মন্ত্রীর দুর্নীতির কারণেই আটকে গেল পদ্মা সেতু
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কারণেই আটকে গেছে পদ্মা সেতুর কাজ। বিশ্বব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ এনে ঋণসহায়তা স্থগিত করে দিয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন দিলে কাজ পেতে যোগাযোগমন্ত্রী নিজেই সহায়তা করবেন বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পরপর সাকো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে অব্যাহতি নেন সৈয়দ আবুল হোসেন। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরা হলেন মন্ত্রীর স্ত্রী খাজা নার্গিস হোসেন এবং দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন। অথচ যোগাযোগমন্ত্রী এই সাকোকে কমিশন এজেন্ট করার জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে চাপ দিয়েছেন। এ জন্য তিনি ভয়ভীতিও দেখান।
বিশ্বব্যাংক বিস্তারিত তদন্ত করে যোগাযোগমন্ত্রীর এসব দুর্নীতির তথ্য সরকারকে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটি সরকারকে দিয়ে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, এ অবস্থায় পদ্মা সেতুতে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো ঋণ ছাড় করা হবে না।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিষয়ে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তারা এ নিয়ে আর অগ্রসর হবে না। কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তারা সন্তুষ্ট হবে—জানতে চাইলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় দাতা সংস্থাটি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, যিনি ঘুষের প্রস্তাব দেন এবং যিনি নেন উভয়েরই শাস্তি হতে হবে।
এদিকে, ২২ দিন আগে দুর্নীতির বিস্তারিত এসব তথ্য সরকারের জানা থাকলেও যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থ ছাড় স্থগিতের কথা জানালেও যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলেননি। যদিও গতকাল বৃহস্পতিবার সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। এর আগে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল ইসলামকে গত রোববার সরিয়ে দেওয়া হয়। দুই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হলেও যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই মন্ত্রী এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সুজনের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এ বিষয়ে বলেন, যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে যে প্রশ্নটি এসেছে, তা আসলে ঘুষ। আর এই ঘুষ নেওয়ার প্রবণতাটি লুকিয়ে থাকে মনের মধ্যে। এ ধরনের মন্ত্রীরা নিজেরা পদত্যাগ করলে ভালো, না করলে অপসারণ করাটা জরুরি।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আরও বলেন, ‘আমরা বহুদিন থেকেই বলে আসছি, যাঁরা ঠিকাদারি ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত নয়। নির্বাচনী বিধির মধ্যেও এমন নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু কেউই তা মানছেন না। আর সৈয়দ আবুল হোসেন তো শুধু নির্বাচনই করেননি, মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন।’
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন অবশ্য পদত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে অপসারণ করা উচিত কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অপসারণ আমার হাতে নেই।’
তদন্ত প্রতিবেদন: গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দেওয়া ছাড়াও দাতা সংস্থাটির সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে করা তদন্ত প্রতিবেদনটি গত ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ভাষায় অত্যন্ত গোপনীয় এই প্রতিবেদনটি দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড এফ ম্যাকার্থি।
পাঁচ সপ্তাহ সময় নিয়ে বিশ্বব্যাংক এ তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করে। চার দেশের কমপক্ষে ১২ জন লোকের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এতে। এই তদন্তে শুধু মূল সেতুর কেনাকাটা চুক্তির বিষয়গুলো আনা হয়েছে। অন্যদিকে নির্মাণ, তদারকি ও পরামর্শক (সিএসসি) চুক্তির বিষয়গুলো তদন্ত করছে কানাডা কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগমন্ত্রীর বিষয়ে আরও তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকার চাইলে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটির চুক্তি, কেনাকাটা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ)। বিবিএ ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল সেতুর প্রধান অংশের জন্য প্রাক-যোগ্যতার দরপত্র আহ্বান করে। বিশ্বব্যাংক জুলাইয়ের আগেই প্রাক-যোগ্যতা তালিকায় অনাপত্তি পত্র দেয়। কিন্তু আগের বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করে দেওয়া হয় ১০ অক্টোবর। বলা হয়, দুর্নীতি, প্রাক-যোগ্যতার শর্ত পরিবর্তন এবং সেতুর ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) নির্মাণে প্রযুক্তি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার কারণে তা বাতিল করা হয়। পরের দিনই নতুন প্রাক-যোগ্যতার জন্য দরপত্র আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিবিএ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুর মূল অংশের প্রাক-যোগ্যতা চুক্তি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি-সংক্রান্ত অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। অভিযোগগুলো মূলত যোগাযোগমন্ত্রী ও তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, সাকো হলো পদ্মা সেতু নির্মাণের যেকোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের নীরব প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট)। কোনো কাজ পেতে হলে বা প্রাক-যোগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। সাকোর পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখানোর কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ না পেলে অনেকে প্রায়ই মিথ্যা অভিযোগ করে। ব্যক্তিগত রেষারেষি বা রাজনৈতিক কারণেও মিথ্যা অভিযোগ করে অনেকে। এ ক্ষেত্রেও ওই রকম অভিযোগ এসেছে কি না, তা সব সময়ই বিবেচনায় ছিল বিশ্বব্যাংকের। আর সে কারণেই অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করা হয়েছে এবং অভিযোগকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি সম্পন্ন করতে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। তাঁরা অবশ্য ভয় পাচ্ছিলেন। যাঁরা বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ বিশ্বব্যাংককে দিয়েছে, তাঁদের একটাই শর্ত ছিল, কোনোভাবেই তথ্যসূত্র যেন প্রকাশ করা না হয়। আশ্বাস দেওয়ার পরই তাঁরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেন এবং তথ্যপ্রমাণ হাজির করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাকোরই একজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল অংশের জন্য যে চুক্তিমূল্য হবে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সাকোর জন্য রাখার ব্যাপারে সৈয়দ আবুল হোসেনেরই নির্দেশনা ছিল। বলা হয়, সাকোকে নির্দিষ্ট কমিশন হিসেবে দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন সৈয়দ আবুল হোসেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরেকটি সূত্র থেকে বিশ্বব্যাংক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগের কথা জানতে পারে। সেটি হলো, সাকোর পাশাপাশি অন্য একটি কোম্পানিকেও সাকোর হয়ে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন আবুল হোসেন। কোম্পানিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ভয়ভীতিও দেখান মন্ত্রী। ওই কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কথা হলে তিনি জানান, মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন এত শক্তিধর যে তিনি চাকরি হারানো ও যেকোনো সময় দুর্ব্যবহারের আশঙ্কায় থাকেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও যথেষ্ট পরিমাণে তথ্যপ্রমাণ বিশ্বব্যাংক পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিষয়টি স্পর্শকাতর, বললেন অর্থমন্ত্রী: পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থমন্ত্রী গতকাল সচিবালয়ে দুই দফা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা বলা হলেও তা দেওয়া হচ্ছে না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ নিয়ে বড় ধরনের লড়াইয়ে (বিগ-ফাইটে) যাব কি যাব না, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে আমাদের।’ ওই ভাবনার কারণেই সরকারি ভাষ্য বা প্রেসনোটটি এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, তবে শিগগিরই তা দেওয়া হবে।
সরকারের বর্তমান মেয়াদে সেতু নির্মাণের কাজটি শুরু করতে পারলেও, তা শেষ করতে পারবেন না বলেও এ সময় জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এখন পর্যন্ত এ সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কাজ হয়েছে। এটুকু খুবই স্বচ্ছভাবে হয়েছে। যমুনা সেতুর সময় এ দুই কাজে দুর্নীতি হলেও পদ্মা সেতুর বেলায় তা হয়নি।’
বিশ্বব্যাংক বিস্তারিত তদন্ত করে যোগাযোগমন্ত্রীর এসব দুর্নীতির তথ্য সরকারকে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটি সরকারকে দিয়ে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, এ অবস্থায় পদ্মা সেতুতে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো ঋণ ছাড় করা হবে না।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিষয়ে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তারা এ নিয়ে আর অগ্রসর হবে না। কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তারা সন্তুষ্ট হবে—জানতে চাইলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় দাতা সংস্থাটি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, যিনি ঘুষের প্রস্তাব দেন এবং যিনি নেন উভয়েরই শাস্তি হতে হবে।
এদিকে, ২২ দিন আগে দুর্নীতির বিস্তারিত এসব তথ্য সরকারের জানা থাকলেও যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থ ছাড় স্থগিতের কথা জানালেও যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলেননি। যদিও গতকাল বৃহস্পতিবার সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। এর আগে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল ইসলামকে গত রোববার সরিয়ে দেওয়া হয়। দুই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হলেও যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই মন্ত্রী এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সুজনের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এ বিষয়ে বলেন, যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে যে প্রশ্নটি এসেছে, তা আসলে ঘুষ। আর এই ঘুষ নেওয়ার প্রবণতাটি লুকিয়ে থাকে মনের মধ্যে। এ ধরনের মন্ত্রীরা নিজেরা পদত্যাগ করলে ভালো, না করলে অপসারণ করাটা জরুরি।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আরও বলেন, ‘আমরা বহুদিন থেকেই বলে আসছি, যাঁরা ঠিকাদারি ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত নয়। নির্বাচনী বিধির মধ্যেও এমন নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু কেউই তা মানছেন না। আর সৈয়দ আবুল হোসেন তো শুধু নির্বাচনই করেননি, মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন।’
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন অবশ্য পদত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে অপসারণ করা উচিত কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অপসারণ আমার হাতে নেই।’
তদন্ত প্রতিবেদন: গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দেওয়া ছাড়াও দাতা সংস্থাটির সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে করা তদন্ত প্রতিবেদনটি গত ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ভাষায় অত্যন্ত গোপনীয় এই প্রতিবেদনটি দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড এফ ম্যাকার্থি।
পাঁচ সপ্তাহ সময় নিয়ে বিশ্বব্যাংক এ তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করে। চার দেশের কমপক্ষে ১২ জন লোকের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এতে। এই তদন্তে শুধু মূল সেতুর কেনাকাটা চুক্তির বিষয়গুলো আনা হয়েছে। অন্যদিকে নির্মাণ, তদারকি ও পরামর্শক (সিএসসি) চুক্তির বিষয়গুলো তদন্ত করছে কানাডা কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগমন্ত্রীর বিষয়ে আরও তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকার চাইলে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটির চুক্তি, কেনাকাটা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ)। বিবিএ ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল সেতুর প্রধান অংশের জন্য প্রাক-যোগ্যতার দরপত্র আহ্বান করে। বিশ্বব্যাংক জুলাইয়ের আগেই প্রাক-যোগ্যতা তালিকায় অনাপত্তি পত্র দেয়। কিন্তু আগের বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করে দেওয়া হয় ১০ অক্টোবর। বলা হয়, দুর্নীতি, প্রাক-যোগ্যতার শর্ত পরিবর্তন এবং সেতুর ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) নির্মাণে প্রযুক্তি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার কারণে তা বাতিল করা হয়। পরের দিনই নতুন প্রাক-যোগ্যতার জন্য দরপত্র আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিবিএ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুর মূল অংশের প্রাক-যোগ্যতা চুক্তি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি-সংক্রান্ত অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। অভিযোগগুলো মূলত যোগাযোগমন্ত্রী ও তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, সাকো হলো পদ্মা সেতু নির্মাণের যেকোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের নীরব প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট)। কোনো কাজ পেতে হলে বা প্রাক-যোগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। সাকোর পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখানোর কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ না পেলে অনেকে প্রায়ই মিথ্যা অভিযোগ করে। ব্যক্তিগত রেষারেষি বা রাজনৈতিক কারণেও মিথ্যা অভিযোগ করে অনেকে। এ ক্ষেত্রেও ওই রকম অভিযোগ এসেছে কি না, তা সব সময়ই বিবেচনায় ছিল বিশ্বব্যাংকের। আর সে কারণেই অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করা হয়েছে এবং অভিযোগকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি সম্পন্ন করতে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। তাঁরা অবশ্য ভয় পাচ্ছিলেন। যাঁরা বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ বিশ্বব্যাংককে দিয়েছে, তাঁদের একটাই শর্ত ছিল, কোনোভাবেই তথ্যসূত্র যেন প্রকাশ করা না হয়। আশ্বাস দেওয়ার পরই তাঁরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেন এবং তথ্যপ্রমাণ হাজির করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাকোরই একজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল অংশের জন্য যে চুক্তিমূল্য হবে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সাকোর জন্য রাখার ব্যাপারে সৈয়দ আবুল হোসেনেরই নির্দেশনা ছিল। বলা হয়, সাকোকে নির্দিষ্ট কমিশন হিসেবে দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন সৈয়দ আবুল হোসেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরেকটি সূত্র থেকে বিশ্বব্যাংক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগের কথা জানতে পারে। সেটি হলো, সাকোর পাশাপাশি অন্য একটি কোম্পানিকেও সাকোর হয়ে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন আবুল হোসেন। কোম্পানিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ভয়ভীতিও দেখান মন্ত্রী। ওই কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কথা হলে তিনি জানান, মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আবুল হোসেন এত শক্তিধর যে তিনি চাকরি হারানো ও যেকোনো সময় দুর্ব্যবহারের আশঙ্কায় থাকেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও যথেষ্ট পরিমাণে তথ্যপ্রমাণ বিশ্বব্যাংক পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিষয়টি স্পর্শকাতর, বললেন অর্থমন্ত্রী: পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থমন্ত্রী গতকাল সচিবালয়ে দুই দফা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা বলা হলেও তা দেওয়া হচ্ছে না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ নিয়ে বড় ধরনের লড়াইয়ে (বিগ-ফাইটে) যাব কি যাব না, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে আমাদের।’ ওই ভাবনার কারণেই সরকারি ভাষ্য বা প্রেসনোটটি এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, তবে শিগগিরই তা দেওয়া হবে।
সরকারের বর্তমান মেয়াদে সেতু নির্মাণের কাজটি শুরু করতে পারলেও, তা শেষ করতে পারবেন না বলেও এ সময় জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এখন পর্যন্ত এ সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কাজ হয়েছে। এটুকু খুবই স্বচ্ছভাবে হয়েছে। যমুনা সেতুর সময় এ দুই কাজে দুর্নীতি হলেও পদ্মা সেতুর বেলায় তা হয়নি।’
No comments