দেশি-বিদেশি আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত : যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারে মৌলিক নীতিমালা উপেক্ষিত

দেশে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারের প্রহসন করা হচ্ছে। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণের বিষয় রয়েছে। আইনটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জুডিশিয়াল রিভিউর অধিকার দেয়া হয়নি। এ আইনে বিচারের মৌলিক নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন এ আইনকে মানবতাবিরোধী কালো আইন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা চান যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক। তবে এই বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের, যাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়।


তাদের মতে, ১৯৭৩ সালের আইনে যেসব অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের অংশ। কিন্তু প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ এবং অপরাধের উপাদানের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে সেসব আইনের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান, সংজ্ঞা এবং উপাদান উল্লেখ করা হয়নি। যেমন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, অপহরণ এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং অপরাধের উপাদানের বিষয়েও উল্লেখ নেই। এটা শুধু জামায়াত নয়, বাংলাদেশের বেশকিছু রাজনৈতিক দল, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং সুশীল সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশও ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংবিধান এবং ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ও পরবর্তী সময়ে প্রণীত বিধিমালা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তি ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিগত ১৭ মাসে এ আইন ও বিধিমালা এবং বাংলাদেশ সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অংশ সংশোধনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রানজিশনাল জাস্টিস, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত মিস্টার স্টিফেন জে. র্যাপ ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান ।
টবি ক্যাডম্যান : আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান গত রোববার দীর্ঘ এক বিবৃতিতে বলেন, ১৯৭৩ সালের আইনে যেসব অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের অংশ। কিন্তু প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ এবং অপরাধের উপাদানের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে সেসবের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান, সংজ্ঞা এবং উপাদান উল্লেখ করা হয়নি। যেমন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, অপহরণ এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং অপরাধের উপাদান বিষয়েও উল্লেখ নেই। যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে টবি ক্যাডম্যান ১৪ দফার যে সমালোচনা উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে আরও রয়েছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি বিপক্ষে অংশ নিয়েছেন তাদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বিচারের জন্য দাঁড় করানো হয়েছে তাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আগে থেকে কোনো কিছু না জানিয়ে এবং আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের কোনো সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। চ্যালেঞ্জ করলে বিচারপতি নিজেই তার সিদ্ধান্ত আবার বিবেচনা করবেন, অন্য কেউ নয়। ১৯৭৩ সালের আইন, বিচারপতি নিয়োগ, ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা এবং আওতা নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী মাত্র তিন সপ্তাহ সময় পাবেন তার জবাব তৈরির জন্য। অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থায় যেসব বিধি-বিধান প্রয়োগ করা হয় তা এখানে অনুপস্থিত।
টবি ক্যাডম্যান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানের করার বিষয়ে যতই ঘোষণা দেয়া হোক না কেন বাস্তবে কিন্তু তার বিপরীতটা দেখা যাচ্ছে। যেমন, আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে ১৯ সেপ্টেম্বর রাজপথে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় জড়ানো হয়েছে। অথচ ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ওই ঘটনার সময় আমার সঙ্গে ইউরোপে অবস্থান করছিলেন। তিনি জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। টবি ক্যাডম্যান উল্লেখ করেন, দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় কর্মরত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গমান গত ৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার কারণে তিনিসহ ওই পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ কেন আনা হবে না মর্মে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। আগামী ২৩ তারিখ আদালতে হাজির হয়ে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, তারা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সমালোচনার টুঁটি চেপে ধরতে চায়। টবি ক্যাডম্যান বলেন, আসামিপক্ষকে বর্তমানে যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে ঠিক একই অবস্থায় তারা অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পর যদি উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ পান তাহলে সেখান থেকেও তারা কোনো লাভবান হতে পারবেন না। টবি ক্যাডম্যান বলেন, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি অভিযোগের কোনো দিন তারিখ উল্লেখ নেই। এমনকি চারটি অভিযোগের বিষয়ে ধারে-কাছেও কোনো তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে তিনি ১৯৭১ সালে এসব অপরাধ করেছেন। টবি ক্যাডম্যান বলেন, সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে, নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের যেমন মধ্যবর্তী আপিলের সুযোগ ছিল বাংলাদেশেও তেমন ব্যবস্থা রয়েছে। এ বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন : সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন এনে যুদ্ধাপরাধীদের সংজ্ঞা নতুন করে ঠিক করেছে। এতে ইচ্ছামাফিক যে কোনো ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের আওতায় আনা যাবে। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী পুরনো অপরাধের বিচার ওই সময়ের আইন ছাড়া নতুন আইনে করা যায় না। নতুন আইনে বিচার করা সংবিধান পরিপন্থী। তিনি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের ওপর যে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করেছে, নিঃসন্দেহে তা যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৯৫ হাজার সদস্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যাচাই-বাছাই করে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার চিহ্নিত ওই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ত্রিদেশীয় চুক্তির আওতায় পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। বিচার না করে ফেরত পাঠানোর এ সিদ্ধান্ত দেশবাসী সুন্দরভাবে দেখেনি। এরপর দালাল আইন করে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার দায়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান দেশের তত্কালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে দালাল আইনে অভিযুক্ত চারটি অপরাধ ছাড়া (হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ) বাকিদের ক্ষমা করে দেন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে অভিযুক্ত আসামি না থাকায় অন্যান্য অপরাধ দণ্ডবিধির ধারা অনুসারে বিচারযোগ্য হওয়ায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে দেন। দীর্ঘ চার দশক পর বর্তমান সরকার আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা একটা রাজনৈতিক পদক্ষেপ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহিংসার মাধ্যমে ঘায়েল করার পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা আওয়ামী লীগ সরকার এর আগেও ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তখন কোনো বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের টার্গেট করে এ বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ এই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেই আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যুগপত্ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল। তখন জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের কোনো অভিযোগ করেনি। এটা সবার কাছে স্পষ্ট যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিক জোট গঠনের কারণেই তারা এখন যুদ্ধাপরাধী বনে গেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যদি করতেই হয় তাহলে আওয়ামী লীগ যে ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে ভারতের মধ্যস্থতায় ছেড়ে দিয়েছিল, বাংলার মাটিতে তাদের বিচার করতে হবে আগে। এরপর সহযোগী হিসেবে যদি কেউ অপরাধ করে থাকে তাদের বিচারের প্রশ্ন আসবে। এছাড়াও ফৌজদারি আইনের বিধান অনুযায়ী আসল অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে সহযোগীর বিচার করা বেআইনি।
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম : মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লর্ড এভিবেরি যে ২০টি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন তার একটিরও সমাধান হয়নি। এখনও বিধি সংশোধন হয়নি। এ আইনে বিচারের মৌলিক নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণের বিষয় রয়েছে। আইনটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের অধিকার দেয়া হয়নি। এ আইনে ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিলের ব্যবস্থা নেই। বিচারক নিয়োগ, ট্রাইব্যুনালের গঠন, এমনকি বিচারকের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই, বা এগুলো কোথাও চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রাখা হয়নি। অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আয়োজন করেছেন। জামায়াত ও জামায়াত নেতাদের তরফ থেকে বরাবরই এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, মামলা লড়ার জন্য প্রাজ্ঞ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর উপস্থিতি। দেশ-বিদেশে যুদ্ধাপরাধ আইন ও তার বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এ ধরনের আইনজীবী বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। আমি প্রকাশ্য আদালতে একাধিকবার অভিযোগ করেছি। এই অবস্থায় অভিযুক্ত জামায়াত নেতারা বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের জন্য বার কাউন্সিলের অনুমতি প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বার কাউন্সিল তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গত ১৯ জুলাই পরিষ্কার বলে দেন, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের আবেদন মঞ্জুর করা হবে না। তার মতে, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করা হলে বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে।
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম অভিযুক্ত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, অনিশ্চিত তথ্য অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করা আইসিসিপিআরের লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ওই আইনে স্বাক্ষরকারী দেশ। তিনি এ প্রসঙ্গে আইসিসিপিআরের বিভিন্ন ধারা, নুরেমবার্গ ট্রায়ালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও বিচারের রায় নজির হিসেবে উপস্থাপন করেন, যার কপিও ৩ বিচারক ও সরকারপক্ষের আইনজীবীদের সরবরাহ করেছেন। তিনি বলেন, একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ৮ মাসের যে কোনো একদিন এক ব্যক্তির হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট সময়, স্থান, তারিখ এখানে উল্লেখ নেই। ৯ মাসে অসংখ্য নারী ধর্ষিত হয়েছে, গণহত্যা হয়েছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। এর সঙ্গে মাওলানা সাঈদী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন তারিখের, কোন ঘটনায় তিনি জড়িত, তা উল্লেখ নেই। সেই ঘটনায় ভিকটিমই বা কে তাও উল্লেখ নেই। এই ধরনের অস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কোনো অভিযোগ গঠন হতে পারে না। এটা আইসিসিপিআরের লঙ্ঘন, যা বাংলাদেশ মানতে বাধ্য। দেশীয় আইন, সংবিধান কোনোটিই এভাবে অস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন সমর্থন করে না। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জোর করে হিন্দুদের মুসলমান বানিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। কিন্তু কবে, কাকে, কোথায় মুসলমান বানানো হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এভাবে ৭টি অপরাধ সংঘটনের জন্য ৩৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর প্রতিটি অভিযোগই ভিত্তিহীন। পর্যাপ্ত তথ্য, প্রমাণ, উপাত্ত এতে নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া চার্জ গঠন হলে সেটা সুবিচার হবে না। এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের আইনের অপর্যাপ্ততার কথা তুলে ধরে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, অপরাধে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনালের আইন কভার না করলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন কী বলে সেটা দেখতে হবে। সব আইনেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগই চার্জ গঠনের ভিত্তি বলে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায় আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, সময়, ভিকটিমের নাম ও সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা ছাড়া অভিযোগ গঠন হতে পারে না। ঘটনাস্থল, সময়, তারিখ ইত্যাদি কোনো কিছুই সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগে বলা হয়নি। সুতরাং, এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
লর্ড অ্যাভেবুরি : আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ, চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভেবুরি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে বৈঠককালে বলেছেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ২০টি সমস্যা রয়েছে। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল দেশীয় হবে, না আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হবে, তা ঠিক করতে হবে। দেশীয় হলে দেশীয় আইন আর আন্তর্জাতিক হলে আন্তর্জাতিক আইন পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে কোনোটাই মানা হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিচার হতে হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী। এর জন্য বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ, আন্তর্জাতিক মনিটরিংকে অনুমোদন এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইন সংশোধন করতে হবে, যার মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। গত ২৮ জুলাই লন্ডনের ফ্লিডেন রোডে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। আইনমন্ত্রী গত ২৩ জুলাই যুক্তরাজ্য সফরে যান। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে অ্যাভেবুরির বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আলোচনা হয়। সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তিনি আইনমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। লর্ড অ্যাভেবুরি এতে উল্লেখ করেন, বিচারকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছ করার বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যাপ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়ার ক্রাইম কমিটি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মহল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আপত্তি জানিয়ে আসছে।
এছাড়া আইন ও রুলস অব প্রসিডিউরের সংশোধন ছাড়া আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। চিঠিতে সংগঠনের এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এডামস ৮ দফা সুপারিশ করেন। এছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান মারিও ডিয়াজ ব্যালার্ট। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও অব্যবস্থাপনায় পূর্ণ এই ট্রাইব্যুনাল থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। এর আগে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইনে স্বচ্ছ বিচারে বিশ্বস্বীকৃত মানদণ্ড অনুপস্থিত বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন মার্কিন সিনেটর জন বুজম্যান। গত ডিসেম্বরে লেখা চিঠিতে এ অভিযোগে আটকদের ব্যাপারে মৌলিক মানবাধিকার খর্ব করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

No comments

Powered by Blogger.