মানুষ চায় নির্বাচন, সরকার চায় ভাগাভাগি by সোহরাব হাসান
একেই বলে নাকের বদলে নরুন। ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা চেয়েছিলেন নির্বাচন। সরকার নির্বাচন না দিয়ে মহানগরকে ভাগ করে দুটি সিটি করপোরেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিল। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংসদের আগামী অধিবেশনে আইন পাসের মাধ্যমে আইনটি চূড়ান্ত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, ঢাকা মহানগরের আয়তন ও লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় একটি করপোরেশনের পক্ষে তাদের সমস্যা সমাধান কঠিন। এ জন্যই দুটি করপোরেশন করা হলো—ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ।
এক নগরে দুই করপোরেশন হওয়ার পর নাগরিক সুবিধা যে বাড়বে তার নিশ্চয়তা কী? মহানগরের সমস্যা তো সিটি করপোরেশন একটা বা দুটি থাকা নয়। সমস্যা হলো এই মহানগরের নাগরিকদের পানি, বিদ্যুত্, গ্যাস, রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে কি না? যদি না হয়, এক মেয়রের স্থলে দুই মেয়র বসিয়ে লাভ কী?
কেবল ঢাকা নয়, সব সিটি করপোরেশনই ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার। সব ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের কাছে। আবার মন্ত্রণালয়েরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। সিদ্ধান্ত নেন সরকারপ্রধান। সব মন্ত্রী, সাংসদ, মেয়র, কাউন্সিলরের কাজ হলো তাঁকে সমর্থন জানানো, জয়ধ্বনি দেওয়া। রাষ্ট্রপতি-শাসিত কিংবা সংসদীয় ব্যবস্থা—কোনো পার্থক্য নেই। সব ক্ষমতার উত্স প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আগে ছিল রাষ্ট্রপতির কার্যালয়।
এসব কারণেই সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের দাবি উঠেছিল। সেই দাবি প্রথম করেছিলেন ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। সমর্থন করেছিলেন চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীও। পৃথিবীর বহু দেশে নগর সরকার আছে। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার সংস্থার হাতে কোনো ক্ষমতা দিতে নারাজ। এভাবে হানিফ আমল গেল। তারপর এলেন সাদেক হোসেন খোকা। পরিস্থিতির ইতর বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।
খোকার মেয়াদ পার হয়ে গেছে, ২০০৭ সালের মে মাসে। আওয়ামী লীগের নেতারা মহানগরের দুরবস্থার জন্য তাঁকেই দায়ী করেন। আবার নির্বাচনের দাবি উঠলে চুপ করে থাকেন। এভাবে সাড়ে চার বছর চলে গেছে। নির্বাচন কমিশন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিল। সরকার নির্বাচন দিতে সাহস পায় না। তাদের হাতে যুত্সই প্রার্থী নেই। তাই সিটি করপোরেশন ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিল। একে বলে তুঘলকি কাণ্ড।
মানুষ চায় নির্বাচন। সরকার চায় ভাগাভাগি। এক নগরে দুই করপোরেশন। সেটি হতে পারবে না, তা নয়। কিন্তু নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিতে হবে। না হলে একটি ভেঙে ১০টি করপোরেশন করলেও লাভ হবে না। সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশন অখণ্ড রেখেই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করত। ঢাকা সিটি করপোরেশন বর্তমানে ১০টি জোনে বিভক্ত। সেই ১০টি জোনে ১০ জন উপ-মেয়র থাকতে পারতেন। সিটি করপোরেশন ভাগ করা মানে দুজন মেয়র। দুটি নগর ভবন। বিশাল দুটি প্রশাসনিক কাঠামো। নগরবাসী যেই তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকবে।
নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে কেন? পত্রিকার খবর, পছন্দসই প্রার্থী পাচ্ছে না। যেই দল একজন মেয়র প্রার্থী দিতে পারে না, সেই দল কী করে দুজন মেয়র প্রার্থী দেবে? ধরে নিলাম, আগামী পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ যুত্সই প্রার্থী পেল না। তাহলে কি তারা পাঁচ বছর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখবে? আওয়ামী লীগের পছন্দসই প্রার্থী না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হবে না? এরই নাম গণতন্ত্র?
No comments