আরব মরু ঈগলের আমৃত্যু লড়াই by গোলাম সরোয়ার

তিনি ছিলেন লৌহমানব। তিনি ছিলেন আরব-আফ্রিকার আদিগন্ত মরুর দুরন্ত বেদুঈন বাদশা। বর্ণাঢ্য ছিল তার লাইফস্টাইল। আর সেজন্য দীর্ঘ চার দশক ধরেই ছিলেন দুনিয়াজুড়ে আলোচনায়।গতকাল ঘটেছে সেই মরুঈগলের অবসান। আরব বিশ্বের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি। টানা ৪২ বছর দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা ছিল তার মূল অনুপ্রেরণা। একাধারে তিনি ছিলেন বিলাসী ও একগুঁয়ে। তার নিরাপত্তায় সঙ্গে রাখতেন নারী দেহরক্ষী। রহস্যময় জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি।


কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা শাসক। সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। এজন্য পশ্চিমারাও তাকে বিশেষ সমীহ করে চলতেন। মাঝেমধ্যেই নানা রকম বক্তব্য দিয়ে পশ্চিমাদের হুমকি দিতেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একশ’ ভাগ দেশপ্রেমিক। আর তাই তো ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও অজ্ঞাত স্থান থেকে অডিও বার্তায় তার অনুগতদের হুকুম দিতেন, ‘পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও, ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না; জয় আমাদের নিশ্চিত। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই আরও জোরদার কর, আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে (লিবিয়া) রক্ষা কর।’
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ সত্ত্বেও তিনি জীবনের শেষ সময়ে লিবিয়ায় অবস্থান করে ন্যাটোবাহিনী ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। তার অনুগতদের উত্সাহিত করেছেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
১৯৪২ সালে লিবিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সির্তে এক যাযাবর গোত্রে জন্ম নেন গাদ্দাফি। বেনগাজি ইউনিভার্সিটিতে ভূগোল বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও মাঝপথে তা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন যুবক গাদ্দাফি। ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার তত্কালীন রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন গাদ্দাফি। ভিন্ন মতাবলম্বীদের কঠোরভাবে দমন করে খনিজ তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার দখল ধরে রাখেন তিনি।
১৯৭৭ সালে দেশের নাম বদলে গ্রেট সোশ্যালিস্ট পপুলার লিবিয়ান জামাহিরিয়াহ (জনতার রাষ্ট্র) রাখেন। এসময় দেশের সাধারণ মানুষদের পার্লামেন্টে তাদের মতামত জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
এ সময় তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্যান-আরব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এ সময় দেশের বৃহত্ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় রাখার অনুমতি দেন।
শেষ পর্যন্ত এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো তাকে, তার জন্মশহর সির্তে। যবনিকাপাত হলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক লড়াকু আরব সৈনিকের।
একজন সুবক্তা কর্নেল গাদ্দাফি : লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ছিলেন একজন সুবক্তা। তার বক্তব্যে লিবিয়া ও লিবিয়ার বাইরে অনেক লোক বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন। তিনি একটানা কয়েক ঘণ্টা বক্তৃতা দিতে পারতেন। রহস্যময় ও বিতর্কিত জীবনযাপনের মাধ্যমে চার দশকের বেশি সময় অতিক্রম করেছেন এই নেতা। তার এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে অভিহিত করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ‘দ্য গ্রিন বুক’ নামে বইয়ে তার রাজনৈতিক দর্শনের রূপরেখা প্রকাশ করেন। বইটির উপ-শিরোনাম ছিল গণতন্ত্রের সমস্যার সমাধান : সামাজিক ক্ষেত্রে তৃতীয় সর্বজনীন তত্ত্ব।
গাদ্দাফিকে ইতিহাস কীভাবে স্মরণ করেছে তাতে কিছু যায়-আসে না। তবে তিনি যে একজন সুবক্তা ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৪২ বছরের নেতৃত্বে দেশে ও বিদেশে অনেক বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছেন গাদ্দাফি। নিচে তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরা হলো :
‘আমি একজন বিশ্বনেতা, আরব শাসকদের প্রধান, আফ্রিকার রাজাদের রাজা এবং মুসলমানদের ঈমাম এবং আমার আন্তর্জাতিক মান-মর্যাদা এর নিচে হতে পারে না।’ ৩০ মার্চ ২০০৯ সৌদি বাদশা আবদুল্লাহকে কাপুরুষ অভিহিত করে এমন বক্তৃতাই দেন গাদ্দাফি। যদিও তার মাইক্রোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
‘লিবিয়া ছাড়া বিশ্বে আর কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নেই।’ ২০০৮ সালে ২৩ মার্চ নিউইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
‘আমি মনে করি, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করতে হলে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন নামে আলাদা দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রের নাম হবে ফিলিস্তিন আর ইসরাইলিদের রাষ্ট্রের নাম হবে ইসরাটিন অথবা তারা যা পছন্দ করে—এটাই মূল সমাধান। তা না হলে ভবিষ্যতে ইসরাইল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ ফিলিস্তিনিদের কৌশল অনেক গভীর।’ ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ আল-জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে এসব কথা বলেন গাদ্দাফি।
দি গ্রিন বুকের এক অংশে তিনি বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের লোক যদি তাদের শোকের অনুষ্ঠানে সাদা পোশাক পরে এবং অন্যরা কালো পোশাক পরে, সেক্ষেত্রে একটি সম্প্রদায় সাদা পোশাক পছন্দ করবে ও কালো পোশাক অপছন্দ করবে এবং অন্যরা কালো পোশাক পছন্দ করবে ও সাদা পোশাক অপছন্দ করবে। আর এর প্রভাব দেহের কোষ ও জিন পর্যন্ত পৌঁছবে।’
‘আব্রাহাম লিংকন এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি কারও সাহায্য ছাড়াই নিজেকে আবিষ্কার করেন। আমি তাকে অনুসরণ করি। আমি তার ও আমার মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পাই।’ ম্যারি কোলভিন ১৯৮৬ সালের ৩ আগস্ট দি পিটার্সবার্গ প্রেসের একটি প্রবন্ধে গাদ্দাফির এমন মন্তব্য উল্লেখ করেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘গাদ্দাফি, যাকে পৃথিবী ঘৃণা করতে ভালোবাসে’।
‘দ্বন্দ্ব্ব সত্ত্বেও মানবিক কারণেই আমেরিকার জনগণের প্রতি সহানুভূতি দেখানো উচিত এবং বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর মুহূর্তে তাদের পাশে থাকা উচিত। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমার ভাইকে এক ইসরাইলি সেনা গুলি করে হত্যা করে, তখন থেকেই আমি আরব দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করি এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও অব্যাহত রাখি।’ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিক্রিয়ায় গাদ্দাফি এমন মন্তব্য করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০১ সিবিএস নিউজ ডটকম তা প্রকাশ করে।
‘লিবিয়া আফ্রিকার একটি দেশ। আল্লাহ আরবদের সাহায্য করুক এবং তাদের আমাদের থেকে দূরে রাখুক। আমরা তাদের সঙ্গে কিছু করতে চাই না। তারা আমেরিকা ও ইতালির বিরুদ্ধে আমাদের হয়ে যুদ্ধ করেনি। তারা আমাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি এবং আমাদের মালামাল জব্দ করা বন্ধ করেনি। উল্টো তারা আমাদের টার্গেট করেছে এবং আমাদের দুঃসময়ের সুযোগ নিয়েছে।’ ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ আল-জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাত্কারে এসব অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন গাদ্দাফি।
সরকারবিরোধীরা আগস্টে যখন ত্রিপোলিতে হামলা করে তখন এক অডিও ভাষণে গাদ্দাফি বলেন, ‘লিবিয়া ও লিবিয়ার তেলসম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং লিবিয়ায় আবারও উপনিবেশ স্থাপনের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এটা কখনও সম্ভব নয়, এটা অসম্ভব। লিবিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম সীমান্ত রক্ষায় একজন নারী ও পুরুষও বেঁচে থাকা পর্যন্ত লড়াই করব।’ ২৫ আগস্ট ২০১১ সিরিয়াভিত্তিক আল-আরাবিয়া টেলিভিশনে তার এ ভাষণ প্রচার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.