মুখ ও দাঁতের যত্ন

২০১৩ সাল থেকে ২০ মার্চ ওয়ার্ল্ড ওয়াল হেলথ ডে পালিত হয়ে আসছে। এর আগে ওয়ার্ল্ড ডেন্টাল ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা চালর্স গোডনের জন্ম তারিখ অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালিত হতো। মুখের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য দিবসটির তাৎপর্য উল্লেখযোগ্য। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Live Mouth Smart’. সারা বিশ্ব সচেতনতার মাধ্যমে আজীবন সুস্থ মুখ নিয়ে বাঁচার ওপর জোর তাগিদ দিচ্ছে।
মুখের অভ্যন্তরে নানা ধরনের রোগ নিয়ে অগণিত রোগী ভুগছেন, এর মধ্যে দাঁত শিন শিন করা, দাঁতে গর্ত, দাঁতের ফাঁকে খাবার জমে থাকা, মাড়ি ফুলে যাওয়া, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, মুখে বিভিন্ন ধরনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত বা ঘা থেকে ক্যান্সার, চোয়ালের হাড় ভাঙা বা রোগ, জিহ্বা বা ঠোঁটের রোগ এলোমেলো বা ফাঁকা দাঁত বা বিবর্ণ দাঁত অন্যতম। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে মুখের মধ্যকার রোগ বেশি হয়। অনুকূল পরিবেশগত কারণে চিকিৎসা গবেষকরা মুখের মধ্যে প্রায় ৭০০-এর বেশি প্রজাতীয় জীবাণু শনাক্ত করেছেন, সঠিক উপায়ে নিয়মিত মুখের পরির্চযা না করলে অতি সহজে রোগ তৈরি হতে পারে। দাঁতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশের এক শ্রেণীর মানুষ এখনও মুখের যত্নে ও তার চিকিৎসায় সচেতন নয়। অন্যদিকে বিশাল জনগষ্ঠীর জন্য মাত্র ১০ হাজারের মতো বিডিএস ডিগ্রিধারী ডেন্টাল চিকিৎসক থাকায় অনেকে ভুল জায়গাতে চিকিৎসা নেন। সাধারণত দাঁত বা মুখের চিকিৎসাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে ডেন্টাল চিকিৎসা থেকে রোগীর তাৎক্ষণিক বা পরে অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার আশংকা থেকে যায়। ডেন্টাল চিকিৎসায় প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে, ব্যবহৃত অনেক পদ্ধতি বা পদার্থ এখন বিতর্কিত। রোগী শরীরের অন্যান্য কারণে কী ধরনের ওষুধ সেবন করছেন, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় সেসব ওষুধ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। যেমন- উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের কিছু ওষুধে মাড়ি ফুলতে পারে, রক্ত তরলকরণ ওষুধে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া বা যে কোনো ছোট সার্জারিতেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের আশংকা থাকে, স্টেরয়েড, এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ মুখকে শুষ্ক করে কিছু রোগ তৈরি করতে পারে। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের রোগের মুখে কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা নিয়েও চিকিৎসকের পূর্ণ শিক্ষা থাকতে হয়। যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, গ্যাস্ট্রিক এসিডিটি,
রক্তস্বল্পতা, রক্তের কোনো রোগ, অপুষ্টি, লিভারের রোগ, কিডনি রোগ। পর্যাপ্ত জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থা না থাকলে রক্তবাহী রোগ যেমন হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা থেকে শুরু করে মরণব্যাধি এইডস পর্যন্ত ছড়াতে পারে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি দাঁত ও মাড়ি রোগ শরীরের যে কোনো স্থানে ক্ষতি সাধন করতে পারে। সুতরাং মুখের যত্ন ও চিকিৎসাকে কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। সংখ্যায় অপর্যাপ্ত হলেও দেশে এখন সুচিকিৎসা পাওয়ার মতো অনেক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। রোগীরা একটু সচেতন হলেই বিশ্ব সমমানের চিকিৎসা বাংলাদেশে পেতে পারে। মনগড়া পদ্ধতিতে বা অবৈজ্ঞানিক পদার্থ দ্বারা দাঁত পরিষ্কারে হিতে বিপরীত হতে পারে। মানসম্মত টুথ পেস্ট ও ব্রাশ, প্রয়োজনে ডেন্টাল ফ্লস ও প্ল্যাক রোধক মাউথওয়াশ সঠিকভাবে নিয়মিত ব্যবহার করলে মুখের বেশিরভাগ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দাঁতের গুরুত্ব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। দাঁত শুধু চর্বণের মাধ্যমে খাদ্যকে হজমোপযোগী করে তা নয়, সৌন্দর্য রক্ষায় দাঁতের গুরুত্ব অনেক। আমেরিকায় বিশেষ এক গবেষণায় প্রকাশ, কোনো মানুষ যখন অন্য কোনো মানুষকে দেখে তখন সর্ব প্রথম নজরে পড়ে তার হাসি। ব্যক্তিত্ব সুদৃঢ় করতে হাসির গুরুত্ব অনেক। সঠিক চর্বণ মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে আমাদের প্রাণসঞ্চলন, মেধা ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে। মুখের বেশিরভাগ চিকিৎসায় আমাদের দেশ এখন স্বয়ংসম্পন্ন।
তারপরও আগের অভিজ্ঞতা থেকে এখন এটা অযৌক্তিক ভয় অনেকের মধ্যে কাজ করে যেমন- দাঁতের গর্তে ফিলিং করলে টিকবে কিনা, রুটক্যানেল করলে দাঁতটি নষ্ট হয়ে যায়, স্কেলিংয়ে দাঁত নষ্ট হয়ে যায় এমন অনেক চিকিৎসার সফলতা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা মানুষকে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেয়া থেকে বিরত রাখে। পাশাপাশি ব্যথার ভয় আর খরচের বিষয়টি নিয়েও রোগীরা আতংকে থাকে। মুখের চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি সমগ্র বিশ্বে ব্যয়বহুল, সেই অনুপাতে আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যয় এখনও অনেক কম। চিকিৎসা খরচের কথা ভেবে তথাকথিত হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে অপচিকিৎসার মধ্যে পড়ার আশংকা থেকে যায়। আমরা অনেকটা উদাসীনতা ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে রোগের শুরুতে সঠিক চিকিৎসা না নিয়ে শেষ পর্যায়ে বা অপচিকিৎসার শিকার হয়ে সঠিক স্থানে আসি, যখন চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে ওঠে জটিল, সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বিশ্ব মুখের স্বাস্থ্য দিবস থেকে যদি আমরা সবাই মুখের প্রকৃত যত্ন নিই আর ছয় মাস পরপর বিডিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের পরামর্শ নিই, তা হলেই আমাদের মুখ থাকবে সুস্থ ও সুন্দর সেই সঙ্গে শরীরের অন্যান্য রোগও মানসিকভাবেও আমরা সুস্থ থাকব। স্বাস্থ্যবান্ধব খাবারকে খাদ্য তালিকার শীর্ষে রাখি। এসব সচেতনতার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই গড়ে তুলতে হবে। দাঁতকে খাবার চর্বণ ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করব না। আমাদের সচেতনতা ও সদিচ্ছাই দিতে পারে আজীবন সুস্থ মুখের নিশ্চয়তা।
লেখক : রাজ ডেন্টাল ওয়ার্ল্ড

No comments

Powered by Blogger.