চীন কি কান্ডারি হতে পারবে?

এ বছরের জানুয়ারি মাসে দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক বৈঠকে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চীনের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিশ্বায়নের সপক্ষে কথা বলেছেন। তিনি এক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আন্তর্জাতিকতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় চীন এখন বৈশ্বিক নেতৃত্ব গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিশ্বায়নের ইঞ্জিন সচল রাখার জন্য যে সমাধান প্রয়োজন, চীন কি তা দিতে পারবে? ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন বিশ্বব্যবস্থা মারাত্মক সংকটে পড়েছে। এতে যেমন পশ্চিমা অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে, তেমনি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো খাটো হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লাগার্দ বলেছেন, ওই সংকটের পর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দিচ্ছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো। আর এখন বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংশ আসছে এই দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে চীন ও রাশিয়ার মতো উদীয়মান শক্তিগুলো উদার প্রতিষ্ঠান ও তার মূল্যবোধগুলো আরও খাটো করেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ শীর্ষক মানবিক হস্তক্ষেপের নীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে উদীয়মান চীন পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্বের মুখোমুখি হয়েছে। সেই লড়াই যেমন কূটনৈতিক, তেমনি সামরিক। এসব ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদার ব্যবস্থা ২.০ সৃষ্টি করতে চাইছে। এর সঙ্গে তারা এশিয়াকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ করে সেখানকার বিদ্যমান পরিস্থিতি বজায় রাখতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের আঞ্চলিক প্রভুত্ব রোধ করতে চায়, অনেক পর্যবেক্ষকই এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন নীতি একই সঙ্গে রক্ষা ও শক্তিশালী করতে চায়। সাবেক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ট ক্যাম্পবেল এটাকে এশিয়ার ‘অপারেটিং সিস্টেম’ আখ্যা দিয়েছেন। সে কারণেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন। সমুদ্রে নৌচালনাবিষয়ক আইনকানুন প্রয়োগ করেছেন। এ ছাড়া তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী ১১টি দেশের সঙ্গে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন কংগ্রেস আইএমএফের ২০১০ সালের কোটা অ্যান্ড গভর্ন্যান্স রিফর্ম অনুসমর্থন করে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড তাদের মুদ্রাভান্ডারে চীনা রেনমিনবিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই হিসাবের নাম হচ্ছে স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যদি হিলারি ক্লিনটন জিততেন, তাহলে এখন আমরা দেখতাম, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এশিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বিরাজমান অবস্থা বজায় রাখার জোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে অনেকেই ভয় পান, বিরাজমান আন্তর্জাতিক বন্দোবস্ত শিগগিরই বদলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র যে এই উদার বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায় তার কারণ হচ্ছে, সে এই ব্যবস্থার সুফলভোগী। কিন্তু ট্রাম্প মার্কিন আধিপত্যকে বোঝা মনে করেন। এটার সঙ্গে যে সুবিধা জড়িয়ে আছে, সেটা তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। আর বিশেষভাবে বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা নিয়ন্ত্রণজনিত যে সুবিধা আছে, সেটাও তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মাতবরিও ছাড়তে চান না। এর মানে এটাই হয় যে তিনি বাণিজ্য যুদ্ধ ও সামরিক সংঘাতের দিকে ঝুঁকে যেতে পারেন। সে রকম পৃথিবীতে চীনের ভূমিকা কেমন হবে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে চীনের চিন্তাধারায় মৌলিক পরিবর্তন আসে। তখন থেকে তারা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ব্যাপারে মাথাব্যথা বাদ দিয়ে জাতীয় পুনর্জাগরণ বা ‘চীনা স্বপ্নের’ পুনর্জাগরণের মতো ক্ষুদ্র বিষয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে। পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বাস্তববাদীরা পরাশক্তি নির্ধারণ করে থাকেন মূলত একটি দেশের আত্মোপলব্ধি ও বস্তুগত সামর্থ্যের ভিত্তিতে। চীনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ পশ্চিমের সঙ্গে। ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমকে বৈশ্বিক মূল স্রোতের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে শুরু করে। চীনা নেতারা পশ্চিমের সঙ্গে যোগ দিতে না চাইলেও নিশ্চিতভাবেই তাঁরা পশ্চিমের স্বীকৃতি চেয়েছেন। চীনা নেতারা চান না, তাঁদের দেশটি যেন বৈরী সংশোধনবাদী শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত হয়, যাদের স্থান বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে। সে কারণে চীন পশ্চিমের দিকে ঘেঁষে যাচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরও বেশি করে যুক্ত হতে চাইছে। চীনা সরকার নির্দেশনা দিয়েছে, তারা যেন ‘আন্তর্জাতিক পথের সঙ্গে মিলে যায়’। কিন্তু ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর চীন দেখল, এই ‘আন্তর্জাতিক পথ’ সংকটাপন্ন। ফলে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ও নিজের পছন্দে চীন তখন থেকে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। বিদ্যমান ব্যবস্থা এখন তার পথে অন্তরায় নয়, তারা বরং এটা বদলাতে বেশি আগ্রহী।
সৌভাগ্যবশত, চীন প্রথাগত সংশোধনবাদী শক্তি হিসেবে কাজ করছে না। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রতি তারা গভীরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। চীনা নেতারা মনে করেন, তাঁরা নতুন প্রক্রিয়ার ইঞ্জিন। ২০১৩ সাল থেকে সি চীনের মহিরুহ প্রকল্প ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে বৈশ্বিক যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। চীন এশিয়া বা খণ্ডিত আঞ্চলিক জোটগুলো ভাগ করতে চায় না। তাই তারা আন্তর্জাতিক পরিসরে অভিন্ন স্বার্থভিত্তিক সহযোগিতার চর্চা করছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মশাল বহন করতে গিয়ে চীন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে। এখানে বলে রাখি, চীন এখনো উন্নয়নশীল দেশ, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো তার নিত্যসঙ্গী। সি চিন পিংয়ের সরকার দেশটিকে শ্রমঘন ও বিনিয়োগঘন দেশ থেকে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও সেবাভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত করতে চাইছে। ফলে তাকে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অ্যাজেন্ডাই এখন চীনের অগ্রাধিকার হওয়ায় বৈশ্বিক পরিবর্তনের কান্ডারি হওয়ার তার যে আকাঙ্ক্ষা আছে, সেটার লক্ষ্য পরিষ্কার হবে না। এমনকি তার সমন্বিত কৌশলও থাকবে না। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো চীনের ভূরাজনৈতিক শক্তি বা বৈধতা নেই, যুক্তরাষ্ট্রের যেটা ছিল। কারণ, বিশ্বদরবারে তার উত্তরণ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। আবার ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ নিয়েও অনেকের সন্দেহ আছে। তাঁরা মনে করেন, এটি আরোপিত, চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার। এত সব অনিশ্চয়তার মাজেজা হলো: উদার বিশ্বব্যবস্থা বিপন্ন হলেও চীনা নেতৃত্বধীন বিকল্প এখনো বোধগম্য নয়।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ইয়ং দেং: ইউএস নেভাল একাডেমির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.