‘ক্রসফায়ারে’ ম্লান র‌্যাবের সাফল্য

প্রতিষ্ঠার শুরুতেই অপরাধীদের কাছে মূর্তিমান আতংক হয়ে ওঠে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে প্রশংসিতও হয় সংস্থাটি। তবে ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এসব সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে। শুরু থেকেই এ বাহিনীর তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সমাজের সচেতন মহল, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, র‌্যাবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ সুযোগে সংস্থাটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে র‌্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। যদিও ‘ক্রসফায়ার’ অনেক কমেছে বলে দাবি করছে র‌্যাব। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠার পর র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ গত এক যুগে ৯০০ জন নিহত হয়েছে।
২০০৪ সালে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় ৬৮ জন। পরের বছর নিহত হন ১০৭ জন। ২০০৬ সালে সবচেয়ে বেশি ১৯০ জন নিহত হয়। ২০০৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৬ জন, ২০০৮ সালে ৮২ জন, ২০০৯ সালে ৪২ জন, ২০১০ সালে ৬২ জন। এরপর গত ছয় বছরে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে ২৫৪ জন মারা যায়। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে দুটি। র‌্যাবের সার্বিক কর্মকাণ্ড ও বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড করে কোনো সমাজ তার আইনি সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এতে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যায়। ক্রমান্বয়ে সমাজ অসহিষ্ণু ও বর্বর হয়ে ওঠে। যার পরিণতিতে সমাজে নৃশংস অপরাধ বেড়ে যায়। তিনি বলেন, র‌্যাবের প্রতিষ্ঠার এক যুগের কার্যক্রমে সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গুম ও অপহরণ বেড়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনী ক্রমান্বয়ে অপরাধে জড়িয়ে গেছে। র‌্যাব যেসব ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করেছে তাদের খুব কম জনেরই শাস্তি হয়েছে। র‌্যাবের বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বেআইনি কার্যকলাপ যত দ্রুত বন্ধ করা যায় ততই মঙ্গল বলে মনে করেন এ আইনজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন যুগান্তরকে বলেন, ক্রসফায়ার কোনো কিছুর সমাধান করে না। আমরা ক্রসফায়ারকে সমর্থন করি না। ক্রসফায়ারের বিষয়ে র‌্যাবের নজর দেয়া উচিত। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নুর খান যুগান্তরকে বলেন, র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইন-শৃংখলা রক্ষায় যে ভূমিকা রেখেছে তা যেমন প্রশংসিত হয়েছে, পাশাপাশি ‘ক্রসফায়ার’ বা বন্দুকযুদ্ধের নামে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তার দায়ও র‌্যাব এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিচার হয়েছে। তেমনি অতি সম্প্রতি হানিফ মৃধার মৃত্যু নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, র‌্যাবের পক্ষ থেকে গভীর অনুসন্ধান করে তা দূর করা হবে সাধারণ মানুষ এমনটি প্রত্যাশা করে। নুর খান আরও বলেন, আইন দ্বারা পরিচালিত র‌্যাবের যে কোনো কাজ যেমন সমর্থনযোগ্য, তেমনি বিচারবহির্র্ভূত কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহিতা থাকাও জরুরি। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এলিট ফোর্স রয়েছে। তবে তারা কোনো অপরাধ করলে স্বীকার করে এবং বিচার হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান যুগান্তরকে বলেন, র‌্যাবে ক্রসফায়ারের কোনো বিষয় নেই। সন্ত্রাসীরা র‌্যাবের ওপর গুলি ছুড়লে র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে সন্ত্রাসীরা নিহত হয়। র‌্যাবের গুলিতে কোনো নিরপরাধ মানুষ নিহত হওয়ার নজির নেই। জানা গেছে, ২০০৪ সালে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে র‌্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয় জঙ্গি দমন, চোরাচালান, মাদক রোধ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও আইন-শৃংখলা রক্ষায় বিভিন্ন অপারেশনাল কাজে সাহায্য করার জন্য। প্রতিষ্ঠার পরের বছর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি তাদের শক্তি জানান দেয়ার পরই মাঠে নামে র‌্যাবের গোয়েন্দারা। একের পর এক গ্রেফতার করা হয় জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানিসহ শত শত জেএমবি জঙ্গিকে। এছাড়া পিচ্চি হান্নান, আরমানসহ পুরস্কারঘোষিত অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র,
গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য। কিন্তু এর বাইরে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত হয়েছে র‌্যাব। আর এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ক্রসফায়ারের নামে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। ২০০৪ সালের ২৭ জুন তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশ থেকে ইকবাল হোসেন ওরফে লিটন বাবুর লাশ উদ্ধার হয়। র‌্যাবের ভাষ্য, ২৪ জুন পিচ্চি হান্নানকে গ্রেফতারের চেষ্টাকালে গুলিবিনিময়ে আহত হন লিটন। দু’দিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। তবে পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাব তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে লিটনকে। পরের বছর ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় র‌্যাবের অভিযানে পিচ্চি হান্নান গুলিবিদ্ধ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে নিয়ে র‌্যাব ‘অস্ত্র উদ্ধারে’ গেলে পথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় পিচ্চি হান্নান। ২০১০ সালে ৭ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় র‌্যাবের গুলিতে আনোয়ার হোসেন ওরফে পিচ্চি আনোয়ার নামের এক বাসচালক মারা যায়। র‌্যাবের ভাষ্য, সন্ত্রাসীরা বড় ধরনের নাশকতার উদ্দেশ্যে বৈঠক করছে সংবাদ পেয়ে অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় সন্ত্রাসীরা র‌্যাবকে উদ্দেশ করে গুলি ছোড়ে। র‌্যাব পাল্টা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে আনোয়ার নিহত হয়। তবে পরিবারের অভিযোগ, আনোয়ার নিরীহ বাসচালাক। একটি প্রভাবশালী সন্ত্রাসী মহল বিরোধের জের ধরে র‌্যাবকে দিয়ে আনোয়ারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এছাড়া এ বছর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মাসুদ নামের এক চা দোকানি র‌্যাবের গুলিতে নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিল, র‌্যাবের সঙ্গে সহিংসতার ঘটনায় মাসুদ নিহত হয়। র‌্যাবের গাড়িতে লাশ তুলে নিতেও দেখেছেন তারা। তবে এ ঘটনায় র‌্যাব নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে। মাসুদের লাশও পাওয়া যায়নি। ক্রসফায়ার, গোলাগুলি, বন্দুকযুদ্ধ নাকি হত্যাকাণ্ড : র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধ চলাকালে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’ বলে দাবি করা অনেক ঘটনায় নিহত ব্যক্তিকে র‌্যাব প্রথমে গ্রেফতার করে। পরে ‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনা ঘটে। ২০১০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৮৮টি ঘটনার মধ্যে মাত্র চারটিকে র‌্যাব ‘ক্রসফায়ার’ বলে উল্লেখ করেছে। বাকিগুলোকে ‘গোলাগুলি’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছে। র‌্যাব এখন ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি ব্যবহারে অনিচ্ছুক। র‌্যাবের দাবি, এ শব্দটির ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। তবে এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
র‌্যাবের ক্রসফায়ার অনেক কমেছে : র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেন, র‌্যাব দীর্ঘ পরিসরে কাজ করতে পারে না। র‌্যাব দেশের স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের অপারেশন করে পুলিশকে সহায়তা করে। ক্রসফায়ার সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, র‌্যাব সৃষ্টির পর থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। র‌্যাব ও ক্রসফায়ার সমার্থক- এ কথা বলা হলে আমি কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে ভিন্ন কিছু বোঝাতে পারব। তিনি বলেন, ২০০৪ সাল থেকে বর্তমানে ক্রসফায়ার অনেক কমেছে।

No comments

Powered by Blogger.