পাবনা ও নাটোরে রসুন চড়া দামে বিক্রি করে খুশি চাষিরা

পাবনা ও নাটোর জেলায় জমি থেকে রসুন তোলা চলছে পুরোদমে। এ অঞ্চলে চলতি মওসুমে মসলা জাতীয় ফসল রসুনের আশাতীত ফলন ও ভাল দাম পেয়ে কৃষকের মুখে হাঁসি ফুটেছে। প্রায় ২৯ হাজার ৭২৮ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ২৩ হাজার টন রসুন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ বছর রসুনের আকার ও গুনগতমান খুবই ভাল হয়েছে। মওসুমের শুরুতেই প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা চড়া দামে রসুন বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলে লাভের মুখ দেখছেন।
আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবার রসুনের আশাতীত ফলন পাওয়া যাবে বলে পাবনা ও নাটোর কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। চলতি রবি মওসুমে নাটোর ও পাবনা জেলায় রসুন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল ২১ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ২০০ টন। এবার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাত হাজার ৮৬৮ হেক্টর বেশী জমিতে রসুন আবাদ হয়েছিল। অর্থাৎ ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫৯ হাজার ৭৬০ টন বেশী রসুন উৎপাদন হয়েছে। গত বছর রসুনের আবাদ কম হওয়ায় বাজারে রসুনের দাম বেশী হয়েছে। অর্থৎ দেশি রসুনের দাম প্রতিমণ ছয় হাজার টাকার বেশি হয়ে যায়। এ অঞ্চলে এখন জমি থেকে রসুন তোলা ও শুকানোর কাজ চলছে পুরোদমে। রসুনের ফলন হয়েছে আশাতীত। এবছর পাবনা ও নাটোর জেলায় অঞ্চলে রেকর্ড পরিমান ২৯ হাজার ৭২৮ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ২৩ হাজার টন রসুন উৎপাদন হবে বলে কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকরা আশা প্রকাশ করেছেন। পাবনা ও নাটোর কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সুত্রে জানা যায়, দেশের উত্তরের চলনবিল অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়। রসুন এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ফসলে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় ১৩ হাজার ৮২ হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৪ হাজার ১১৫ টন, গুরুদাসপুরে ৭ হাজার ৩০০ হেক্টরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টন, লালপুরে ৮০০ হেক্টরে ৬ হাজার টন, বাগাতিপাড়ায় ৪০০ হেক্টরে তিন হাজার টন, সিংড়ায় ৩০০ হেক্টরে দুই হাজার ২৫০ টন, পাবনার চাটমোহরে সাত হাজার ৫০০ হেক্টরে ৫৬ হাজার ২৫০ টন, পাবনা সদর, সুজানগর, বেড়া, সাঁথিয়া, আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ৪০০ হেক্টরে তিন হাজার টন রসুন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। এসব এলাকায় প্রতি বছরই রসুন আবাদের পরিমান বাড়ছে। চলনবিল অঞ্চলে বিনা চাষে রসুন আবাদ হয়। সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয় নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর এবং পাবনার চাটমোহর উপজেলায়। মসলা জাতীয় ফসল রসুন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত দেশের চলনবিলের বড়াইগ্রামের বাজিতপুর, মাড়িয়া, ইকড়ি, জালশুকা, তারানগর, শ্রীরামপুর, মানিকপুর, চকপাড়া, রয়না ভরট, মামুদপুর, রয়না, রোলভা, খাকসা, চড়ইকোল, গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা, কাছিকাটা, হাঁসমারী, দড়ি হাঁসমারী, শিধুলী, চড়কাদহ, মশিন্দা, চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, কাটেঙ্গা, কোকড়াগাড়ি, ধানকুনিয়া, লাঙ্গলমোড়া, বরদানগর, ধুলাউড়ি, বোয়ালমারি, গৌরনগর, বিন্যাবাড়ি, নিমাইচড়া এলাকায় সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়েছিল।
চলনবিল অঞ্চলে বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পরই পলিযুক্ত দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটিতে রসুন রোপন করা হয়। কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হওয়ায় পাবনা ও নাটোর জেলায় এ বছর রসুনের আশাতীত ফলন হয়েছে। এখন এ অঞ্চলের কৃষাণ-কৃষাণীদের দম ফেলার সময় নেই। তারা জমি থেকে রসুন তুলে বাড়ীতে আনা এবং শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করচ্ছে। গত বছর মৌসুমের শুরুতে আর্দ্র রসুন প্রতিমণ বিক্রি হয়েছে এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দরে। এবার আর্দ্র রসুন প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা দরে। ভাল দাম পেয়ে রসুন চাষিরা বেশ খুশি। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোর কৃষকেরা স্ব-উদ্যোগে প্রথম বিনা চাষে রসুন আবাদের প্রচলন শুরু করেন। এই রসুনের আবাদ বা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বড়াইগ্রাম উপজেলার জালশুকা গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম পূর্ণি জানান, চলনবিল অঞ্চলের জমিতে সাধারণত বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে নরম জমিতে বিনা চাষে রসুনের কোয়া রোপণ করা হয়। এ জন্য প্রচলিত নিয়মে জমি চাষ করার প্রয়োজন পড়ে না। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে। সার প্রযোগ করতে হয় কম। রোপণ থেকে উৎপাদণ পর্যন্ত ১২০ দিনের এই রসুন উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে পুরনো পদ্ধতির আবাদের চেয়ে অনেক কম। বিনা চাষ পদ্ধতিতে রসুনের ফলন বেশি হয়। প্রতি বিঘা জমিতে রসুনের ফলন পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩০ মণ। সাধারণত চৈত্র মাসে জমি থেকে রসুন তুলে আনা হয়। বড়াইগ্রামের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি সার, ২৫ কেজি পটাশ সার ও ১৫ কেজি জিপসাম সার ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যে নরম জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হয়। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে দুই মণ রসুনের প্রয়োজন হয়। জমিতে রসুন রোপণের দিনই খড় বা বিচালী দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়।
বীজ রোপণের একমাস পরে পানি সেচ দিয়ে বিঘায় ১০ কেজি হারে ইউরিয়া সার ও পাঁচ কেজি হারে এমওপি সার ছিটিয়ে দিলে ফলন ভালো হয়। এ বছর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, বাগাতিপাড়া, সিংড়া উপজেলায় রসুনের বাম্পার ফলন হয়েছে। রসুনের আকার ও গুনগতমান খুবই ভাল হয়েছে। গুণগত মান বৃদ্ধি ও হাটবাজারে বিক্রির জন্য চাষিরা রসুন এখন রোদে শুকাচ্ছেন। শুকানো রসুনের দাম ভাল পাওয়া যায়। পাইকার ও মজুতদারা হাটবাজার থেকে আর্দ্র রসুন কিনে শুকানোর কাজ শুরু করেছেন। চাটমোহরের ব্যবসায়ী আব্দুস ছালাম আর্দ্র রসুন মানভেদে প্রতিমণ কিনছেন এক হাজার ৯০০ টাকা থেকে দুই হাজার ১০০ টাকায়। আর্দ্র রসুন রোদে শুকানোর পর প্রতিমণে ৫ থেকে ৭ কেজি ঘাটতি হয়। সেই হিসেবে শ্রমিক খরচসহ প্রতিমণ শুকানো রসুনের দাম পড়ছে প্রায় তিন হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতিমণ শুকানো রসুন হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৬৫০ টাকায়। ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা কম দামে রসুন কিনে শুকিয়ে বেশি দামে ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের বিক্রি করছে। এ বছর বাম্পার ফলন হওয়ায় হাট-বাজারে রসুনের সরবরাহ বেড়েছে। গত বছর প্রতিমণ আর্দ্র সরষে বিক্রি হয়েছিল এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। এ বছর প্রতিমণ রসুন এক হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আগামীতে রসুনের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ত্ইা অনেক ব্যবসায়ীই রসুন কিনে শুকিয়ে গুদামজাত করতে শুরু করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোরের লক্ষীকোল বাজার, রয়না ভরট হাট, মৌখাড়া হাট, জালশুকা হাট, চাঁচকৈড় হাট, চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা হাট, মির্জাপুর হাট, ছাইকোলা হাট রসুন বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। রসুন বেচাকেনার জন্য বিভিন্ন হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ৎ। চট্রগ্রাম, সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রসুনের বেপারী এসে আরৎদারদের মাধ্যমে চাহিদা অনুয়ায়ী রসুন কিনছেন। পরে রসুন বস্তায় ভরে ট্রাকে করে সড়ক পথে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে হাট-বাজারে মান ভেদে প্রতি মণ শুকনা রসুন ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিমন শুকনো নতুন রসুন তিন হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাবনার সুজানগর উপজেলার বিলগাজনা এলাকার রসুন চাষী খোরশেদ আলম পুর্ণি ও রফিক মোল্লা বলেন, প্রতি বছরই কৃষকদের রসুন যখন বেচা হয়ে যায়, তখন রসুনের দাম বাড়ে। এতে তাদের কোন লাভ হয় না। সারা বছর খেটে আবাদ করে রসুনের উৎপাদণ খরচ ওঠেনা। অথচ মৌসুমের শেষে মজুতদারেরা বেশি দামে রসুন বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তোলেন। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভূতি ভূষণ সরকার জানান, দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটি রসুন চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
এ কারণেই নাটোর জেলায় বিশেষ করে বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায় সর্বাধিক জমিতে রসুন চাষ হয়। জমিতে টিএসপি, পটাশ ও জিপসাম ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যে নরম জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হয়। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে দুই মণ রসুনের প্রয়োজন হয়। জমিতে রসুন রোপণের দিনই খড় বা বিচালী দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়। বীজ রোপণের একমাস পরে পানি সেচ দিয়ে জমিতে ইউরিয়া ও এমওপি সার ছিটিয়ে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। পাবনা সদর, সুজানগর, বেড়া, সাঁথিয়া, আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলায় কম বেশি রসুন আবাদ হয়। এসব এলাকায় প্রতি বছরই রসুন আবাদের পরিমান বাড়ছে। এ বছর রসুনের আকার ও গুনগতমান খুবই ভাল হয়েছে। এ অঞ্চলে গত এক দশকের মধ্যে রসুনের এমন বাম্পার ফলন পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.