সাংবাদিকতা আমার নেশা, পেশা by মতিউর রহমান চৌধুরী
যাইহোক, কিছুদিন পর পূর্বদেশের তৎকালীন সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী আমাকে চাকরি দেন। সেটাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাকে গেজেটেড সরকারি চাকরিরও অফার করা হয়। কিন্তু সে চাকরিতে আমি যোগ দেইনি। সুইডেন চলে যাব এমনটাই স্থির হয়েছিল। এর মধ্যে পরিবর্তন আসে দেশে। ১৫ই আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমের নতুন যাত্রা শুরু হয়। ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ ঘটে দৈনিক দেশবাংলার। সেখানে যোগ দেই। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়া হয়। অল্পদিনের মধ্যেই দৈনিক সংবাদে চাকরি হয়ে যায়। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রীরা ঘুষ খাবেন না, তথ্য পাচার করবেন না। কোরআন শরীফ ছুঁয়ে তারা শপথ নেন। এই খবরটা আমার কাছে এসেছিল বিভিন্ন সূত্র থেকে। ইত্তেফাকের সহকর্মী আলমগীর হোসেনের সহায়তায় খবরটির চূড়ান্ত সত্যতা যাচাই করার পর লিখে দেই। ব্যানার হেডিং হয়ে যায়। পরদিন হুলস্থূল। জিয়াউর রহমানের প্রেস উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিস ডেকে পাঠান বঙ্গভবনে। খবরের সূত্র জানতে চান। এটা বলি কী করে! একমাত্র সম্পাদক ছাড়া আর কারও কাছে সূত্র বলার সুযোগ নেই। এটাই সাংবাদিকতার শপথ। উত্তেজিত দাউদ খান মজলিস ফোন করলেন সংবাদের সম্পাদক আহমেদুল কবিরের কাছে। বললেন, তোমার রিপোর্টার তো আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে। ফিরে এলাম প্রেস ক্লাবে। এরপর সচিবালয়ে ঢুকতেই নিরাপত্তারক্ষী বাধা দিলেন। বললেন, আপনার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হয়ে গেছে। দুপুরের পর অফিসে যেতেই বলা হলো, কবির সাহেব রেগেমেগে অস্থির, দেখা করতে বলেছেন। সম্পাদক আহমেদুল কবির তখন কথা বলছিলেন বার্তা বিভাগের দায়িত্বরত প্রয়াত বজলুর রহমানের সঙ্গে। তিনিই আমার রিপোর্টটি খুব যত্ন সহকারে ছেপেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল আমি আর যাই করি ভুল রিপোর্ট দেবো না। কবির সাহেব সূত্র জানতে চাইলেন না। বললেন, ওরা তো খবরের সত্যতা অস্বীকার করছে না। তারা শুধু জানতে চাচ্ছে কে খবরটা লিক করেছে। বজলু ভাই তখন আমাকে সমর্থন করলেন। বললেন, ওর দোষ কোথায়। ও তো ঠিকই লিখেছে। কোরআন শরীফ ছুঁয়ে যদি কেউ শপথ ভঙ্গ করে তাহলে এই সমস্যা আমাদের নয়। বিষয়টির নিষ্পত্তি এখানেই হলো না। তিন দফা এসবি অফিসে যেতে হয়েছিল। সংবাদে থাকাকালে বাংলাদেশ চীন থেকে অস্ত্র কিনছে এই রিপোর্ট প্রকাশের পর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ কয়েকঘণ্টার জন্য আটক রাখে আমাকে। বাতিল হয় অ্যাক্রিডিটেশন। জেনারেল আমসা আমিন ছিলেন দায়িত্বে। বারবার একই প্রশ্ন। কে দিয়েছে আপনাকে এই খবর। বলা চলে, এই সব রিপোর্টই আমার জন্য ইত্তেফাকের দরজা খুলে দেয়।
ইত্তেফাকের তখন স্বর্ণযুগ। এক দুপুরে ডাক পেলাম সেখান থেকে। ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দেখা করতে বলেছেন। এক সাক্ষাতেই চাকরি হয়ে গেল। কূটনৈতিক রিপোর্টারের দায়িত্ব পেয়ে গেলাম। সে দিনগুলো ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। বহুবার ডিজিএফআই আর এসবি অফিসে যেতে হয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় ইভেন্ট কাভার করার সুযোগ হয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে প্রথম বাংলাদেশি সাংবাদিক হিসেবে অংশ নেয়ার বিরল সুযোগও আসে। এমনকি বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও প্রথম বাংলাদেশি সাংবাদিক ছিলাম। আর এসবের জন্য আজও কৃতজ্ঞতা জানাই সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে ইত্তেফাককে আরও সমৃদ্ধ করেন। পরে যোগ দেন রাজনীতিতে। মন্ত্রীও হন। সে নিয়ে অবশ্য তখনই লিখিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, একজন সম্পাদক যেখানে মন্ত্রী, এমপি বানান তার কেন মন্ত্রী হতে হবে! যাইহোক, এটা অন্য বিতর্ক। ইত্তেফাকে থাকাকালে নিয়মিতভাবে কলাম লিখতাম সাপ্তাহিক খবরের কাগজে। তখন উপসাগরীয় যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ কাভার করার জন্য সৌদি আরব যাওয়ার প্রস্তুতিপর্বে দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। তখন এরশাদের জমানা। লেখাটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। আমার গাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নিয়ে গিয়ে ব্রিজের ওপর থেকে ফেলে দেয়া হয়। মামলা গড়ায় আদালতে।
তৃতীয়মাত্রা-খ্যাত সাংবাদিক জিল্লুর রহমানের বিরামহীন তাগিদের প্রেক্ষিতে লেখাটা জমা দিয়ে প্লেনে চড়েছিলাম। তারপর তো অনেক কিছু ঘটে যায় দেশে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হুলিয়া জারি করা হয় আমার বিরুদ্ধে। আবারো বাতিল করা হয় আমার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। প্রধান বিচারপতি তখন সাহাবুদ্দীন আহমদ। তার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ থেকেই ঐতিহাসিক রায় আসে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজের প্রকাশনা ফের চালু হয়। আজ সংবাদমাধ্যম যেটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে মূলত বিচারপতি সাহাবুদ্দীনেরই অবদান। অথচ, তার কথা আমরা কেউই স্মরণ করি না। এখানে বলে রাখা ভালো, দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য লেখার কারণে আমাকে ১৭ ঘণ্টা আটক রাখা হয়েছিল। ইত্তেফাক ছাড়লাম। যোগ দিলাম আজকের কাগজে। অল্পদিন পরেই ছাড়তে হলো মালিকপক্ষের সঙ্গে বিরোধের কারণে। পরের ইতিহাস নিজের পায়ে দাঁড়ানো। পারিবারিক সঞ্চয় আর স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া অর্থ খুইয়ে বাংলাবাজার পত্রিকা ছেড়ে দিতে হলো। বাংলাবাজারে থাকা অবস্থায় জেলে যেতে হলো। রয়টার্সের সাবেক ব্যুরো প্রধান সিরাজুল ইসলাম কাদিরের একটি রিপোর্ট প্রকাশের কারণেই খালেদা জিয়ার প্রশাসন আমাকে অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে। নতুন যাত্রা শুরু হলো মানবজমিন-এ। যত ঝামেলা এখানেই। একটি ক্যাসেট কেলেঙ্কারির রিপোর্ট প্রকাশের জন্য মামলা হলো আদালতে। তখন সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। শেখ হাসিনা তখন প্রধানমন্ত্রী। আদালত অবমাননার মামলায় প্রমাণ চেয়ে নির্দেশনা এলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা চান। এক্ষেত্রে মানবজমিনই ব্যতিক্রম। হাজির করলাম ক্যাসেট। যেখানে সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিচারপতি লতিফুর রহমান কথা বলছিলেন টেলিফোনে একটি নির্দিষ্ট মামলা নিয়ে। প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ আমার পথে দাঁড়ালেন। যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ছিল। বিচারপতি পদত্যাগ করলেন। মামলায় আমার এক মাস জেল হলো। সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর একদিন। আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছয় মাস। মামলাটি এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। মাঝখানে বিরতি। আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনা। মানবজমিন-এ তার বিরক্তি ছিল প্রচণ্ড। বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিলেন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম। টানা আট মাস বিদেশে থাকতে হলো। দীর্ঘ সময় অ্যাক্রিডিটেশন পেলাম না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ। ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে সরানোর জন্য লবিং করলো হাসিনার প্রশাসন। ২৮ বছর পর ছাড়তে হলো ভয়েস অফ আমেরিকা। কূটনৈতিক পার্টিগুলোতেও এজেন্সির লোকেরা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। হাসিনার পতনের তিনদিন আগে ২রা আগস্ট আবার দেশ ছাড়তে হলো আমাকে।
এগুলো সংক্ষিপ্ত বয়ান। তবে, এখানে দু’টি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপন এবং গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি খবর। দীর্ঘ ১১ বছর আত্মগোপনে ছিলেন হারিছ চৌধুরী। করোনায় তার মৃত্যু হয়। দাফন করা হয় সাভারে। কিন্তু খবরটি মামুলি কোনো খবর নয়। ১১ বছর ধরে ঢাকার পান্থপথে অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান নামে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু মানবজমিন-এর অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ব্যক্তিই হারিছ চৌধুরী। ২০২২ সনের ৬ই মার্চ আমার এই অনুসন্ধানী রিপোর্টটি প্রকাশের পর চারদিকে হইচই পড়ে যায়। সকল সংবাদমাধ্যম খবরটি লুফে নেয়। জানতে চাওয়া হয় ইন্টারপোল থেকেও। কিন্তু গোয়েন্দারা বরাবরের মতোই অস্বীকার করেন। বলেন, খবরের কোনো সত্যতা নেই, মানবজমিনকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানবজমিন দুঃখ প্রকাশ করেনি। বিষয়টি গড়ায় আদালতে। হারিছ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজীন চৌধুরীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় মাহমুদুর রহমান নয়, হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন।
পরের খবরটি রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তখন বলা হয় তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। সেই আলোচিত পদত্যাগপত্রের অনুসন্ধান করতে গিয়েই পাওয়া গেল অবিশ্বাস্য এক খবর। পদত্যাগপত্র নেই কোথাও। এর কারণ কী? তিনি কি পদত্যাগ করেননি? প্রেসিডেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল দেশ ছাড়ার সময় শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র দিয়ে যাননি। খবরটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় সরকারি মহলে। রাজনৈতিক নেতারাও উষ্মা প্রকাশ করেন। সপ্তাহখানেক ধরে মিডিয়াজুড়েই ছিল এই খবরটি। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও খবরটি ঘিরে নানা বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট প্রচার হতে থাকে। প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে চাপ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি থেমে যায় নানা রাজনৈতিক ইকুয়েশনে।
(হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব-এর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘অন্তরালের মুখ’ স্মরণিকা থেকে)
No comments