দু'ভাগ হচ্ছে ডিসিসি by শরীফুল ইসলাম

ঢাকা সিটি করপোরেশন অবশেষে দু'ভাগ হচ্ছে। এখন থেকে 'ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন' এবং 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন' নামে আলাদা দুটি সিটি করপোরেশন হবে। দক্ষিণের আওতায় থাকবে ৫৬টি এবং উত্তরের আওতায় থাকবে ৩৬টি ওয়ার্ড। ঢাকা মহানগরীর তেজগাঁও ও মোহাম্মদপুরকে উত্তরে রেখেই সিটি করপোরেশনের নতুন সীমারেখা নির্ধারণ করে সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯ সংশোধনীর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ আইনের সংশোধনীর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।


ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দ বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ডিসিসি দু'ভাগ করা হচ্ছে। এতে নগরবাসীর লাভ হবে না।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটিরও ওপরে। একটি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে নগরবাসীর সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই ডিসিসি দু'ভাগ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বৈঠকে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুষ্ঠু পরিবেশ ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে 'প্রতিযোগিতা আইন ২০১১'-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বৈঠকে বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমী আইন ২০১১-এর খসড়া এবং বন আইন (সংশোধিত) ২০১১-এর খসড়ারও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, সিটি করপোরেশন ভাগ করে সমস্যা আরও বাড়বে, কমবে না। সেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশন ভাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই, সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় থাকলেই ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, সংশোধিত আইনটি আজ ভেটিংয়ের জন্য আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ভেটিং শেষে আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকেই আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় আবার
উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এটি বিল আকারে উপস্থাপন করা হবে। সংসদে এটির বিল অনুমোদন হলেই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন দু'ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ এসব প্রক্রিয় সম্পন্ন হবে। সিটি করপোরেশন সংশোধনী আইন সংসদে পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান সিটি করপোরেশন বিলুপ্ত হবে। সরকার থেকে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। আগামী বছরের প্রথম দিকে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় ৩৬টি ওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো_ ১নং থেকে ২৩নং ওয়ার্ড, ৩৭নং থেকে ৪৭নং ওয়ার্ড এবং ৫৪ ও ৫৫নং ওয়ার্ড। রাজধানীর এলাকার মধ্যে_ উত্তরা, পল্লবী, মিরপুর, ভাসানটেক, কাফরুল কচুক্ষেত, কুড়িল, বাড্ডা, গুলশান, বনানী, মহাখালী, মধ্যবাড্ডা, পূর্ব রামপুরা, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, তেজগাঁও, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আদাবর, টঙ্গী ডাইভারশন রোড এলাকার ওয়ার্ডগুলো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হবে। ওয়ার্ড অনুযায়ী একজন কাউন্সিলর হবেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনও ঠিক থাকবে। উত্তরে যেসব এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অখণ্ড রাখা হয়েছে। সংসদীয় এলাকাও অখণ্ড রেখে ওয়ার্ডগুলো উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এ সিটি করপোরেশন থেকেই ওই এলাকার নাগরিকরা প্রাপ্য সেবা পাবেন। সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা ভবনও তৈরি করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ৫৬টি ওয়ার্ড রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে_ ২৪নং থেকে ৩৬নং ওয়ার্ড, ৪৮নং থেকে ৫৩নং ওয়ার্ড এবং ৫৬নং থেকে ৯২নং ওয়ার্ড। রাজধানীর এলাকার মধ্যে খিলগাঁও, গোড়ান, মাদারটেক, আহমদবাগ, মুগদা, মানিকনগর, গোপীবাগ, আরামবাগ, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, গুলবাগ, ধানমণ্ডি, শুক্রাবাদ, শাহবাগ, পল্টন, হাজারীবাগ, লালবাগ, কোতোয়ালি, নবাবপুর, সদরঘাট, সূত্রাপুর, নারিন্দা, মৈশুন্দী, গেণ্ডারিয়া, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, কামরাঙ্গীরচর এলাকার ওয়ার্ডগুলো দক্ষিণের আওতায় পড়বে। বর্তমান সিটি করপোরেশনের ভবনই হবে 'দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের' মূল ভবন। এ করপোরেশনেরও কোনো ওয়ার্ডকে বিভক্ত করা হয়নি। সব ওয়ার্ড অখণ্ড রেখে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যে কারণে দক্ষিণের সীমানা বড় রাখা হয়েছে : সিটি করপোরেশনের নতুন সীমারেখায় দক্ষিণে বেশি ওয়ার্ড রাখা হয়েছে। আর এর পেছনেও যুক্তি দেখিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ বিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আরও সম্প্রসারণ করা হবে। বিশেষ করে উত্তরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফেস এবং পূর্বাচল উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যোগ হবে। এ করপোরেশনকে সম্প্রসারিত করার সুযোগ রয়েছে বলে এর সীমানা দক্ষিণের তুলনায় ছোট রাখা হয়েছে। দক্ষিণে ভবিষ্যৎতে সম্প্রসারণ করার সুযোগ নেই। এসব বিবেচনায় সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে ঢাকা বিভাগও ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের জেলার আনুপাতিক হারও বিবেচনা করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের সীমানা নির্ধারণে।
যে কারণে ভাগ : বর্তমান ঢাকা সিটি করপোরেশনে জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। এর আয়তন ১৫০ বর্গকিলোমিটার। এত বড় এ মহানগরীতে একটি কেন্দ্র থেকে সেবা প্রদান দুরূহ হয়ে পড়েছে। এতে সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। রাস্তাঘাটসহ ভৌত কাঠামো কোনোভাবেই ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় ১০টি অঞ্চলে ভাগ করা হলেও তা কাজে আসছে না। মনিটরিংয়ের অভাবে এ অঞ্চলগুলোর কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাবার পানি সঠিকভাবে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। একটু বৃষ্টি হলে পানি জমছে রাজধানীর রাস্তাঘাটে। প্রতি পদেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বর্তমান সিটি করপোরেশন। এ ভোগান্তি থেকে উত্তরণে সিটি করপোরেশনকে দুটি ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের ইতিহাস : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস গৌরবময়। এ শহরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে একসময় বাংলার এবং পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের বা আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস। 'ঢাকা পৌরসভা' প্রতিষ্ঠিত হয় ১ আগস্ট ১৮৬৪ সালে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজধানী নগরীর গুরুত্ব বাড়ার কারণে ১৯৭৭ সালে একটি নতুন পৌরসভা অর্ডিন্যান্স ঘোষিত হয়। তখন স্বতন্ত্র অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ঢাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ১৯৮৩ সালে একটি স্বতন্ত্র অর্ডিন্যান্স বলে ঢাকাকে করপোরেশনে পরিণত করে এবং এর নাম রাখা হয় 'ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন'। ১৯৮৮ সালে করপোরেশনকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। অঞ্চলগুলো হলো_ উত্তরা, ধানমণ্ডি, গুলশান, মতিঝিল। এ বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ঢাকার মেয়রের অতিরিক্ত ডেপুটি মেয়ররা দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা পৌর কপোরেশন ঢাকা সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয় ১৯৯০ সালে। পরে চারটি অঞ্চল বিলুপ্ত করা হয়। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম প্রত্যক্ষ সর্বজনীন ভোটে মেয়র নির্বাচন। মোহাম্মদ হানিফ হলেন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম মেয়র। সাদেক হোসেন খোকা বর্তমান মেয়র।
বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য : বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সমকালকে বলেন, সিটি করপোরেশনকে দু'ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যেখানে নগরবাসীর সেবার মান নিশ্চিত করতে ডিসিসিকে আরও শক্তিশালী ও ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন, সেখানে সরকার এটিকে ভাগ করে অদূরদর্শিতার পরিচয়ই শুধু দেয়নি- সম্পূর্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের সমস্যার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই দায়ী।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞের বক্তব্য : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, সিটি করপোরেশন ভাগ করার উদ্দেশ্য যদি সঠিক সেবা প্রদান হয়, তাহলে এটি ঠিক করা হয়নি। কারণ একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েই নগরবাসীর সঠিক সেবা নিশ্চিত করা যায়। মূলত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই নগরবাসী সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন সিটি করপোরেশন ভাগ করলে তো আর সমন্বয়হীনতা কমবে না। এটি আরও বাড়বে। যার ফল নগরবাসীকে পোহাতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.