ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা by গোবিন্দ আচার্য
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা। এ উৎসবের ইতিহাস সুপ্রাচীন। উপমহাদেশের বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ে শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। ভারতের মহেশের রথ উড়িষ্যার পুরীতে শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথের মেলা উপমহাদেশে বিখ্যাত। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম র্বণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা। এ উৎসবের ইতিহাস সুপ্রাচীন। এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে। ধামরাইয়ে যশোমাধবের রথযাত্রা শুরু হচ্ছে ১৬ জুলাই এবং উল্টো বা পুনঃ রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে ২৪ জুলাই।
এ রথযাত্রা উবোধন করবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্ঠা। ধামরাইয়ের রথ অতি প্রাচীন এবং উপমহাদেশে এই রথের খ্যাতি রয়েছে। ৪০ বছর আগে ধামরাইয়ের রথযাত্রা ও মেলার এমন একটি রূপ ছিল, যা মহেশের মেলায় বা অন্য কোনো মেলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রায় চার শ' বছর আগে তৈরি হয়েছিল ধামরাইয়ের প্রথম রথ। এ রথের প্রতিষ্ঠাতা দেবতা যশোমাধব। বিমাল সাততলা রথ নির্মাণ করেছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা বালিয়াটির তাৎকালীন জমিদার বাবু রায়। এরপর এর তত্ত্বাবধানের ভার নেয় ধামরাইয়ের রায় সম্প্রদায়। শ্রীশ্রী যশোমাধবের তত্ত্বাবধায়ক কমিটির মাধ্যমে প্রতি বছর রথ ডাকা হয় কয়েক লাখ টাকা। আর রথের মেরামতে এ অর্থ খরচ হয়ে যায়। শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দিরের বৈধ ও মূল সেবায়েতদের সহযোগিতায় '৯৮ সালের ১৩ জুলাই ৬৩৩৪ নং দলিল রেজিসি্ট্র মূলে দীর্ঘ ৪০ বছরের প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রী যশোমাধবের সার্বিক দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনায় নবগঠিত বোর্ড অব ট্রাস্টের ওপর ন্যস্ত হয়েছিল। র্বতমানে যশোমাধব মন্দির কমিটি পরিচালনা করছে। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত ধামরাই থানা সদরের একটি গ্রাম ধামরাই। এ গ্রামেই শ্রীশ্রী মাধব অঙ্গনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ও অধিষ্ঠিত রয়েছে ম্রী শ্রী যশোমাধব বিগ্রহ। অসিত গোস্বামী, শিবশঙ্কর চক্রর্বতী, দেবেশ চন্দ্র রায় মৌলিক, ড. মনোরঞ্জন রাজবংশী, অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র রায়ের মাধ্যমে রথযাত্রা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় যে, বাঙলা পাল বংশের শেষ রাজা ছিলেন যশোবন্ত পাল। তিনি অত্যন্ত প্রজাবৎসল, ধার্মিক রাজা ছিলেন। তিনি এই মাধবমূর্তি আবিষ্কার করেন। একদা রাজা হাতিতে আরোহণ করে বেড়াতে যান ধামরাই এলাকার পাশে অন্য কোনো একটি গ্রামে। চলতে চলতে হাতিটি একটি মাটির ঢিবির সামনে যায় আর সামনে এগুতে চায় না। তখন তিনি হাতিতে অবস্থান করেই স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে ওই মাটির ঢিবি খনন কাজ শুরু করলে সেখানে একটি মন্দির পান। তাতে বিষষ্ণুর মূর্তির মতো শ্রী মাধব মূর্তিও ছিল। রাজা ভক্তি করে সেটি নিয়ে আসেন। ধামরাই সদরে পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ঠ পণ্ডিত শ্রীরাম জীবন রায়কে তিনি ওই মাধবমূর্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বভার দেন। তখন থেকে শ্রী মাধবের নামে রাজা যশোবন্ত পালের নামটিও বিগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এর নাম হয় শ্রীশ্রী যশোমাধব। সেই দিন থেকে সেবা পূজার সুবন্দোবস্ত হলো। আজো ধামরাইয়ের শ্রী মাধব অঙ্গনে পূজা-অর্চনা চলে আসছে। এভাবেই অমর হয়ে আছেন রাজা যশোবন্ত পাল। পরে শ্রী মাধবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথমেলা। এ রথযাত্রা উপলক্ষে ধামরাইয়ে মাসব্যাপী গ্রামীণ ও কুটির শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলায় বিভিন্ন হস্তশিল্পের দ্রব্যাদি, মৃৎশিল্প, বস্ত্রশিল্প, ব্যাগ, বেত, কাঁসা, পিতলের দ্রব্যাদি, চুড়ি ও নানা রকম খেলনা, মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদির সমারোহ ঘটে। আর এ রথযাত্রা ও মেলা উপলক্ষে প্রত্যেক হিন্দু-মুসলমানের বাড়িতে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ দূরদূরান্ত থেকে কয়েক দিন আগে আত্নীয়-স্বজন আসা শুরু করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, আগের রথটি ৩২টি বড় কাঠের চাকার ওপর স্থাপিত ৯ কক্ষের ছিল। এ রথটি চমৎকার দর্শনীয় ও কারুকার্যমণ্ডিত। পল্লিকবি জসীম উদ্ধসঢ়;দীন ধামরাইয়ের রথকে স্মরণ করে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। ধামরাই রথ নামক এ কবিতার ছত্রে ছত্রে নিপুণভাবে ফুটে উঠেছিল এর সৌন্দর্যচিত্র গাথা আর ধ্বংসের ইতিবৃত্তি। রথ উৎসবের প্রথমদিনে ধামরাইয়ের বিখ্যাত হিন্দু তীর্থ যশোমাধব মন্দির থেকে বদ্যো নৃত্য ও বিশাল শোভাযাত্রা সহকারে কিংবদন্তিতে সেরা যশোমাধবকে মূর্তি রথের প্রকোষ্ঠে তুলে দীর্ঘ মেলা প্রাঙ্গণের মধ্য দিয়ে রথকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় অর্ধকিলোমিটার দক্ষিণ দিকে মন্দিরে এবং এক সপ্তাহের ব্যবধানে অনুরূপভাবে আবার রথটিকে আগের স্থানে টেনে নেওয়া হয়। যশোমাধব মূর্তি স্থাপিত হয় আবার যশোমাধব মন্দিরে। এ রথ টানার সময় চারদিক থেকে মানুষের ছিটানো চিনি ও কলা বৃষ্টির মতো পড়তে তাকে। এ দৃশ্য দেখার জন্য সর্বধর্মের লোকের মহাসমাগম ঘটে এখানে।
No comments