রনির কথাবার্তায় চরম অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য ও পাভেল হায়দার চৌধুরী
সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে_বিরোধী দল বিএনপির এমন বক্তব্যের পরদিন এই অর্থায়ন স্থগিত করার পেছনে একজন নোবেল বিজয়ীকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি ওই নোবেল বিজয়ীর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশ আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের মেয়াদেই হবে বলে দলীয় সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করেছেন শেখ হাসিনা।এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কঠোর সমালোচনা করে আলোচিত ও বিতর্কিত সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনিকে 'মীরজাফর' বলে আখ্যায়িত করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
টক শোতে তাঁর সাম্প্রতিক কথাবার্তায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব অভিযোগের পাশাপাশি অনেক বিষয়ে তাঁর ক্ষোভ ও বক্তব্য তুলে ধরেন বলে বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে দল ও সরকারের সমালোচনাকারী নেতা ও সংসদ সদস্যদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। দলের চেইন অব কমান্ড ভাঙলে শাস্তির কথাও স্মরণ করিয়ে দেন দলীয় সভাপতি। তিনি গোলাম মাওলা রনিকে ভবিষ্যতে কথাবার্তা বলায় সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন।
বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও তাঁকে নিয়ে রনির একটি মন্তব্য উল্লেখ করে তাঁকে 'স্টুপিড' বলে আখ্যায়িত করেন।
উল্লেখ্য, বেসরকারি টেলিভিশন 'চ্যানেল আই'য়ে গত সোমবার রাতে প্রচারিত টক শো 'তৃতীয় মাত্রা'য় পটুয়াখালীর সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি দাবি করেন, একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে রনির এ বিতর্কিত বক্তব্য ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। এ বক্তব্য নিয়ে ফেসবুক ও ব্লগে আলোচনার ঝড় ওঠে। ফেসবুকে অনুষ্ঠানের ভিডিওটি বহুসংখ্যক 'শেয়ার' হয়েছে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রনির কাছে জানতে চান, তিনি এ কথা কার কাছ থেকে জেনেছেন। তখন রনি বলেন, একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো পার্কে কোনো দৌড়ের ঘটনা ঘটেনি। এক 'স্পোর্টস স্কুলে' একটি দৌড়ের ঘটনা ঘটেছিল। আর কোনো বাঁশি বাজানোর ঘটনাও ঘটেনি। শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে আবুল হোসেন ও সাবের হোসেন চৌধুরী স্কুলটির ছাত্রদের সঙ্গে দৌড় দিয়েছিলেন। কিন্তু সাবের হোসেনকে তো মন্ত্রী করা হয়নি!
তবে রনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এসব বক্তব্য অস্বীকার করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ রকম কিছু বলেননি। শি ওয়াজ স্মাইলিং অ্যান্ড জোকিং।'
রনি আরো বলেন, 'তোফায়েল আহমদ সাহেব টক শোর বিষয়টি বৈঠকে উত্থাপন করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী আমার কাছে জানতে চান_আমি এ রকম কথা বলেছি কি না। আমি বলি, জি, আমি বলেছি।'
সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমদ টক শোতে আওয়ামী লীগের নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি রনির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, অনেক জুনিয়র এমপি দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনে টক শোতে অংশ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, যা দলের জন্য ক্ষতিকর। তাঁদের বক্তব্যে দলের চেইন অব কমান্ড থাকে না। আরো কয়েকজন সংসদ সদস্যও রনির সমালোচনা করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী রনিকে 'মীরজাফর' বলে মন্তব্য করেন। অর্থমন্ত্রী আবদুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ওটা (রনি) একটা স্টুপিড।
সূত্র জানায়, বৈঠকে রনি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'রনির শ্বশুরগুষ্টি বিএনপি করে। ও চিন্তা করছে, ও পরে বিএনপিতে যোগ দেবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে শ্বশুররা ওকে শেল্টার দেবে।'
'এরা তো মীরজাফর'_মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এদের বিচার হবে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, 'ওকে রাস্তা থেকে ধরে এমপি বানিয়েছি। ওর মনে রাখা উচিত, ওকে একটি দলের নমিনেশন পেয়ে এমপি হয়েছে। দলের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় চিন্তাভাবনা করা উচিত। অবশ্য ওর কী যায়-আসে। ও ব্যবসা করে পার্থর (বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ) সঙ্গে।'
নিজের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, পার্থর খালা প্রধানমন্ত্রী। এই কথাগুলো বলে বৈঠকে উপস্থিত শেখ হেলাল উদ্দিনের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, পার্থর শ্বশুর বড় নেতা।
বৈঠকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দলীয় লোক নিয়োগ না দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের এবং নেতা-কর্মীদের সময় না দেওয়া ও মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলে দলীয় সংসদ সদস্যরা কঠোর সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের।
সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কঠোর সমালোচনা করেন। সকাল-বিকেল-রাত কোনো সময়ই ফোন দিলে সাধারণ সম্পাদককে পাওয়া যায় না_মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্থানীয় নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় এসে না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে যান। এভাবে দল চলতে পারে না। মন্ত্রীরাও জেলা পর্যায়ে সফরে যান না বলেও অভিযোগ করেন ইসরাফিল আলম।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের নিয়োগে দলীয় নেতা-কর্মীদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে না_এ অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ব্যাপারে বিষোদ্গার করেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ইসরাফিল আলম তাঁর বক্তব্যে অবৈধ ভিওআইপি নিয়েও কথা বলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিটিআরসির চেয়ারম্যান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে বসে অবৈধ ভিওআইপি কেন হচ্ছে তা চিহ্নিত করার আহ্বান জানান।
সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক বলেন, সারের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের প্রান্তিক কৃষকরা বেকায়দায় পড়েছেন। এ মুহূর্তে সারের দাম বাড়ানো উচিত হয়নি। জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, সব সারের দাম বাড়ানো হয়নি। শুধু ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেটাও সহনীয় পর্যায়ে।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগমন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির বিষয়ে যে দুটি ডকুমেন্ট দিয়েছে তা বিএনপি আমলের। বিএনপির যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির ডকুমেন্ট তারা দিয়েছে। আমাদের কোনো মন্ত্রীর নামে বিশ্বব্যাংকে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। যেখানে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের জন্য কোনো তহবিলই হয়নি, সেখানে দুর্নীতি হয় কী করে!' তিনি বলেন, 'ধারণার ওপর কথা বললে তো হবে না। আমি বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিয়েছি, কোথায় কী দুর্নীতি হয়েছে তার তথ্য-প্রমাণ চেয়েছি। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেলে আমি বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও দাতাগোষ্ঠীকে আহ্বান জানাব সেতুতে অর্থায়ন করতে।' মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে কথা চলছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান। বর্তমান সরকারের সময়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তা প্রকাশ করে বলেন, 'এটা আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা। এ ওয়াদা পূরণ করতেই হবে। প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু আমরা নির্মাণ করব।'
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত হওয়ার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, 'একজন নোবেল বিজয়ী এর (পদ্মা সেতুর) বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান।'
বৈঠকে রোডমার্চে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। নিজামী, সাঈদী ও মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধী নন বলে বিরোধীদলীয় নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বক্তব্যে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে_যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও অস্ত্র পাচার মামলার আসামিদের রক্ষা করা। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি_খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যেরও সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আওয়ামী লীগ যদি মুক্তিযুদ্ধ না করে থাকে, তাহলে যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল তাতে কারা ছিল? প্রবাসী সরকার কি জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল?'
সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সংসদ সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ থেকে বিরোধী দলের অপরাজনীতির জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে জনমত গঠনের নির্দেশ দেন।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্থপতি লুই আই কানের চিত্রিত সংসদ ভবনের মূল নকশা তুলে ধরেন। পরিবেশবাদীদের সমালোচনা করে বলেন, 'সংসদ ভবনের ভেতরে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও দুই হুইপের জন্য চারটি ভবন নির্মাণের বিষয়টি মূল নকশায় থাকা সত্ত্বেও এটা নিয়ে পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। অথচ সংসদ ভবনের পাশে শাহ আজিজ ও খান এ সবুরের কবর, জিয়ার মাজার এবং মাজারে যাতায়াতের জন্য স্টিলের ব্রিজ যে নকশা বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে তা নিয়ে পরিবেশবাদীরা নিশ্চুপ রয়েছেন।'
বৈঠক শেষে চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ সাংবাদিকদের জানান, রেওয়াজ অনুযায়ী আজ (বৃহস্পতিবার) সংসদীয় দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বৈঠকে সমসাময়িক রাজনীতি, বিরোধী দলের ভূমিকা, সরকারের উন্নয়ন, নির্বাচনী ইশতেহারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, আ ফ ম রুহুল হক, ইসরাফিল আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আতিউর রহমান আতিক, আবদুল মান্নান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে দল ও সরকারের সমালোচনাকারী নেতা ও সংসদ সদস্যদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। দলের চেইন অব কমান্ড ভাঙলে শাস্তির কথাও স্মরণ করিয়ে দেন দলীয় সভাপতি। তিনি গোলাম মাওলা রনিকে ভবিষ্যতে কথাবার্তা বলায় সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন।
বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও তাঁকে নিয়ে রনির একটি মন্তব্য উল্লেখ করে তাঁকে 'স্টুপিড' বলে আখ্যায়িত করেন।
উল্লেখ্য, বেসরকারি টেলিভিশন 'চ্যানেল আই'য়ে গত সোমবার রাতে প্রচারিত টক শো 'তৃতীয় মাত্রা'য় পটুয়াখালীর সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি দাবি করেন, একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে রনির এ বিতর্কিত বক্তব্য ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। এ বক্তব্য নিয়ে ফেসবুক ও ব্লগে আলোচনার ঝড় ওঠে। ফেসবুকে অনুষ্ঠানের ভিডিওটি বহুসংখ্যক 'শেয়ার' হয়েছে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রনির কাছে জানতে চান, তিনি এ কথা কার কাছ থেকে জেনেছেন। তখন রনি বলেন, একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো পার্কে কোনো দৌড়ের ঘটনা ঘটেনি। এক 'স্পোর্টস স্কুলে' একটি দৌড়ের ঘটনা ঘটেছিল। আর কোনো বাঁশি বাজানোর ঘটনাও ঘটেনি। শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে আবুল হোসেন ও সাবের হোসেন চৌধুরী স্কুলটির ছাত্রদের সঙ্গে দৌড় দিয়েছিলেন। কিন্তু সাবের হোসেনকে তো মন্ত্রী করা হয়নি!
তবে রনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এসব বক্তব্য অস্বীকার করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ রকম কিছু বলেননি। শি ওয়াজ স্মাইলিং অ্যান্ড জোকিং।'
রনি আরো বলেন, 'তোফায়েল আহমদ সাহেব টক শোর বিষয়টি বৈঠকে উত্থাপন করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী আমার কাছে জানতে চান_আমি এ রকম কথা বলেছি কি না। আমি বলি, জি, আমি বলেছি।'
সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমদ টক শোতে আওয়ামী লীগের নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি রনির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, অনেক জুনিয়র এমপি দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনে টক শোতে অংশ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, যা দলের জন্য ক্ষতিকর। তাঁদের বক্তব্যে দলের চেইন অব কমান্ড থাকে না। আরো কয়েকজন সংসদ সদস্যও রনির সমালোচনা করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী রনিকে 'মীরজাফর' বলে মন্তব্য করেন। অর্থমন্ত্রী আবদুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ওটা (রনি) একটা স্টুপিড।
সূত্র জানায়, বৈঠকে রনি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'রনির শ্বশুরগুষ্টি বিএনপি করে। ও চিন্তা করছে, ও পরে বিএনপিতে যোগ দেবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে শ্বশুররা ওকে শেল্টার দেবে।'
'এরা তো মীরজাফর'_মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এদের বিচার হবে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, 'ওকে রাস্তা থেকে ধরে এমপি বানিয়েছি। ওর মনে রাখা উচিত, ওকে একটি দলের নমিনেশন পেয়ে এমপি হয়েছে। দলের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় চিন্তাভাবনা করা উচিত। অবশ্য ওর কী যায়-আসে। ও ব্যবসা করে পার্থর (বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ) সঙ্গে।'
নিজের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, পার্থর খালা প্রধানমন্ত্রী। এই কথাগুলো বলে বৈঠকে উপস্থিত শেখ হেলাল উদ্দিনের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, পার্থর শ্বশুর বড় নেতা।
বৈঠকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দলীয় লোক নিয়োগ না দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের এবং নেতা-কর্মীদের সময় না দেওয়া ও মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলে দলীয় সংসদ সদস্যরা কঠোর সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের।
সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কঠোর সমালোচনা করেন। সকাল-বিকেল-রাত কোনো সময়ই ফোন দিলে সাধারণ সম্পাদককে পাওয়া যায় না_মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্থানীয় নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় এসে না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে যান। এভাবে দল চলতে পারে না। মন্ত্রীরাও জেলা পর্যায়ে সফরে যান না বলেও অভিযোগ করেন ইসরাফিল আলম।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের নিয়োগে দলীয় নেতা-কর্মীদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে না_এ অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ব্যাপারে বিষোদ্গার করেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ইসরাফিল আলম তাঁর বক্তব্যে অবৈধ ভিওআইপি নিয়েও কথা বলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিটিআরসির চেয়ারম্যান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে বসে অবৈধ ভিওআইপি কেন হচ্ছে তা চিহ্নিত করার আহ্বান জানান।
সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক বলেন, সারের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের প্রান্তিক কৃষকরা বেকায়দায় পড়েছেন। এ মুহূর্তে সারের দাম বাড়ানো উচিত হয়নি। জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, সব সারের দাম বাড়ানো হয়নি। শুধু ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেটাও সহনীয় পর্যায়ে।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগমন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির বিষয়ে যে দুটি ডকুমেন্ট দিয়েছে তা বিএনপি আমলের। বিএনপির যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির ডকুমেন্ট তারা দিয়েছে। আমাদের কোনো মন্ত্রীর নামে বিশ্বব্যাংকে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। যেখানে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের জন্য কোনো তহবিলই হয়নি, সেখানে দুর্নীতি হয় কী করে!' তিনি বলেন, 'ধারণার ওপর কথা বললে তো হবে না। আমি বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিয়েছি, কোথায় কী দুর্নীতি হয়েছে তার তথ্য-প্রমাণ চেয়েছি। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেলে আমি বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও দাতাগোষ্ঠীকে আহ্বান জানাব সেতুতে অর্থায়ন করতে।' মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে কথা চলছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান। বর্তমান সরকারের সময়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তা প্রকাশ করে বলেন, 'এটা আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা। এ ওয়াদা পূরণ করতেই হবে। প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু আমরা নির্মাণ করব।'
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত হওয়ার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, 'একজন নোবেল বিজয়ী এর (পদ্মা সেতুর) বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান।'
বৈঠকে রোডমার্চে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। নিজামী, সাঈদী ও মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধী নন বলে বিরোধীদলীয় নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বক্তব্যে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে_যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও অস্ত্র পাচার মামলার আসামিদের রক্ষা করা। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি_খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যেরও সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আওয়ামী লীগ যদি মুক্তিযুদ্ধ না করে থাকে, তাহলে যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল তাতে কারা ছিল? প্রবাসী সরকার কি জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল?'
সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সংসদ সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ থেকে বিরোধী দলের অপরাজনীতির জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে জনমত গঠনের নির্দেশ দেন।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্থপতি লুই আই কানের চিত্রিত সংসদ ভবনের মূল নকশা তুলে ধরেন। পরিবেশবাদীদের সমালোচনা করে বলেন, 'সংসদ ভবনের ভেতরে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও দুই হুইপের জন্য চারটি ভবন নির্মাণের বিষয়টি মূল নকশায় থাকা সত্ত্বেও এটা নিয়ে পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। অথচ সংসদ ভবনের পাশে শাহ আজিজ ও খান এ সবুরের কবর, জিয়ার মাজার এবং মাজারে যাতায়াতের জন্য স্টিলের ব্রিজ যে নকশা বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে তা নিয়ে পরিবেশবাদীরা নিশ্চুপ রয়েছেন।'
বৈঠক শেষে চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ সাংবাদিকদের জানান, রেওয়াজ অনুযায়ী আজ (বৃহস্পতিবার) সংসদীয় দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বৈঠকে সমসাময়িক রাজনীতি, বিরোধী দলের ভূমিকা, সরকারের উন্নয়ন, নির্বাচনী ইশতেহারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, আ ফ ম রুহুল হক, ইসরাফিল আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আতিউর রহমান আতিক, আবদুল মান্নান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
No comments