সাগর কিনারে এক মোহনীয় সন্দ্যায়... by নাসরিন আকতার
ঢাকায় তখন চলছিল অবরোধ উদযাপন। রাস্তাঘাট ছিল রিকশা ও হেঁটে চলা মানুষে পরিপূর্ণ। প্রতিদিন সকালে পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখি গাড়ি পোড়ানোর ছবি। স্ক্রিনেও একই দৃশ্যাবলির পুনরাবৃত্তি_ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া; কারো মাথা, কারোবা নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে আর থাকতে পারছি না। ৩-৪ দিন অবরোধ পার করার পর মনে হতে লাগল, চারপাশে গাড়ি-ঘোড়া নেই, দূষণ কম; অথচ অক্সিজেনের অভাব, ঠিক শ্বাস নিতে পারছি না। জীবন চলার গতি হঠাৎ কমে আসাতে যত অসুবিধা।
কোথাও না যেতে পারার নিষেধাজ্ঞাটিই সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে দেখা দিল। না, কোথাও বেরিয়ে পড়তে হবে। সেদিন ছিল বন্দুর বাসায় পার্টির_ হাসি-হট্টগোল, রাত ৩টায় হঠাৎ করে আমরা সিদ্ধান্ত নিই কক্সবাজার যাব এখনই। আমরা বলতে সুইটি, রিপন, আমি ও আমার হাজব্যান্ড সেলিম এবং আমার দুই বাচ্চাকে নিয়ে হুটহাট করে ব্যাগে বিচ উপযোগী কাপড় ও স্যান্ডেল নিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে রওনা হয়ে গেলাম। কুমিল্লার কাছাকাছি গিয়ে প্রথমবারের মতো গ্যাস স্টেশনে থামলাম। সেখানে আরো দু'চারটি গাড়ি দেখে সাহস দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমাদের মতো তারাও অবরদুব্দ ঢাকা শহর ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে যেদিকে যেতে চায় সেদিকে। পথে অনাকাঙ্খিত ঝামেলা ছাড়াই ভোরের নরম আলোয় আমরা কক্সবাজার প্রবেশ করলাম। অফসিজন ছিল বলে অ্যাডভান্স বুকিংয়ের দুশ্চিন্তা ছিল না। আমরা চলে গেলাম মারম্যাইড ক্যাফের খুব কাছে হোটেল ঝব পৎড়হি-এ। হোটেল সি ক্রাউনই, বুঝতে কষ্ঠ হয় না; যদিও ঝব পৎড়হি-এর একটি অ্যালফাবেট স্বচ্ছ কাচ থেকে মুছে গিয়েছিল। অফসিজন আর অবরোধের বদৌলতে পুরো হোটেল ছিল প্রায় ফাঁকা। হাতেগোনা ৮-৯ জন মাত্র। আমরা পেলাম ডিসকাউন্ট_ রাতে থাকলে সকালের নাস্তা ফিদ্ধ। চারতলায় দুটি রুম পছন্দ করে যথারীতি ফ্রেশ হয়ে নিলাম সবাই। তারপর নিচে নেমে ফিদ্ধ নাস্তার স্বাদ উপভোগ করলাম। প্রয়োজনীয় বিশ্রামটুকু নিয়ে মনের ভেতর ঘণ্টা বাজল। এবার মারম্যাইড ক্যাফেতে যাওয়ার পালা। সেখানে সুন্দর সুন্দর সময় কাটাব বলেই অন্য কোথাও না গিয়ে কক্সবাজার আসা। এখানকার লোভনীয় ও সুস্বাদু খাবারের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বলে চটজলদি দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম। জিহ্বার পানি সামলে নিয়ে যথাস্থানে বসে বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম। মনে মনে সুর করে বললাম, 'আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!' এ আনন্দ বলে বোঝানোর নয়, উপলব্ধি করার। মারম্যাইড থেকে সমদু্র দেখা যায়। মনে মনে দৌড় দিয়ে পানির ওপর দিয়ে অনেক দূর চলে গেলাম। কয়েকটি শিপ দেখতে পেলাম নোঙর ফেলা। ডেকে লোকজন দেখা যাচ্ছে। তারা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে? মনে হয় না। তারা চলে গেছে অন্য কোথাও। ডাঙায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো অথবা নিজের বাড়িতে। শিপে চড়ার বেশি ইচ্ছা হলো না। চোখের সামনে লোভনীয় খাবারের ছবিগুলো ভেসে উঠল একে একে। ফিরে এলাম এক দৌড়ে। মনের অনেক সুবিধা_ যখন যেখানে খুশি চলে যাওয়া যায়। ক্যাফের চারপাশ বাঁশের বেষ্ঠনী দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকের অংশে পুরনো শিপের দড়ির মই দিয়ে বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে যা দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশ্টার থেকে ক্যাফের ভিটা পর্যন্ত পাথর বিছিয়ে একটি ছোটখাটো রাস্তার শেপ তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার পাশে একটি হেমক ঝোলানো আছে, তার পাশেই রয়েছে একটি কাঠগোলাপ গাছ। তার একটি ডালে ফুটে রয়েছে কয়েকটি হলদু রংয়ের কাঠ গোলাম। ডালের শেপ আর একগুচ্ছ কাঠ গোলাপ এমনভাবে বিন্যস্ত ছিল যে, সেগুলোকে ফ্রেমে বন্দি করার ইচ্ছা জাগল মনে। এই বেড়াতে যাওয়া বাচ্চারা অনেক উপভোগ করেছে। যখন খুশি হেমকে শুয়ে দোল খাচ্ছে, দৌড় দিয়ে চলে যাচ্ছে ছোটখাটো পাথরের ওপর দিয়ে গেট পর্যন্ত আবার ফিরে আসছে। বিচের গরম বালিতে একবার পা ফেলে দ্বিতীয়বার আর পা ফেলল না। নিজ থেকেই বুঝে গেল জুতা ছাড়া গরম বালিতে যাওয়া যাবে না। তাদের শিশু বয়সে এটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন আমি বেশ উপভোগ করলাম। দুপুরের খাবার রেডি। সুন্দর পরিবেশনের সঙ্গে মজাদার খাবার তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। খাওয়ার পর তাদের মার্কস এস সেঙ্ন্সার টি না খেলে নিজেকে ম্যাড়মাড়া লাগছিল। তাই হয়ে গেল মার্কস এস সেঙ্ন্সার স্ট্রং টি। চাঙ্গা হয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি আবার বিকেলের টি টাইম। সন্দ্যা হয়ে এলো। ক্যাফের সামনে জ্বালানো হলো একটি এসওএস বাতি যার লাল বণরাউ আকাশে কিছদুহৃর পর্যন্ত লাল হয়ে গেল। বাচ্চারা ই... শব্দ করে দৌড়ে গেল। দেখলাম তাদের চোখে অবাক পৃথিবী। রাস্তার পাশে জ্বলতে লাগল হারিকেনের মিটিমিটি আলো। মোহনীয় হয়ে উঠল চারপাশ। হেসেখেলে কেটে গেল দু'দিন। তৃতীয় দিন খবর পেলাম অবরোধ উঠে গেছে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। একদিকে বাড়ি ফেরার আনন্দ, অন্যদিকে সুন্দরকে ফেলে যাওয়ার বিষাদ নিয়ে ঢাকার দিকে দিলাম ছুট।
No comments