শামীমের নেতা, আইভীর জনতা by শরিফুল হাসান ও আসিফ হোসেন

শামীম ওসমানের সমর্থনে গতকাল ঢাকা থেকে তিন নেতা এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। তাঁরা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং বলেন, শামীম ওসমানকে ভোট না দিলে নারায়ণগঞ্জবাসী ভুল করবে। অপর মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী নির্বাচনী প্রচারণার পঞ্চম দিনেও সারা দিন ব্যস্ত ছিলেন জনসংযোগে। তিনি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে দোয়া চান। বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ তাঁর সঙ্গে আছে। এই জনগণকে নিয়েই তিনি সামনে এগোতে চান।

এদিকে শামীম ওসমানের সমর্থনে ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের তিন নেতার নারায়ণগঞ্জে আসা নিয়ে শহরে নানা রকম আলোচনা চলে। অনেকে বলেন, শামীমের পক্ষে নেতা, আইভীর পক্ষে জনতা।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘এটি সত্য, আমরা বেশির ভাগ নেতা-কর্মী নানা কারণেই শামীম ওসমানের সঙ্গে আছি। ঢাকার বেশির ভাগ নেতাও শামীম ওসমানের সমর্থনে আছেন। কিন্তু আমাদের ভয় হলো, আইভীর পক্ষে আছে জনতা। আর জনতার কাছেই হয়তো নেতাদের হারতে হতে পারে। তবে আমরা আশাবাদী।’
আ.লীগের তিন নেতা নারায়ণগঞ্জে: শামীম ওসমান গতকাল দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জে প্রচারণা চালান। তবে জনসংযোগের চেয়েও গতকাল তিনি বেশি ব্যস্ত ছিলেন ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের আসা নিয়ে। দিনভর শোনা যাচ্ছিল, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আসছেন শামীম ওসমানকে সমর্থন জানাতে। দিন পেরিয়ে গেলেও তাঁদের দেখা যায়নি।
সন্ধ্যায় সেলিনা হায়াত আইভী যখন ভোটারদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত, তখন শামীম ওসমান শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অফিসে তাঁর অনুগতদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁরা শহরে আসেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রাত আটটায় মতবিনিময় সভা শেষ হয়।
ঢাকা থেকে গতকাল শামীম ওসমানের সমর্থনে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও আবু সায়িদ আল মাহমুদ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ আবদুল্লাহ আল কায়সার। এই নেতারা শামীম ওসমানের পক্ষে ভোট চান ও বলেন, শামীম ওসমানকে ভোট না দিলে নারায়ণগঞ্জবাসী ভুল করবে। তারা অভিযোগ করেন, একটি মহল শামীম ওসমান সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তবে এই তিন নেতার নারায়ণগঞ্জ সফর শামীম ওসমানের প্রতি দলের আনুষ্ঠানিক সমর্থন নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। গতকাল রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দল থেকে কাউকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি তাঁদের ব্যক্তিগত সফর।
মতবিনিময় সভায় শামীম ওসমান বলেন, ‘আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিপক্ষে লড়ি।’ তিনি বলেন, ‘১৫ বছর আগের শামীম ওসমান আর আজকের শামীম ওসমান এক না।’ তিনি এ সময় প্রথম আলোর সমালোচনা করেন। বলেন, প্রথম আলো মানুষকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।
প্রতীক ঘিরে উৎসব: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের মধ্যে গতকাল প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে জিয়া হলের সামনে সৃষ্টি হয় উৎসবের আমেজ। সকাল থেকেই প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা ভিড় জমান জিয়া হলে। কোন প্রার্থী কী প্রতীক পাচ্ছেন, তা জানতে বিপুলসংখ্যক লোক জড়ো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দিনই ব্যস্ত ছিল ভিড় সামলাতে।
আইভীর প্রতীক দোয়াত-কলম: গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের চাষাঢ়ার জিয়া হল মিলনায়তনে নির্বাচনী প্রতীক আনতে যান সেলিনা হায়াত আইভী। ফেরেন পছন্দের প্রতীক দোয়াত-কলম নিয়ে। প্রতীক হাতে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পারে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে গণসংযোগ করেন তিনি।
প্রতীক নিতে এসে সেলিনা হায়াত আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দোয়াত-কলম পেয়ে আমি খুশি। এটা শিক্ষার প্রতীক।্রনারায়ণগঞ্জবাসী আমার সঙ্গে আছে। নতুন হলেও ইভিএম ব্যবহারে আমার আপত্তি নেই। কারণ, আমাদের প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’ আইভী নির্বাচনে ভোট কারচুপির আশঙ্কা করে বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সেনা মোতায়েন প্রয়োজন। কারণ, অতীতে অনেক নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখলসহ অনেক ঘটনা ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের তিন নেতার শামীম ওসমানকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি দলের কোনো সমর্থন বলে মনে করেন না সেলিনা হায়াত আইভী। গতকাল রাতে তিনি প্রথম আলোকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এটি শামীম ওসমানের প্রতি তাঁর বন্ধুবান্ধবের সমর্থন। আর বন্ধুদের যে কেউ এসে যে কাউকে সমর্থন দিতে পারেন।’
শামীম দেয়ালঘড়ি আর তৈমুর আনারস: শামীম ওসমান পছন্দের প্রতীক দেয়ালঘড়ি পেয়েছেন। বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার পেয়েছেন আনারস প্রতীক। তৈমুর আলম ও হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরী দুজনেই আনারস চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আনারস নিয়ে আর লটারি করতে হয়নি।
প্রতীক পেয়ে বিএনপির নেতা তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘আনারস হচ্ছে সাধারণ মানুষের প্রতীক। নারায়ণগঞ্জের মানুষ বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সুতরাং তাদের বঞ্চিত করা যাবে না। তাই আমরা ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। তবে আমাদের বিশ্বাস, নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহার করা থেকে সরে আসবে।’
শামীম, আইভী, তৈমুর ছাড়া মেয়র পদে লড়ছেন আরও তিনজন। তাঁরা হলেন: ইসলামী আন্দোলনের আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সী, তিনি গরুর গাড়ি পেয়েছেন; নির্দলীয় প্রার্থী শরীফ মোহাম্মদ পেয়েছেন হাঁস ও আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন তালা প্রতীক।
মেয়র ছাড়াও গতকাল ২৩৮ জন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী এবং ৫৬ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হয়।
মোরগ নিয়ে লড়াই: মেয়র পদে কোনো প্রতীক নিয়ে লটারি না হলেও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রতীক নিয়ে অসংখ্যবার লটারি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লড়াই হয়েছে মোরগ নিয়ে। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাতজন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর পছন্দ মোরগ। শেষ পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে মোরগের মালিক হন হারুনুর রশীদ। বাকিদের মধ্যে মোহাম্মদ সেলিম প্রধানের ভাগ্যে জোটে পানপাতা, মোজাম্মেল হক সিংহ, কুতুবউদ্দিন গ্লাস, মাসুদুর রহমান পদ্মফুল আর দ্বীন মোহাম্মদ পেয়েছেন ফ্যান।
প্রতীক বরাদ্দ শেষে অনেক প্রার্থী ও সমর্থকদের মিছিল করতে দেখা যায়। কাঙ্ক্ষিত প্রতীক পেয়ে অনেকেই রাস্তায় মিছিল শুরু করেন। খবর পেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, কারও বিরুদ্ধে মিছিলের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে। এর পরই তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা মনির হোসেন সাংবাদিকদের জানান, প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা আচরণবিধি ঠিকভাবে মেনে চলছেন কি না, তা পর্যবেক্ষণে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রার্থীরা প্রতিদিন কত টাকা খরচ করছেন, এর হিসাব সাত দিন পর পর ব্যয় পর্যবেক্ষণ কমিটির কাছে জমা দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.