যুক্তরাষ্ট্রই চেয়েছিল গাদ্দাফির পতন কিন্তু কেন? by সজীব সরকার
লিবিয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদের পাশাপাশি অনেক বিশ্লেষণ-মতামতও প্রচার ও প্রকাশ করা হয়েছে। এসব মন্তব্যে বলা হয়েছে, ইরাকসহ বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্র মিথ্যার বেসাতি করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। নিজের হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একের পর এক মিথ্যাচার করে যাচ্ছে দেশটি। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, উভয় পক্ষের বড় বড় সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রের এসব মিথ্যার লেজুড় ধরে। বিশেষ করে ইরাক আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ইতিহাসের অন্যতম বড় লজ্জাজনক অধ্যায়। পরে এসব মিথ্যাচার ধরাও পড়ে। কখনোই এসব মিথ্যাচারের পর্দা সরতে খুব বেশি দেরি হয়নি।
সারা পৃথিবীর মানুষ জেনেছে, কেন এ মিথ্যা আর কাদের মাধ্যমে এ মিথ্যা। তবে দুঃখের কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ভাগ্যের এ পরিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। আর গণমাধ্যমগুলোর বর্তমান ভূমিকা দেখে এটি ভাবতেই হচ্ছে, লিবিয়ার ক্ষেত্রে এসব মিথ্যাচারের পর্দা আদৌ উন্মোচিত হবে কি না! তবে গাদ্দাফির অবসান যে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল, সেটি তো এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এজন্য বিগত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যে কাজটি সবচেয়ে বেশি করেছে, তা হলো বিশ্বের কাছে গাদ্দাফিকে খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
তবে যুক্তরাষ্ট্র কেন এমনটি চেয়েছিল? লিবিয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দানা বাঁধতে শুরু করার সময় থেকে এখন পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরায় জানা গেছে, দেশটির সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সবদিক থেকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো লিবিয়ার নেতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো অবৈধভাবে জব্দ করেছে। এসব অ্যাকাউন্টে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূলত লিবিয়া রাষ্ট্র ও এর জাতীয় ব্যাংকের। এ ছাড়া কানাডার সংবাদমাধ্যমগুলো স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছে, লিবিয়াই ছিল আফ্রিকাকে শোষণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কমান্ড 'আফ্রিকম' ধ্বংসে গাদ্দাফির তৎপরতা ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক। পাশাপাশি তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢোকার দরজাও বন্ধ করেছিলেন গাদ্দাফি। কঠোর শর্তে অনুমতি থাকার পরও তেল কম্পানিগুলো লিবিয়ায় ঢোকার ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। আরো কারণ হলো, লিবিয়ার কাঁচা তেলের গুণগত মান অন্য অনেক অঞ্চলের তেলের চেয়ে বেশ ভালো। এ ছাড়া লিবিয়ার তেল ক্ষেত্রগুলো ইউরোপের তেল শোধনাগার কেন্দ্রগুলো থেকেও বেশ কাছে। কাজেই যেকোনো বিচারেই তেল কম্পানিগুলোর আগ্রহ ও উদ্বেগ নিশ্চিতভাবেই ছিল অনেক বেশি।
বলা হয়ে থাকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল কম্পানিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গাদ্দাফি যতটা বাস্তবতা ও দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ অন্যান্য বিষয়ে তা পারেননি। বিভিন্ন সময় তিনি তেল রপ্তানিতে কঠোর শর্ত এমনকি বিধিনিষেধও আরোপ করেছেন। এতে লিবিয়া লাভবানও হয়েছে। বিষয়টিকে উল্টো দিক থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়, এ ব্যাপারে কম্পানিগুলো খুশি ছিল না। এত দিনের অভিজ্ঞতায় ওই কম্পানিগুলো জেনে গেছে, কিভাবে ব্যবসা করতে হয় ও মুনাফার পরিমাণ বাড়ানো যায়। আর যেহেতু এসব কম্পানির একটি বড় সংখ্যাই যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর, তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশটির অবস্থা যত বেশি অস্থিতিশীল হবে, ততই এদের লাভ। আর এ বিষয়টি কম্পানিগুলো ভালোই বুঝে গিয়েছিল। তাই গাদ্দাফিকে সহ অথবা ছাড়া_যেকোনো মূল্যে তেল পাওয়া ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আর এসব কারণেই নব্য ঔপনিবেশিক কৌশলে পথের কাঁটা সরাতে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এমন অবস্থান। আর এতে কারণ, লাভ ও নিজের পক্ষে সাফাই হিসেবে ছিল আরো অনেক কিছুই।
যেমন_এরই মধ্যে প্রায় ১০ হাজার বিদেশি কর্মী লিবিয়া ছেড়েছেন। লিবিয়া ছাড়ার সময় তাঁরা অক্রান্তও হয়েছেন। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অনেক বিদেশিকে হত্যার অভিযোগও উঠেছে। সেই নিহতদের অনেকেই কালো, শিক্ষার্থী ও শ্রমিক। এখন তাঁদের বিকল্প হিসেবে কারা ভূমিকা পালন করবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এখন লিবিয়ার রাস্তায় রাস্তায় মানুষ উল্লাস করছে। দলে দলে আসা বিদ্রোহীদের স্বাগত জানাচ্ছে এই আশায় যে, তাদের অবস্থার বুঝি এবার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। আর বিদ্রোহীরা যদি তাদের সে আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে জনগণ হতাশ হবে। লিবিয়ার শিক্ষা ও জীবনমানের অন্যান্য দিক প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়ে অনেক ভালো এবং উন্নয়নমুখী ছিল। আর বিদ্রোহীরা এলে ঘটনাচক্রে যে নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে পরিণত হতে যাচ্ছে, তাদের হাত থেকে এমন লিবিয়াকে এখন কে রক্ষা করবে, এমন প্রশ্ন সবার মনেই জাগবে। সে ক্ষেত্রে একটি 'দক্ষ' ও 'শক্তিশালী' হস্তক্ষেপের হয়তো তারা বিরোধিতা করবে না। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে গোটা লিবিয়ার জনগণের।
একাধিক মাধ্যমে মতামত-বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও লিবিয়ার গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষগুলো এখন ওই সব বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে কী করবে? টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেখা গেছে, 'সফল বিদ্রোহীরা' অস্ত্র হাতে উল্লাস করছে। প্রত্যেকের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা বেশ আগ্রাসী। অনেকেই বয়সে বেশ তরুণ বা যুবক। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই হাতের রাইফেল উঁচিয়ে বিচ্ছিন্ন গুলিবর্ষণের মাধ্যমে উল্লাস করছে। দেখা যাচ্ছে, এ বিদ্রোহীরা একেবারেই এলোমেলো। তাদের মধ্যে নূ্যনতমও শৃঙ্খলা নেই। এদিকে ন্যাটোও ভালো করেই জানত, লিবিয়ার তথাকথিত বিদ্রোহীদের মধ্যে অনেকেরই আল-কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো ভাবতে শুরু করতে পারে, 'কালো বাজারে' তাদের মিথ্যা যেই ক্রয় করুক, তাদের পরিণতি আবারও সেই আল কায়েদা। সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও মানবাধিকারকর্মীদের বয়ান থেকে জানা গেছে, প্রতিটি শহরেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে লুটপাট। একেকটি শহর বিদ্রোহীদের দখলে এসেছে আর সেখানে সামরিক বাহিনীর অস্ত্রাগার লুট হয়েছে। কিছুদিন পরই হয়তো সেগুলো লিবিয়ার আকাশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টার গুলি করে মাটিতে নামানোর কাজে ব্যবহার হবে। তালেবানের হাতে এ পরিণতির কথা ন্যাটো অন্তত ভালোই জানে।
পশ্চিমা আগ্রাসনের পর ২০০১ সালে কাবুলে অথবা ২০০৩ সালে ইরাকে যে পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল, লিবিয়ার ক্ষেত্রেও শেষতক সেটিই হলো। সাধারণ মানুষ যখন থেকে বুঝতে পারে যে ক্ষমতাসীন শক্তির পতন অবশ্যম্ভাবী, তখন থেকেই তাদের সমর্থকরা উপায়ন্তর না দেখে আমজনতার কাতারে শামিল হয়ে যায়। গাদ্দাফির মৃত্যুতে আপাতদৃষ্টিতে বিদ্রোহী জনগণের জয়ের আড়ালে আসলে এ লড়াইয়ে জয়টা কার হয়েছে, তা ভেবে দেখার আছে। বেনগাজিতে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদকে (ট্রানজিশনাল ন্যাশনাল কাউন্সিল_টিএনসি) ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলের বহু দেশ লিবিয়ার বৈধ সরকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই পরিষদ সন্দেহের ঊধর্ে্ব উঠতে পারেনি। বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে তাদের ব্যাপারেও আপত্তি ছিল অনেক।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধের সমাপ্তি হলেও লিবিয়ায় নতুন যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে, তা হলো দেশটির নীতিনির্ধারণে পশ্চিমা শক্তির অবস্থান। গাদ্দাফি যুগের চূড়ান্ত অবসানের পর লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুই পক্ষের মধ্যেই একটি সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি ছিল। আর পশ্চিমাদের ভূমিকা দুই পক্ষের কাছে সহজ সমাধান এনে দিতে পারবে না_সম্প্রতিক ইতিহাস তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। গাদ্দাফিকে হটাতে ন্যাটোর বিমান হামলার ভূমিকাকে প্রাধান্য দিতেই হচ্ছে। বিদ্রোহীরাও কিছুদিন আগে স্বীকার করেছিল, বিমান হামলার মাধ্যমে ন্যাটো তাদের সহায়তা না দিলে হয়তো এত দিনে তারা মারা পড়ত অথবা যুদ্ধ আরো প্রলম্বিত হতো। গতকালের হামলা ছাড়াও গাদ্দাফি সমর্থকদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে ন্যাটো প্রায় আট হাজার বিমান হামলা চালিয়ে তাদের শক্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, যখন সব দলমতের লোকজনকে নিয়ে দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হবে, তখন বিদেশিদের সহায়তায় অর্জিত এই সাফল্যকে বিদ্রোহীরা কিভাবে অন্য দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে? আফগানিস্তান ও ইরাকে বিদেশি আগ্রাসনের যে নজির লিবিয়ার জনগণের চোখের সামনে ভাসছে, তা তো মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়, বরং শঙ্কার।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী পশ্চিমা সেনা অভিযানে সাফল্য পাওয়া গেছে। লিবিয়ায়ও পশ্চিমাদেরই সাহায্য নিতে হয়েছে। ন্যাটো বাহিনী তাদের এই প্রাধান্যকে উদ্ধতভাবে ও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাপিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানে এমন এক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, যাকে পশতুন সম্প্রদায়ের লোকজন মেনে নিতে পারেনি। ফলে আজো সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। এখনো প্রতি সপ্তাহেই বোমা বা গুলির আঘাতে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। আর ইরাকে অতিআত্মবিশ্বাসী মার্কিন বাহিনী সাদ্দামকে উৎখাতের পর ইরাকের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে এবং সাদ্দামের বাথ পার্টির নেতাদের সরকারের বিভিন্ন শীর্ষপদ থেকে অপসারণ করে। ফলে ওই ব্যক্তিরা আবারো সংগঠিত হয়ে সেখানকার 'পুতুল সরকারের' বিরুদ্ধে নানা বিদ্রোহ অব্যাহত রাখতে শুরু করে। সাদ্দাম উৎখাতে বেশির ভাগ ইরাকি খুশি হলেও এর বিনিময়ে তাদের দেখতে হয়েছে পুরো দেশটির ধ্বংস।
এ অবস্থায় গতকালের ঘটনার পর বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, লিবিয়ায়ও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়ার সরকার নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাটি অন্তত ভালোই করেছিল। লিবিয়ার মানুষ পুরনো সরকারের আমলে খেয়ে-দেয়ে ভালোই ছিল। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। টিএনসি বিদ্রোহীদের প্রতি একটি আহ্বানই জানিয়ে আসছিল বারবার, প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া চলবে না। কিন্তু কতটা কার্যকর হয়েছে তা তো দেখাই গেল! পাশাপাশি ৪২ বছরের সেকুলার সংস্কৃতি উল্টে দিয়ে এখন দেশটিতে শরিয়হ্ভিত্তিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে লিবিয়ায় এখন যে জরাজীর্ণ দশা, তাতে যে উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, সে উদ্যোগের কার্যকারিতার বিষয়ে সুনিশ্চিত ফল শিগগিরই পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সূত্র : কাউন্টারপাঞ্চ ডট অর্গ, বিবিসিনিউজ, সিএনএন, আলজাজিরা, টেলিগ্রাফ অনলাইন।
তবে যুক্তরাষ্ট্র কেন এমনটি চেয়েছিল? লিবিয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দানা বাঁধতে শুরু করার সময় থেকে এখন পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরায় জানা গেছে, দেশটির সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সবদিক থেকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো লিবিয়ার নেতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো অবৈধভাবে জব্দ করেছে। এসব অ্যাকাউন্টে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূলত লিবিয়া রাষ্ট্র ও এর জাতীয় ব্যাংকের। এ ছাড়া কানাডার সংবাদমাধ্যমগুলো স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছে, লিবিয়াই ছিল আফ্রিকাকে শোষণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক কমান্ড 'আফ্রিকম' ধ্বংসে গাদ্দাফির তৎপরতা ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক। পাশাপাশি তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢোকার দরজাও বন্ধ করেছিলেন গাদ্দাফি। কঠোর শর্তে অনুমতি থাকার পরও তেল কম্পানিগুলো লিবিয়ায় ঢোকার ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। আরো কারণ হলো, লিবিয়ার কাঁচা তেলের গুণগত মান অন্য অনেক অঞ্চলের তেলের চেয়ে বেশ ভালো। এ ছাড়া লিবিয়ার তেল ক্ষেত্রগুলো ইউরোপের তেল শোধনাগার কেন্দ্রগুলো থেকেও বেশ কাছে। কাজেই যেকোনো বিচারেই তেল কম্পানিগুলোর আগ্রহ ও উদ্বেগ নিশ্চিতভাবেই ছিল অনেক বেশি।
বলা হয়ে থাকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল কম্পানিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গাদ্দাফি যতটা বাস্তবতা ও দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ অন্যান্য বিষয়ে তা পারেননি। বিভিন্ন সময় তিনি তেল রপ্তানিতে কঠোর শর্ত এমনকি বিধিনিষেধও আরোপ করেছেন। এতে লিবিয়া লাভবানও হয়েছে। বিষয়টিকে উল্টো দিক থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়, এ ব্যাপারে কম্পানিগুলো খুশি ছিল না। এত দিনের অভিজ্ঞতায় ওই কম্পানিগুলো জেনে গেছে, কিভাবে ব্যবসা করতে হয় ও মুনাফার পরিমাণ বাড়ানো যায়। আর যেহেতু এসব কম্পানির একটি বড় সংখ্যাই যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর, তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশটির অবস্থা যত বেশি অস্থিতিশীল হবে, ততই এদের লাভ। আর এ বিষয়টি কম্পানিগুলো ভালোই বুঝে গিয়েছিল। তাই গাদ্দাফিকে সহ অথবা ছাড়া_যেকোনো মূল্যে তেল পাওয়া ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আর এসব কারণেই নব্য ঔপনিবেশিক কৌশলে পথের কাঁটা সরাতে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এমন অবস্থান। আর এতে কারণ, লাভ ও নিজের পক্ষে সাফাই হিসেবে ছিল আরো অনেক কিছুই।
যেমন_এরই মধ্যে প্রায় ১০ হাজার বিদেশি কর্মী লিবিয়া ছেড়েছেন। লিবিয়া ছাড়ার সময় তাঁরা অক্রান্তও হয়েছেন। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অনেক বিদেশিকে হত্যার অভিযোগও উঠেছে। সেই নিহতদের অনেকেই কালো, শিক্ষার্থী ও শ্রমিক। এখন তাঁদের বিকল্প হিসেবে কারা ভূমিকা পালন করবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এখন লিবিয়ার রাস্তায় রাস্তায় মানুষ উল্লাস করছে। দলে দলে আসা বিদ্রোহীদের স্বাগত জানাচ্ছে এই আশায় যে, তাদের অবস্থার বুঝি এবার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। আর বিদ্রোহীরা যদি তাদের সে আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে জনগণ হতাশ হবে। লিবিয়ার শিক্ষা ও জীবনমানের অন্যান্য দিক প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়ে অনেক ভালো এবং উন্নয়নমুখী ছিল। আর বিদ্রোহীরা এলে ঘটনাচক্রে যে নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে পরিণত হতে যাচ্ছে, তাদের হাত থেকে এমন লিবিয়াকে এখন কে রক্ষা করবে, এমন প্রশ্ন সবার মনেই জাগবে। সে ক্ষেত্রে একটি 'দক্ষ' ও 'শক্তিশালী' হস্তক্ষেপের হয়তো তারা বিরোধিতা করবে না। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে গোটা লিবিয়ার জনগণের।
একাধিক মাধ্যমে মতামত-বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও লিবিয়ার গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষগুলো এখন ওই সব বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে কী করবে? টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেখা গেছে, 'সফল বিদ্রোহীরা' অস্ত্র হাতে উল্লাস করছে। প্রত্যেকের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা বেশ আগ্রাসী। অনেকেই বয়সে বেশ তরুণ বা যুবক। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই হাতের রাইফেল উঁচিয়ে বিচ্ছিন্ন গুলিবর্ষণের মাধ্যমে উল্লাস করছে। দেখা যাচ্ছে, এ বিদ্রোহীরা একেবারেই এলোমেলো। তাদের মধ্যে নূ্যনতমও শৃঙ্খলা নেই। এদিকে ন্যাটোও ভালো করেই জানত, লিবিয়ার তথাকথিত বিদ্রোহীদের মধ্যে অনেকেরই আল-কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো ভাবতে শুরু করতে পারে, 'কালো বাজারে' তাদের মিথ্যা যেই ক্রয় করুক, তাদের পরিণতি আবারও সেই আল কায়েদা। সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও মানবাধিকারকর্মীদের বয়ান থেকে জানা গেছে, প্রতিটি শহরেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে লুটপাট। একেকটি শহর বিদ্রোহীদের দখলে এসেছে আর সেখানে সামরিক বাহিনীর অস্ত্রাগার লুট হয়েছে। কিছুদিন পরই হয়তো সেগুলো লিবিয়ার আকাশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টার গুলি করে মাটিতে নামানোর কাজে ব্যবহার হবে। তালেবানের হাতে এ পরিণতির কথা ন্যাটো অন্তত ভালোই জানে।
পশ্চিমা আগ্রাসনের পর ২০০১ সালে কাবুলে অথবা ২০০৩ সালে ইরাকে যে পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল, লিবিয়ার ক্ষেত্রেও শেষতক সেটিই হলো। সাধারণ মানুষ যখন থেকে বুঝতে পারে যে ক্ষমতাসীন শক্তির পতন অবশ্যম্ভাবী, তখন থেকেই তাদের সমর্থকরা উপায়ন্তর না দেখে আমজনতার কাতারে শামিল হয়ে যায়। গাদ্দাফির মৃত্যুতে আপাতদৃষ্টিতে বিদ্রোহী জনগণের জয়ের আড়ালে আসলে এ লড়াইয়ে জয়টা কার হয়েছে, তা ভেবে দেখার আছে। বেনগাজিতে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদকে (ট্রানজিশনাল ন্যাশনাল কাউন্সিল_টিএনসি) ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলের বহু দেশ লিবিয়ার বৈধ সরকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই পরিষদ সন্দেহের ঊধর্ে্ব উঠতে পারেনি। বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে তাদের ব্যাপারেও আপত্তি ছিল অনেক।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধের সমাপ্তি হলেও লিবিয়ায় নতুন যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে, তা হলো দেশটির নীতিনির্ধারণে পশ্চিমা শক্তির অবস্থান। গাদ্দাফি যুগের চূড়ান্ত অবসানের পর লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুই পক্ষের মধ্যেই একটি সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি ছিল। আর পশ্চিমাদের ভূমিকা দুই পক্ষের কাছে সহজ সমাধান এনে দিতে পারবে না_সম্প্রতিক ইতিহাস তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। গাদ্দাফিকে হটাতে ন্যাটোর বিমান হামলার ভূমিকাকে প্রাধান্য দিতেই হচ্ছে। বিদ্রোহীরাও কিছুদিন আগে স্বীকার করেছিল, বিমান হামলার মাধ্যমে ন্যাটো তাদের সহায়তা না দিলে হয়তো এত দিনে তারা মারা পড়ত অথবা যুদ্ধ আরো প্রলম্বিত হতো। গতকালের হামলা ছাড়াও গাদ্দাফি সমর্থকদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে ন্যাটো প্রায় আট হাজার বিমান হামলা চালিয়ে তাদের শক্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, যখন সব দলমতের লোকজনকে নিয়ে দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হবে, তখন বিদেশিদের সহায়তায় অর্জিত এই সাফল্যকে বিদ্রোহীরা কিভাবে অন্য দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে? আফগানিস্তান ও ইরাকে বিদেশি আগ্রাসনের যে নজির লিবিয়ার জনগণের চোখের সামনে ভাসছে, তা তো মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়, বরং শঙ্কার।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী পশ্চিমা সেনা অভিযানে সাফল্য পাওয়া গেছে। লিবিয়ায়ও পশ্চিমাদেরই সাহায্য নিতে হয়েছে। ন্যাটো বাহিনী তাদের এই প্রাধান্যকে উদ্ধতভাবে ও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাপিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানে এমন এক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, যাকে পশতুন সম্প্রদায়ের লোকজন মেনে নিতে পারেনি। ফলে আজো সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। এখনো প্রতি সপ্তাহেই বোমা বা গুলির আঘাতে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। আর ইরাকে অতিআত্মবিশ্বাসী মার্কিন বাহিনী সাদ্দামকে উৎখাতের পর ইরাকের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে এবং সাদ্দামের বাথ পার্টির নেতাদের সরকারের বিভিন্ন শীর্ষপদ থেকে অপসারণ করে। ফলে ওই ব্যক্তিরা আবারো সংগঠিত হয়ে সেখানকার 'পুতুল সরকারের' বিরুদ্ধে নানা বিদ্রোহ অব্যাহত রাখতে শুরু করে। সাদ্দাম উৎখাতে বেশির ভাগ ইরাকি খুশি হলেও এর বিনিময়ে তাদের দেখতে হয়েছে পুরো দেশটির ধ্বংস।
এ অবস্থায় গতকালের ঘটনার পর বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, লিবিয়ায়ও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়ার সরকার নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাটি অন্তত ভালোই করেছিল। লিবিয়ার মানুষ পুরনো সরকারের আমলে খেয়ে-দেয়ে ভালোই ছিল। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। টিএনসি বিদ্রোহীদের প্রতি একটি আহ্বানই জানিয়ে আসছিল বারবার, প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া চলবে না। কিন্তু কতটা কার্যকর হয়েছে তা তো দেখাই গেল! পাশাপাশি ৪২ বছরের সেকুলার সংস্কৃতি উল্টে দিয়ে এখন দেশটিতে শরিয়হ্ভিত্তিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে লিবিয়ায় এখন যে জরাজীর্ণ দশা, তাতে যে উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, সে উদ্যোগের কার্যকারিতার বিষয়ে সুনিশ্চিত ফল শিগগিরই পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সূত্র : কাউন্টারপাঞ্চ ডট অর্গ, বিবিসিনিউজ, সিএনএন, আলজাজিরা, টেলিগ্রাফ অনলাইন।
No comments