করবে।’ সাহাবিগণ আরজ করলেন, ‘যদি এমন কেউ সুযোগ না পায়?’ নবীজি বললেন, ‘যতই তোমাদের কষ্ট হোক, দুঃখ-দুর্দশায় পতিত অভাবগ্রস্ত গরিব-মিসকিনদের সর্বপ্রকার আপদ-বিপদে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। অসহায়-উপায়হীন মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবে।’
মানবজাতি প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার অগণিত নিয়ামত উপভোগ করছে, তাই মহান আল্লাহর বান্দা হিসেবে গরিব-অসহায় আর্তমানবতার সেবা, সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও উপকার সাধন করা মুসলমানদের অবশ্যকর্তব্য। দান-খয়রাতের উপযুক্ত পাত্র হলো সমাজের হতদরিদ্র ব্যক্তিরা এবং যে বা যারা আল্লাহ পাকের দ্বীন ইসলামের খেদমতে থেকে সৎপথে জীবন নির্বাহ করছে, তারাই প্রকৃত ঈমানদার।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
No comments