জনমনে সন্দেহ: নানা প্রশ্ন

বাংলাদেশ ব্যাংকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে সন্দেহের নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যৌক্তিক কিছু কারণেই ক্রমেই তা ডালপালা ছড়াচ্ছে। অন্যতম কারণ এক বছর আগে ঘটে যাওয়া রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না করা। ওদিকে ফিলিপাইন সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের লোকজন জড়িত। তাই তারা টাকা ফেরত দেবে না।
উপরন্তু এক সপ্তাহ আগে ই-মেইল হ্যাক ঘটনার পর তিন দিনের ছুটির আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লোরে আগুন লাগা কেউ স্বাভাবিকভাবে মানতে পারছেন না। হতে পারে এটি দুর্ঘটনা। কিন্তু নানা পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক মহলও এটিকে সহসা দুর্ঘটনা হিসেবে দেখতে নারাজ। তাদের মত, বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিটি দিয়ে সন্দেহের প্রতিটি বিষয়কে যুক্তিযুক্তভাবে খণ্ডন করতে হবে। বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর এ বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে যুগান্তর প্রতিবেদক। এর মধ্যে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, বিশ্লেষক, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাও আছেন। আছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। যাদের বেশির ভাগ মানুষের বক্তব্যের মধ্যে ছিল নানা সন্দেহ আর অবিশ্বাস। অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, তদন্ত রিপোর্ট না দেয়া পর্যন্ত তারা আগেই কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ ঝাঁঝাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শুক্রবার সন্ধ্যায় যমুনা টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুনের ঘটনায় সবার মতো আমিও আহত হয়েছি। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।’ তিনি বলেন, ‘ভল্ট, রিজার্ভ, ই-মেইল হ্যাকিং ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একই যোগসূত্রে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে সদিচ্ছা না থাকলে তদন্ত সঠিকভাবে হবে না।’ এ ছাড়া এ ঘটনায় জনমনে উঁকি দেয়া অনেক প্রশ্নের ভিড়ে বেশির ভাগ মানুষ পাঁচটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রথমত, বহুল আলোচিত রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হাইপাওয়ার তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করা। রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে বলে দিনক্ষণ নির্ধারণ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গণমাধ্যমে কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি সেখান থেকে রহস্যজনক কারণে সরে আসেন।
এ বিষয় অনেকে স্বাভাবিকভাবে নেননি। কেননা, ইতিমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর এসেছে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজন জড়িত। সিআইডির পক্ষ থেকেও কয়েক দফা বলা হয়, সন্দেহভাজনরা চিহ্নিত হয়েছে। যে কোনো সময় গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল সবই ‘বজ আঁটুনি ফসকা গেঁরো’। তাই অনেকে বলছেন, সরকার নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো কারণে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় স্থানীয় অপরাধীদের রক্ষা করতে চাইছে। এরই ধারাবাহিকতায় আরও কোনো গোপন তথ্য ধ্বংস করে দিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানোর ষড়যন্ত্র করা হয়। দ্বিতীয়ত, ৩০ তলা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিটি ফ্লোরই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ফ্লোর হলো ১৪ তলা। এখানে আছে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ। আর এর উপরের তলায় অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন বিভাগ এবং নিচে ১২ তলায় বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তথ্যভাণ্ডার। এখন এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুমান করা যায়, সাধারণত এ ধরনের আগুন দ্রুত আশপাশের ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আধাঘণ্টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে ভয়াবহ সর্বনাশ বয়ে আনতে পারত। অনেকের প্রশ্ন- ব্যাংকের এত জায়গা বাদ দিয়ে সবচেয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ জোনে আগুন লাগল কেন? যেহেতু রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি, তাই তারা এখানে ষড়যন্ত্রের ঘ্রাণ পাচ্ছেন। তৃতীয়ত, আগুনের সূত্রপাত হয় জিএম মাসুদ বিশ্বাসের কক্ষে। সূত্র বলছে, সম্প্রতি তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার কাছে ওই ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত রয়েছে।
হতে পারে, এ সংক্রান্ত নথিপত্র নষ্ট করতেই আগুন লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়। কেননা তিনি অফিস থেকে চলে যাওয়ার পরই আগুনের ঘটনা ঘটে। চতুর্থত, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘কেপিআই’ভুক্ত (নি-িদ্র নিরাপত্তাবেষ্টিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) এলাকা। সেখানে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধক সব ব্যবস্থা সব সময় অক্ষুণ থাকে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুন লাগা অস্বাভাবিক ঘটনা। পঞ্চমত, গত ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছিল হ্যাকাররা। রিজার্ভ চুরির পর এ ধরনের হ্যাক হওয়ার ঘটনা এবং তার সাত দিনের মাথায় আগুন লাগাকে অনেকে যোগসাজশ বলেও দেখতে চান। এ ছাড়া সূত্র জানায়, এই আগুন লাগার ঘটনায় ঝুঁকিতে ছিল ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই বিভাগ ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন বিভাগ বা অফ সাইট সুপারভিশন বিভাগ (ডস)। ওই দুই বিভাগ পুড়ে গেলে ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ খেলাপির তালিকা, দুর্নীতিবাজদের তথ্য-উপাত্ত সবই মুছে যেত। এতে লাভবান হতো দুর্নীতিবাজরা। এ ছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে আগুন লাগায় ধারণা করা হচ্ছে, এ ঘটনায় বিদেশী কোনো চক্রের হাত থাকতে পারে। ব্যাংক অভ্যন্তরে যাদের প্রতিনিধি থাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সূত্র আরও জানায়, আগুন লাগার ঘটনাটি গভর্নর ফজলে কবিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও হতে পারে। কেননা তিনি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত করায় কিছু কর্মকর্তা তার ওপর ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। তাই যারা গভর্নরকে পছন্দ করেন না তাদের একটি চক্র তাকে বেকায়দায় ফেলতে এ কাজটি করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.