টিউলিপ সিদ্দিকের নৈতিকতা ও প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান by শহীদুল্লাহ ফরায়জী
বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যা ও গুম নিয়ে সাংবাদিকের পক্ষ থেকে যখন টিউলিপ সিদ্দিকের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল তখন তিনি অসহিষ্ণুভাবে বলেছিলেন- ‘আমি বৃটেনে জন্মগ্রহণ করেছি এবং বৃটেনের সাংসদ।’ আরও বলেছিলেন- এটা যেন সবাই খেয়াল রাখেন। অর্থাৎ তিনি যেহেতু বৃটেনের বংশোদ্ভূত নাগরিক এবং বৃটেনের রাজনীতি ও সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেহেতু বাংলাদেশ-প্রশ্নে জ্ঞাত নন এবং এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু টিউলিপ সিদ্দিকের এই অবস্থান অনুসৃত নৈতিকতার বিপরীত। এতে প্রমাণিত হয় একদিকে তার মুক্তচিন্তার সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে অন্যদিকে নৈতিকতার স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা, কৌশলগত সুবিধা গ্রহণের কারণ। তার মা এবং খালা বাংলাদেশের রাজনীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন, কীভাবে আর্থিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে ব্যক্তিগত সুবিধাকে অনুমোদনযোগ্য করে তুলেছিলেন, তা না জানার কোনো কারণ নেই। টিউলিপ সিদ্দিক ইতিহাসের সর্বোচ্চ নৈতিক বিশ্বাসের দু’টি উৎসকে অস্বীকার করে নিজেকে ক্রমাগত নিরাপদ রাখতে চেয়েছেন। এর একটি হচ্ছে- রাজনৈতিক বিশ্বাস অন্যটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস। বৃটিশ নাগরিক হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিক নাগরিক এবং ব্যক্তিগত নৈতিকতার অস্তিত্বকে মূল্যহীন করেছেন। ফলে তিনি বুঝতে পারেননি, কোন ক্রিয়ার প্রশংসা করা হয় আর কোন ক্রিয়ার নিন্দা করা হয়।
টিউলিপ সজ্ঞানে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বগতোক্তি করেছেন- তিনি বৃটিশ নাগরিক, নৈতিকভাবে বৃটেনের প্রতি তার আনুগত্য রয়েছে এবং বৃটিশ রাজ্যের আজ্ঞাবাহী। বর্তমানে তিনি বৃটিশ সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া- (ক্রেমলিনের অভ্যন্তরে) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ক চুক্তিটি স্বাক্ষর করার সময় বৃটিশ নাগরিক এবং লেবার পার্টির একজন কাউন্সিলর টিউলিপ সিদ্দিক স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেন কি? পারলে সেটা রাষ্ট্রীয় কোন প্রটোকলের আওতায় পড়ে? গণমাধ্যমে প্রকাশ- টিউলিপ মোট ১০ বিলিয়ন ডলারের সেই চুক্তিটির ‘দালালি’ করতে সহায়তা করেছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিক জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নন কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। অথচ তিনি বাংলাদেশের প্রতি শর্তহীন অনুজ্ঞাও প্রকাশ করেননি বরং বৃটেনের নিরঙ্কুশ নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেছেন।
কী-নীতির ভিত্তিতে ১০ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক চুক্তির অনুষ্ঠানে টিউলিপ সিদ্দিকের অবস্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল! কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এই উপস্থিতির দৃষ্টান্তের কারণে প্রশ্ন উঠা- দশ বিলিয়ন ডলারের দালালি করতেই তিনি খালা শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হয়েছিলেন, এটা যৌক্তিক। কোনোরকম প্রলোভন ছাড়া নিছক ভ্রমণের জন্য তিনি রাশিয়ায় যাননি, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তি ও নৈতিকতা- দু’টোকে দূরে সরিয়েই অনৈতিক কাজে জড়িত হয়েছেন এবং উৎসাহিত করেছেন।
টিউলিপ সিদ্দিক তার খালার গত ১৫ বছরের শাসনে গণহত্যা-সহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের প্রশ্নে টু-শব্দটি উচ্চারণ করার প্রয়োজন বোধ করেননি বরং অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। খালার ক্ষমতার প্রভাবে ক্রিকেট খেলার মাঠে বাংলাদেশ-গ্যালারিতে বসে বিনা টিকিটে খেলা দেখেন। এতে তার মাধ্যমে ন্যায্যতা এবং অন্তর্দৃষ্টির সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সুবিধা ভোগের নানারকম ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ না করে নৈতিক মূল্যকে তিনি বিলীন করেছেন। আইনবোধ এবং যুক্তিবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আইনসম্মত কাজে লিপ্ত হওয়াই নৈতিকতার মূল শর্ত, যা টিউলিপের মাঝে অনুপস্থিত। এ ছাড়াও যৌথ প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট নিয়েছেন তিনি এবং তার ছোট বোন। এসব কোনোটাই নৈতিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং বিশুদ্ধ কর্তব্যবোধও নয়। বিভিন্ন ধরনের উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ বা সম্পদ লাভের উদ্ভূত প্রেরণা গ্রহণ কোনোক্রমেই বৈধ নয়। উল্লেখ্য, হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক হত্যা করে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। দুর্নীতির অভিযোগে পরিবারের সকলেই এখন অভিযুক্ত।
টিউলিপ সিদ্দিক তার বক্তব্যে বোঝাতে চেয়েছেন- বৃটিশ রাজ্য তার সর্বাগ্রে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় তার বাসনা কী- তা ক্রমাগত উন্মোচিত হচ্ছে। অতএব নীতি ও নৈতিকতায় টিউলিপ যে-বলিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হননি তা স্পষ্ট। নীতিদর্শনে কান্ট বলেছেন- ‘কর্তব্য যখন একমাত্র কর্তব্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন বহিঃনিয়ন্ত্রণের অবকাশ থাকে না এবং তখনই প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রকাশ পাওয়া যায়। মানুষ যখন স্বার্থ, লাভ-লোকসান বা প্রীতিবোধ দ্বারা কর্তব্য কাজে উদ্বুদ্ধ হয় তখন তার ইচ্ছার ভিত্তি প্রকৃতপক্ষে বহির্শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সে কাজ বা ভিত্তি কখনো প্রকৃত অর্থে মঙ্গলময় বলে গণ্য হতে পারে না।’
বৃটিশ রাজনীতিতে দুর্নীতি ও নৈতিক কেলেঙ্কারি: বৃটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কিত সামপ্রতিক অভিযোগগুলো জনগণের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে এবং বৃটেনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লেবার পার্টির ট্রেজারির অর্থনৈতিক সচিব এবং সিটি মিনিস্টার হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত টিউলিপ, দুর্নীতি ও অনৈতিক আচরণের অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; গত ৪০ বছরে বেশ কয়েকজন বৃটিশ এমপি দুর্নীতি ও নৈতিকতা লঙ্ঘনের কারণে পদত্যাগ করেছেন বা বরখাস্ত হয়েছেন। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো কনজারভেটিভ এমপি নিল হ্যামিল্টনের ক্ষেত্রে, যিনি হ্যারডস ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক মোহাম্মদ আল-ফায়েদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত। দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর হ্যামিল্টন ১৯৯৭ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
আরেকটি উদাহরণ হলো লেবার এমপি ইলিয়ট মোরলের ক্ষেত্রে, যিনি ২০০৯ সালে মিথ্যা খরচের দাবি করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মোরলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরে ১৬ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। টিউলিপ সিদ্দিকের কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে, এটা স্পষ্ট যে- তিনি একজন এমপি হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, আস্থা বিনষ্ট করেছেন এবং তার পদত্যাগ করা উচিত বা বরখাস্ত হওয়া উচিত। টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে উপহার হিসেবে একটি ফ্ল্যাট পাওয়া সম্পর্কে মিথ্যা বলা, উপহার ঘোষণা করতে ব্যর্থ হওয়া এবং বাংলাদেশে অর্থ আত্মসাতের জন্য তদন্তের মুখোমুখি হওয়া। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে টিউলিপের ভূমিকায় এই অভিযোগগুলো বিশেষভাবে গুরুতর।
লন্ডনের ফ্ল্যাটের মালিকানা বিষয়ক সত্যিকারের তথ্য প্রকাশে তিনি তার বৃটিশ আর্থিক, স্বার্থ, সম্পদ এবং দায়বদ্ধতা নিবন্ধনের অঙ্গীকারনামার শপথ ভঙ্গ করেছেন। টিউলিপের কর্মকাণ্ড বিশ্বাস ভঙ্গ এবং জবাবদিহিতার অভাব স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করে। লন্ডনের ফ্ল্যাটের প্রকৃত প্রকৃতি বা তথ্য প্রকাশ করতে তার ব্যর্থতা এবং যথাযথ ঘোষণা ছাড়া উপহার গ্রহণ- গুরুতর নৈতিক লঙ্ঘন। উপরন্তু, বাংলাদেশে অর্থ আত্মসাতের তদন্ত টিউলিপের সততা এবং পদের যোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। উপসংহারে, টিউলিপ সিদ্দিকের কেলেঙ্কারি- বৃটিশ রাজনীতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তার একটি স্পষ্ট স্মারক। নিল হ্যামিল্টন এবং ইলিয়ট মোরলের উদাহরণ প্রমাণ করে যে, দুর্নীতি এবং নৈতিক লঙ্ঘন সহ্য করা হয় না। টিউলিপের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো এবং বিশ্বাসভঙ্গ স্পষ্ট করে যে, তার দ্রুত পদত্যাগ করা উচিত নয়তো তিনি বরখাস্ত বা আদালতে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। বৃটিশ জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আরও উচ্চতর নৈতিকতা আশা করে।
ইতিমধ্যে বৃটিশ সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্তের আহ্বান জানিয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান। কিন্তু টিউলিপ সিদ্দিক এখনো স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ তদন্তে সহযোগিতা করার যে-রীতি এবং প্রথা বা নৈতিক বাধ্যবাধকতার পথ, তা তিনি অনুসরণ করেননি। তিনি কোন অধিকার বলে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে হাজির থেকেছেন সে ব্যাখ্যা আজও দেননি। এসব কর্মকাণ্ড- খালা শেখ হাসিনা এবং ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিককে কোনোক্রমেই নৈতিক অনুমোদন দেয় না। বিবেকের নির্দেশে না চলায় এই বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি ক্রমশই জটিলতর হচ্ছে। অনেকেরই দাতা হাতেম তাইয়ের মতো দাতব্য হয়ে ওঠার আড়ালে মানিলন্ডারিং-এর তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে সর্বনাশা দুর্নীতির যে-অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, আইনগত এবং নৈতিকভাবে অনুমোদন অযোগ্য কর্মকাণ্ড যেভাবে বিস্তার লাভ করেছিল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের যে ভয়াবহ চিত্র প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে- তার দুর্বিষহ পরিণতির জন্য আমাদেরকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।? অবশ্য শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং তার পরিবার যে নৈতিক বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ নন বা ছিলেন না- এটি নিয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। এই পরিবার সহজেই সকল ধরনের অন্যায়-অবিচার এবং দুর্নীতিকে গ্রহণ করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছে। তাদের মর্যাদা সারা বিশ্বে যেভাবে ধূলিসাৎ হয়েছে, তা আর কোনোদিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
কান্ট বলেছিলেন-‘মানুষ যদি ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে ছিন্ন করার ক্ষমতা রাখে এবং যুক্তির রাজ্যে প্রবেশ করার শর্তহীন শক্তির অধিকারী হয়, তাহলেই বাধ্যবাধকতা ও নৈতিক দায়িত্বশীলতা উভয়ই রক্ষা করা সম্ভব।’
টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক সূর্য মধ্য গগনে তীব্র উজ্জ্বলতায় আলো ছড়াবে, না কি চিরকালের জন্য অস্তমিত হবে, তা দেখার জন্য আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com
No comments