বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়দাতা ও পৃষ্ঠপোষক

লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের আশ্রয়দাতা। তিনি শুধু তাঁদের আশ্রয়ই দেননি, খুনিদের ক্ষমা করার জন্য ১৯৯৬ সালে চিঠিও লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। শুধু বাংলাদেশের খুনিদের নয়, লকারবি হামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদেল বাসেত আল মেগরাহিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত আগস্টে দৃশ্যত গাদ্দাফির প্রাসাদ পতনের পর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশীদের কোনো হদিস মিলছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছেন, রশীদসহ অন্য খুনিরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন।


বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তদের একজন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে জানান, খুনি রশিদ লিবিয়ার বেনগাজিতে অবস্থান করে গাদ্দাফি পরিবারের সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও তিনি বেনগাজিতে ছিলেন এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের কয়েকজনের আনাগোনা ছিল বলে সরকারি সূত্রগুলো নিশ্চিত হয়েছে। তাই গাদ্দাফির পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের লিবিয়ায় অবস্থান নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল তেমন আভাসও ছিল।
খুনি রশিদ তাহলে এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে সরকারের কাছে যে খবর আছে সে অনুযায়ী বারবার অবস্থান বদল করা খুনিদের মধ্যে তিনিও একজন।
বাংলাদেশ এবার খুনি রশিদকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে লিবিয়ার সাহায্য চাইবে কি না জানতে চাইলে সাবেক ওই কূটনীতিক বলেন, গাদ্দাফিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়দাতা। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আগামী দিনগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য বিষয়টি উঠতেই পারে।
ওই কূটনীতিক আরো বলেন, কেবল বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরই নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশের খুুনিদের গাদ্দাফি আশ্রয় দিয়েছেন। লকারবি বোমা হামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে স্বাগত জানাতে তিনি বিমানবন্দরে পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। গাদ্দাফির মন্ত্রিসভার সাবেক এক সদস্য কয়েক দিন আগে দাবি করেছেন, গাদ্দাফিই লকারবি হামলার নির্দেশদাতা।
সাবেক ওই কূটনীতিক মনে করেন, গাদ্দাফির পতন ও অবশেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিশ্বে 'খুনিদের একজন অভিভাবকের' সংখ্যা কমল। নতুন লিবিয়া খুনিদের আশ্রয়স্থল হবে না বলেই প্রত্যাশা করা হয়। তিনি আরো বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, খুনিদের ফিরিয়ে দিতে আরো অনেক দেশ লিবিয়ার প্রতি অনুরোধ জানাবে বলে তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পরদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন হয়ে থ্যাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে চলে যান। পাকিস্তান সরকারের দেওয়া একটি বিমানে ব্যাংকক থেকে তাঁদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ায় তাঁদের সাদরে গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে লিবিয়ায় তাঁদের বিশেষ করে খুনি কর্নেল (বরখাস্ত) রশিদ ও মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিমকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে মুয়াম্মার গাদ্দাফির প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। তাঁরা সেখানে অবস্থানকালে ১৯৭৬ সালের ৮ জুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১২ খুনিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দেন। ওই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (পরে পররাষ্ট্রসচিব, বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা) শমসের মবিন চৌধুরী তাঁদের নিয়োগপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন বলে খুনিরা বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে। তবে খুনি রশিদ দূতাবাসের চাকরি না নিয়ে জিয়াউর রহমানের সরকার ও গাদ্দাফির সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে লিবিয়ায় ব্যবসা শুরু করেন। অন্যদিকে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করেছেন মেজর (বরখাস্ত) শরীফুল হক ডালিম।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতেও খুনি রশিদ যে লিবিয়ার বেনগাজিতে ছিলেন এবং সেখানে ডালিমসহ আরো কয়েকজনের আনাগোনা ছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে তাঁরা বিদেশে বসে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছেন।
এদিকে গত ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ১৯৯৬ সালে গাদ্দাফি তাঁকে কোরআনের আয়াত তুলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমা করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তিনিও পাল্টা কোরআনের আয়াত তুলে ধরে চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলেন, সন্তান হিসেবে তাঁরা তাঁদের বাবা-মায়ের খুনিদের ক্ষমা করতে পারেন না।

No comments

Powered by Blogger.